২৫শে মার্চ, ১৯৭১।
সময়: রাত আটটা।
লোকেশন: পূর্ব বাংলার রাজধানী- ঢাকা।
বিষয়: বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যা।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আলোচনা ‘ভেঙ্গে গেছে’ বিকালেই। এই আলোচনা ‘ভেঙ্গে’ যাওয়ার অর্থ বাঙালি বুঝে গেছে ততক্ষণে। পাকিস্তানিদের একটি বড় আকারের সামরিক অভিযানের আশঙ্কায় ‘সাধারণ মানুষ’ নিজেদের করণীয় ঠিক করে নিয়েছে এর মাঝেই। চারিদিকে থমথমে পরিবেশ। রাস্তায় ব্যারিকেড। মানুষের চলাচল নাই বললেই চলে।
খুব জরুরি প্রয়োজনে অল্প ক’জন মানুষ রাস্তা অতিক্রম করছে দু’এক জায়গায়।
এর মাঝেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের দুইটি লরি, একটি জিপ গাড়ি ফার্মগেটের কাছাকাছি এসে পড়ে। রাস্তার ব্যারিকেডে আরো ক’টি গাছের গুঁড়ি সংযোজন করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল ক’জন বাঙালি তরুণ। গাড়ির শব্দ শুনে তারা সচকিত হয়। কিছু বুঝে উঠবার আগেই পাকিস্তানি বহর থেকে গুলি বর্ষিত হয় তাদের ওপর। দু’জন আহত হয়ে লুটিয়ে পড়ে রাস্তার পাশে। বাকি তরুণরা তাদের ধরাধরি করে দ্রুত ঢুকে পড়ে পাশের মহল্লায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের ছোট্ট বহরটি এগিয়ে যায় বাংলা মোটরের (তৎকালীন পাক-মোটর) দিকে।
ওখানেও ব্যারিকেডের মুখে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। বাংলা মোটর এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের মাঝামাঝি একটি জায়গায় ক’জন তরুণকে ব্যারিকেড দিতে দেখে সেখানেও গুলিবর্ষণ করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। কিন্তু তার আগেই সড়কে পড়ে বাঙালি তরুণরা।
পাকিস্তানিরা গাড়িতে বসেই চারিদিকে চোখ বুলায়। রাস্তায় কোন জনমানুষ না দেখে পাকি সৈন্যরা বিজয়ীর বেশে ফিরে যায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে।
সময়: রাত ১১ : ৩০ মিনিট।
ট্যাংক, কামান, মেশিন গান, ভারী অস্ত্রশস্ত্র আর প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। উদ্দেশ্য- বাঙালি নিধন। বিশাল এই বহরটি কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা এবং প্রতিষ্ঠানের দিকে অগ্রসর হয়। একটি দল গিয়ে যুক্ত হয় বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবনে- যেখানে ছিল পাকিস্তানিদের সে রাতের কন্ট্রোলরুম। বাকি দলগুলো- রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ মার্কেট, মোহাম্মদপুর, পিলখানা ইপিআর ব্যারাক, পুরনো ঢাকার বংশাল, সদরঘাট, নবাবপুর, চামেলিবাগ, সিদ্ধেশ্বরী, শাহজাহানপুরসহ ঢাকার আরো কিছু স্থানে নির্বিচারে নির্মম এবং পাশবিক হত্যাযজ্ঞ চালায়। জ্বালিয়ে দেয়- পিপলস ডেইলি, সংবাদ, ইত্তেফাকসহ বেশ ক’টি পত্রিকা অফিস এবং পত্রিকার আর্কাইভ।
উল্লিখিত এলাকাগুলোতে নিহত মানুষের রক্তের গন্ধে ঢাকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। এর মাঝেই পাকিস্তানিদের ওয়ারলেসে ভেসে আসে কিছু বার্তা- যেগুলো ছিল কন্ট্রোলরুম থেকে মাঠে হত্যাযজ্ঞে রত সৈনিকদের প্রতি নির্দেশনা। বাংলায় অনুবাদ করলে সেই বার্তাগুলো অনেকটা এই রকম শোনায়। কন্ট্রোলরুম: কোন স্থানে রোড ব্লক একটি ক্রিমিনাল অপরাধ। এর সঙ্গে জড়িতেদের অবশ্যই ওই স্থানেই গুলি করে হত্যা করা হবে। যে স্থানে রোড ব্লক দেখা যাবে, তার দু’পাশের বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়া হবে। ওভার।
এই রেডিও-বার্তাগুলো ধারণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন এম এম হোসেইন নামের একজন প্রকৌশলী- যিনি ২৫শে মার্চ রাত ১২টার দিকে শর্ট ওয়েভ-এ বিদেশি রেডিওর খবর শোনার চেষ্টা করছিলেন। রেডিওর এক মিটার থেকে অন্য মিটারে যাওয়ার মাঝখানে পাকিস্তানি সৈন্যদের এই রেডিও বার্তাগুলো তার কানে এলে তিনি তার কাছে থাকা একটি অডিও রেকর্ডার দিয়ে বার্তাগুলো রেকর্ড করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এই বার্তাগুলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে অর্পণ করেন।
সেই বার্তা থেকে জানা যায় পাকিস্তানি বাহিনী ওই রাতেই শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই ৩০০ জনের চাইতে বেশি মানুষকে হত্যা করে। সারা ঢাকা শহরে সে রাতে পাকিস্তানিদের হাতে কয়েক হাজার বাঙালি প্রাণ হারায়।
সবাই জানি, কোন জাতিগোষ্ঠীকে সমূলে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে যে হত্যাকা- পরিচালিত হয়- সেটাই ‘গণহত্যা’। জাতিসংঘ বলছে-Genocide is the deliberate killing of people from a particular nation or ethnic group with the aim of destroying that nation or group.
পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর- রাজাকার আল বদর ও আল শামস’রা ১৯৭১-এ বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা, ১ কোটি মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য করা, চার লক্ষ নারীকে নির্যাতন, দুই লক্ষ বাঙালি নারীকে ধর্ষণ, সারা দেশে লুণ্ঠন, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর- এসবের মাধ্যমে তাদের যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমে তাদের ‘গণহত্যা’র রূপটি প্রকাশ করে।
সম্প্রতি, ‘বধ্যভূমিতে একদিন’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাণকাজে বাংলাদেশের ১৪৮টি বধ্যভূমিতে অনেক মানুষের সঙ্গে কথা হয়। সেসব কথার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরতে চাই।
রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাটের একজন অশীতিপর প্রত্যক্ষদর্শী দেওয়ান মোহাম্মদ মোজাম্মেল জানান- “জয়পুরহাটের কড়ই কাদিরপুর গ্রামে ২৬শে এপ্রিল ১৯৭১-এ পাকিস্তানি বাহিনী ৩৭০ জন নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে- ওই একদিনেই।
ঘটনার আর একজন প্রত্যক্ষদর্শী শামসুন্নাহারের বিবরণ ছিল শ্রোতাদের হৃৎপি- মোচড় দেয়ার মতো। আমাদের ক্যামেরার সামনে শামসুন্নাহার জানান-“তখন তো আমরা বউ, তখন তো মাত্র বিয়া হইছে আমার। আমার শ্বশুরের নিমের গাছ আছিল বাবা। সেই নিমের গাছে মানুষরে টাঙ্গাইয়া জ্যাতা মানুষের চামড়া খুলতো পাকিস্তানি আর রাজাকারেরা! খোলে, মারে, কাটে- আর ওই গর্তের মইধ্যে ফেইলা দ্যায়। প্রশ্ন. কি খোলে? শামসুন্নাহার: গায়ের চামড়া খোলে! গরু ছাগলের চামড়া খোলে না, ওই রকম! প্রশ্ন: মানুষের চামড়া খুলতো? দেওয়ান মোজাম্মেল এবং শামসুন্নাহার (সমস্বরে)- হ্যাঁ, মানুষের চামড়া খুলতো! প্রশ্ন: মানুষের চামড়া? উত্তর: হ্যাঁ, মানুষের চামড়া খুইলা মাংস কাইটা ওই গর্তের (গণ কবর) মইধ্যে ফালাইয়া দিতো।
শুধুমাত্র জয়পুরহাট, ঢাকা কিংবা জিঞ্জিরার হত্যাকা-ের কথা শুনে পাকিস্তানি এবং তাদের দোসরদের গণহত্যার প্রকৃত রূপ অনুধাবন করা যাবে না। কিন্তু যে বিষয়টি উদ্বেগজনক- তা হলো, পাকিস্তানি গণহত্যা আপাতদৃষ্টিতে সমাপ্ত হয়েছে একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বরে। অথচ তার রেশ কিন্তু রয়ে গেছে আজো বেশ জীবন্তভাবে। বিষয়টি একটু খুলে বলা প্রয়োজন।
একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বরে রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈনিক যখন আত্মসমর্পণ করে বিকাল সাড়ে চারটার দিকে; সেই দিনই রাত ৮টায় বিবিসিতে প্রচারিত ইয়াহিয়া খানের (তৎকালীন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট) সাক্ষাৎকারের একটি বাক্য ছিল খুবই ভয়ানক এবং ঈঙ্গিতবহ। বিবিসি’র সাংবাদিক ইংরেজিতে প্রশ্ন করেছিলেন ইয়াহিয়া খানকে- (বাংলা অনুবাদ) “তোমার পূর্ব পাকিস্তান তো হাতছাড়া হয়ে গেল। তোমার ৯৩ হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করায় তোমার বিরোধীদের জয় হয়েছে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। এই বিষয়ে এখন তোমার অনুভূতি কি? কি বলার আছে তোমার?” ইয়াহিয়া খান উর্দুতে একটি বাক্যই শুধু বলেছিলেন উত্তরে- “জং জারি রহে গা......(যুদ্ধ চলবে)”!
পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের সেই ‘জং’ বাংলাদেশের ভূখ-ে এখনো ‘জারি’ রয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধীরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল এবং পাকিস্তানিদের সরাসরি সহযোগিতায় ইয়াহিয়ার ‘জং’-এর আগুনে ঘি ঢেলে যাচ্ছে। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই ‘জং’ বিষয়ে নতুন প্রজন্মের অনেক সচেতন থাকা প্রয়োজন। কারণ, এই দেশটির আগামী শাসক কিন্তু তারাই। একাত্তরে যারা স্বাধীনতা এনে দিয়েছে বুকের রক্ত ঢেলে, তারা তো বিদায় নিয়েছে সেই একাত্তরেই।
যার একটি অঙ্গুলির নির্দেশে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীনতার সেই মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট। তার কন্যা শেখ হাসিনার ওপরে মুহুর্মুহু আক্রমণ হয়েছে- তিনি দেশে ফেরার পর থেকে কিছুদিন আগ পর্যন্ত। এর পাশাপাশি সারা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িক দুর্যোগ, দেশকে বিশ্ব সভায় হেয় করার অভিপ্রায়ে অপতৎপরতাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে- তাতে পাকিস্তানি ‘জং’-এর ভূমিকা কতখানি!
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির উৎসবের পাশাপাশি আজ বিবেচনায় রাখতে হবে ‘পাকিস্তানি গণহত্যার ৫০ বছরের’ কথা। কারণ এই দেশটি স্বাধীন হয়েছিল পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করেই। সাতচল্লিশে, বৃটিশের পতাকা আপসে নামিয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের পতাকা উড়েছিল এই ভূখ-ে। কিন্তু একাত্তরে লাল-সবুজ পতাকাটি অর্জন করতে আমাদের ৩০ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। যারা এই ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ সংহার করেছিল, তাদের কেউ কেউ আজও বেঁচে আছে এই বাংলাদেশে। আছে তাদের বড় সংখ্যার অনুসারী। তাই, নতুন প্রজন্মকে পা ফেলতে হবে অনেক সাবধানে। নইলে বিপদ ওত পেতে আছে বাংলার অনেক ঝোপঝাড়ে।
নতুন প্রজন্মকে নিয়ে আমাদের প্রজন্ম অনেক আশাবাদী। খুব নিকট সময়ে বাংলাদেশকে তারা আরো অনেক সম্মানের স্থানে তুলে ধরবে- এটাই প্রত্যাশা করি। নতুন প্রজন্মের জয় হোক। জয় বাংলা।
লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা