গত কয়েক যুগ ধরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে কিছুটা অস্বস্তিকর এবং বিশৃঙ্খল অবস্থায় বিরাজমান। বরাবরই জনগণের মাঝেও ভয়-ভীতি, ক্ষোভ, চিকিৎসক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার কমতি নাই। ২০২০ সালের মার্চ থেকে করোনাকালীন সময়ে একদিকে যেমন চলেছে ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা, অন্যদিকে উন্মোচিত হয়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক নগ্ন দিক। করোনা পূর্ববর্তী সময়ে প্রায়ই সংবাদপত্রের পাতায় কিংবা টিভি খুললেই দেখা যেতো, ‘চিকিৎসা সেবা পাতালে’, ‘সেবার নামে বেহাল অবস্থা’, ‘অভিজাত হাসপাতালগুলো বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত’, ‘সরকারি হাসপাতালে বেহাল দশা’, ‘সাধারণ মানুষ জিম্মি’, ‘টাকা দিয়েও চিকিৎসা মেলেনা’, ‘খোদ রাজধানীতেই অস্ত্রোপাচার করলেন ভুয়া ডাক্তার, অপারেশন টেবিলেই রোগী রেখে পালালেন তিনি, ভুল চিকিৎসায় ২০ জনের চোখ নষ্ট’- এসব চাঞ্চল্যকর অপ্রিয় সত্য কথা। করোনাভাইরাস আসার পর এই খবরগুলো বদলে গেছে। এখন সংবাদপত্রের পাতা খুললেই দেখা যায়, স্বাস্থ্য-সুরক্ষা সামগ্রীর সংকট, হাসপাতালে হাই-ফ্লো অক্সিজেনের অভাব, হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড নেই, প্রয়োজনীয় আইসিইউর অভাব, বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে ভর্তি হতে না পেরে রাস্তাতেই করোনা রোগীর মৃত্যু, স্বাস্থ্য বিধি না মেনে রাস্তাঘাটে জনগণের ঢল, পর্যটন এরিয়াগুলোতে ছুটিতে জনগণের জোয়ার, স্বাস্থ্যখাতে ও ব্যবস্থাপনায় নানা দুর্নীতি- এই ধরনের বিভিন্ন সংবাদে।
গণমানুষের অভিযোগ একটি অপ্রিয় সত্য কথা হচ্ছে, রোগী বা জনগণের বিরাট অংশই ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি কমবেশি ক্ষুব্ধ। তাদের অভিযোগের পাহাড়, যেমন হাসপাতালে ভালোভাবে চিকিৎসা হয়না, ডাক্তার নার্স ঠিকমত রোগীকে মনোযোগ দিয়ে দেখেনা, চিকিৎসকের উচ্চ ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কমিশন ও ঔষধ কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত নানা উপঢৌকনের বিনিময়ে ঔষধ লেখা এবং অযথা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, রোগীদের সাথে খারাপ ব্যবহার, এমনকি অনেকের দৃষ্টিতে ডাক্তাররা ‘কসাই’। অভিযোগগুলো অযৌক্তিক নয়, অনেকাংশেই সত্যও বটে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যাও হাতে গোনা, সরকারি হাসপাতাল গুলোয় রোগীরা সহজে তাদের দেখা পান না, বাধ্য হয়ে সুচিকিৎসার আশায় যেতে হয় প্রাইভেট চেম্বারে। সেখানেও রোগীদের লম্বা লাইন। আবার বিশেষজ্ঞদের সিরিয়াল পেতেও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। তাঁদেরকে অনেক রোগী দেখতে হয়, তাই প্রত্যেক রোগীকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। অনেকের অভিযোগ, বেশি টাকা ফি নিলেও অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই রোগীর গায়ে হাত না দিয়েই বা কথা ভালোভাবে না শুনেই ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন।
এমনকি একগাদা ঔষধসহ অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন, তাও আবার নিজের পছন্দসই ল্যবরেটরিতে। তড়িঘড়ি করে দেখার ফলে চিকিৎসকের প্রতি রোগীরা অসন্তুষ্ট হচ্ছেন ও আস্থা রাখতে পারছেন না। সামর্থ্যবান রোগীরা চলে যাচ্ছেন দেশের বাইরে।
এছাড়া চিকিৎসার খরচও দিন দিন বেড়েই চলছে। হঠাৎ কেউ জটিল রোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসার খরচ মিটাতে হিমশিম খেতে হয়। সরকারি হাসপাতালে খরচ কম হলেও অতিরিক্ত রোগীর চাপে এবং প্রয়োজনের তুলনায় সুযোগ সুবিধা কম থাকায়, প্রত্যাশিত সুষ্ঠু চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হয়না। বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা খরচ আকাশচুম্বী, সেখানে চিকিৎসা নেওয়া অনেকেরই সামর্থ্যের বাইরে। ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ছড়াছড়ি, পরীক্ষার-নিরীক্ষার মানহীনতা, মেয়াদোত্তীর্ণ রি এজেন্টের ব্যবহার, প্রায়ই অনেক ল্যাবরেটরির বিরুদ্ধে ভুল রিপোর্টের অভিযোগ, অদক্ষ টেকনিশিয়ান আর ভুয়া ডাক্তারের আধিক্য, এমনকি দালালদের দৌরাত্মে রোগীরা দিশেহারা। মাঝে মধ্যেই দেখা যায় ম্যাজিস্ট্রেটসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বিভিন্ন ল্যাবরেটরি, হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গিয়ে অভিযান চালান, সাথে সাথে অনিয়মের দায়ে জরিমানাও করা হয়। কিন্তু তাতে অবস্থার পরিবর্তন হয়না। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব ও প্রশাসনিক অদক্ষতায় ভরপুর, গ্রামে-গঞ্জে, উপজেলা, জেলা এমনকি বিভাগীয় পর্যায়েও, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সব মিলিয়ে সারাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হতাশাজনক চিত্রটাই ফুটে ওঠে সর্বত্র।
তবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে একটি বিষয়ে জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, শুধুমাত্র ডাক্তার বা চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে জনগণকে পরিপূর্ণ চিকিৎসা প্রদান করা কখনোই সম্ভব হয় না। বরাবরই ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাঁধে বন্দুক রেখে পর্দার পেছনের মানুষরা পার পেয়ে যায়। এবারে করোনা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যের বরাদ্দ, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যথাযথ এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্তা ব্যক্তিদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং উদাসীনতা ইত্যাদি অনিয়মগুলোকে উন্মোচিত করে দিয়েছে এবং এগুলোই জনগণের স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তির প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
স্বাস্থ্যখাতে আমাদের অর্জন বিগত কয়েক দশক ধরে অনেক সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের অর্জন একেবারে কম নয়, সফলতা অবশ্যই যুগান্তকারী। স্বাস্থ্য বিষয়ক সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিস্ময়কর, প্রশংসিত হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। তার উপর করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের সফলতা পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। শুরুতে করোনা সংক্রমণের প্রথম অন্তরায় হিসেবে সকলের সামনে এসেছিল চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার জন্য যথাযথ পিপিই এর অভাব। প্রথমদিকে পিপির অভাব ছিল বিশ্বব্যাপী, পরবর্তীতে বাংলাদেশ পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস এসকল স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপকরণ উৎপাদনে মনোযোগী হয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন সারা বিশ্বে রপ্তানি করা শুরু করেছে। ফলে চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনসহ করোনা যুদ্ধে ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধাদের জন্য পিপিই-মাস্কসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী নিশ্চিত করা হয়েছে। আবার শুরুতে রোগ পরীক্ষার সুযোগ ছিল সীমিত। তবে টেস্টিং কিট আমদানি, দেশের বিভিন্ন স্থানে ল্যাব স্থাপনসহ পরীক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে সে সংকটেরও সমাধান হয়েছে। পরবর্তীতে পর্যাপ্ত হাসপাতাল, সুসজ্জিত আইসিইউ এবং হাই-ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহের অভাব দেখা দেয়। নানা ধরনের বাধা বিপত্তি এবং অব্যবস্থাপনার পেরিয়েও অনেক হাসপাতালকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে প্রস্তুত করা হয়। হাই-ফ্লো অক্সিজেন সহ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র জনগনের জন্য সহজলভ্য ও নিশ্চিত করা হয়েছে। সময়ের সাথে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিক কোভিড যুদ্ধে সামিল হয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রোগীদের চিকিৎসা সুনিশ্চিত করে। ফলে অনেক উন্নত দেশের তুলনায়ও আমাদের দেশের মৃত্যুর হার কম। শুধু প্রতিষ্ঠান নয় এই মহামারী বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় প্রায় ৪ হাজার নতুন চিকিৎসক এবং প্রায় ৫ হাজারের অধিক প্রশিক্ষিত নার্স নিয়োগ করা হয়। শুধু তাই নয় মনোযোগ দেওয়া হয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দিকে, দেশের অভিজ্ঞ জনস্বাস্থ্যবিদ এবং চিকিৎসকদের সমন্বয়ে করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে। সময়োপযোগী ও আকর্ষণীয় প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার কর্মসৃজন ও কর্মসুরক্ষা, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সরকার একদিকে মানুষকে বাঁচানো, আবার মানুষের খাদ্যের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, শিক্ষার ব্যবস্থা সেগুলো যাতে ঠিক থাকে সেদিকেও লক্ষ্য রেখেছে। কোভিড-১৯ সংকট মোকাবিলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া সময় উপযোগী ও পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
তবে সব দিক বিবেচনায় সবচেয়ে যুগান্তকারী এবং ঐতিহাসিক সাফল্য হল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দক্ষতা, দূরদর্শী এবং সময়পয়োগী সিধান্তের ফলস্বরূপ দ্রুততার সাথে এবং অতি স্বল্প সময়ে পৃথিবীর বড় বড় মহা শক্তিধর দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে দেশের মানুষের জন্য করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রাপ্তি ও সরবরাহ নিশ্চিত করা। আর বাংলাদেশে যেহেতু পূর্বেই ভ্যাক্সিনেশন প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর কাছে উদাহরণ হিসেবে সবসময় বিরাজমান ছিল, তাই এই ভ্যাকসিন জনগণের কাছে সহজে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। ভ্যাকসিন প্রাপ্তি এবং তা জনগণের হাতে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটি দেশের আপামর জনগণের কাছে কোন প্রশ্ন ছাড়াই প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাছাড়া অত্যন্ত আনন্দের খবর এই যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আমাদের দেশেই তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
মার্কিন সংবাদ সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ কতৃক একটি দেশের সার্বিক কোভিড পরিস্থিতি, চিকিৎসা, মৃত্যুহার, কোভিড মোকাবিলায় দেশগুলোর প্রস্তুতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত ইত্যাদি দিক বিবেচনা তৈরি করা ‘কোভিড সহনশীলতা ক্রম’ অনুসারে পৃথিবীর ২০তম সহনশীল ও নিরাপদ দেশের তালিকায় অবস্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ্ত যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি ‘বিস্ময়’।
অন্যান্য অর্জনসমূহচিকিৎসাসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকারের আন্তরিকতার কমতি নাই। সীমাবদ্ধ সম্পদ, দারিদ্র্য, জনসংখ্যার আধিক্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের এই অর্জন অনুকরণীয়। দেশের সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার নেটওয়ার্ক। ্তু১৬২৬৩্থ নম্বর ব্যবহারের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত তথ্য প্রদান এবং ৯৫টি হাসপাতালে টেলিমেডিসিন সেবা চালু হয়েছে। ২০১১ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল হেলথ ফর ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। মজবুত অবকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাত্রার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে, যা উন্নয়নশীল অনেক দেশের জন্য মডেল। জনবল বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বাংলাদেশকে পোলিও এবং ধনুষ্টংকার মুক্ত ঘোষণা, ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধি, উন্নত শিশুস্বাস্থ্য সেবা, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের স্বাস্থ্য পরিসেবা ব্যবস্থা, চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ, মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের জন্য ফ্রি চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং টিকাদানে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। দেশের ৯৯ ভাগ উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে রয়েছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবার উন্নয়নে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন, নতুন হাসপাতাল চালু ইত্যাদি উন্নয়নমূলক অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার ।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা এবং পুষ্টি (এইচপিএন) খাতে বিদ্যমান বাধাসমূহ দূর করার বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অনূর্ধ্ব ৫ বছর পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর হার, এক বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু হার, নবজাতক মৃত্যুহার এবং মাতৃমৃত্যু হার বিগত সময়ের তুলনায় অনেক কম, যার ফলে গড় আয়ু ৭২.৮-এ উন্নীত হয়েছে। মূলত স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবায় সরকারি সুবিধার উৎকর্ষের কারণেই এই অর্জন। বর্তমানে প্রায় ৯১.৩ শতাংশ শিশুকে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাংলাদেশরে ই.পি.আই. প্রোগ্রামের মাধ্যমে সারাদেশে টিকা কার্যক্রমের সফলতা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এরই স্বীকৃতি স্বরূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭% এ হ্রাস, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ৬২.৪% এ উন্নীত, মোট প্রজনন হার বা মহিলা প্রতি গড় সন্তান জন্মদানের হার ২.০৫ এ হ্রাস পেয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতায় ৩২২ চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ে বহু হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সারাদেশে ১৩,৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক, ১ হাজার ২৭৫টি ইউনিয়ন সাব সেন্টার এবং ৮৭টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অচিরেই আরো ৪৫০০ টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হবে। বর্তমানে দেশে শতাধিক সরকারী ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চালু রয়েছে। অনেক বিশেষায়িত হাসপাতালে বিনামূল্যে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনী, প্রসূতিসেবা, অর্থোপেডিক, চোখ, নাক-কান-গলা, হৃদরোগ, নবজাতক ও অপুষ্টিজনিত সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। সংক্রামক ব্যাধি, কুষ্ঠ ও অন্যান্য রোগের জন্য ১৪টি বিশেষায়িত হাসপাতাল ছাড়াও সকল মেডিকেল কলেজ, জাতীয় হৃদরোগ, বিশেষায়িত এবং ১২টি জেলা হাসপাতালে সিসিইউ্থএর চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। ক্যান্সার রোগীর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে সকল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও জাতীয় ক্যান্সার ইন্সটিটিউটে। এছাড়াও ১০টি বিশেষায়িত হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউট চালু এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। মোট ১৫,৫৯৬ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং নতুন নার্স নিয়োগ পেয়েছেন ১৫ হাজার। চিকিৎসকদের জন্য উচ্চশিক্ষার আসন বৃদ্ধি, নতুন কোর্স চালু, নার্সিং বিষয়ে পিএইচডি ও মাস্টার্স প্রশিক্ষণ, বিএসসি নার্সিংয়ের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্স চালুসহ দক্ষ জনবল তৈরিতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। মেডিকেল কলেজগুলোর জন্য ৭৫০টি আসন বাড়ানো হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে নতুন ১০,৯৮৩ শয্যা বাড়ানো হয়েছে। নতুন ১৩টি বেসরকারি হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ, সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ২২৫ জন হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল অফিসার ও প্রভাষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৩টি জাতিসংঘ পুরস্কারসহ মোট ১৬টি আন্তর্জাতিক সম্মাননা ও পুরস্কার অর্জন করেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত। গত দশ বছরে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট ৭ গুণ বেড়ে ২৩ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা হয়েছে।
নোবেল লরিয়েট ড. অমর্ত্য সেন ‘ল্যানসেট’ জার্নালে ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর লিখেছিলেন, ‘যাঁরা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন, তাঁরা ভাবতেও পারেননি এই বাংলাদেশ একদিন ঝুড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সামনে এগিয়ে যাবে।’ শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত আশাতীতভাবে অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, চলমান প্রকল্পগুলোর সুষ্ঠু ও সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন এবং ভবিষ্যতের সুচিন্তিত নতুন পরিকল্পনা এ অগ্রযাত্রার পথে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
লেখক: মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক