× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ভো টা ধি কা র /হোঁচট খাওয়া নির্বাচন কমিশন

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম সাখাওয়াত হোসেন (অব:)
২৬ মার্চ ২০২১, শুক্রবার

আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি এবং ৫১ বছরে পা রেখেছি। একদার বাস্কেট কেস বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের উদাহরণ বিশ্বের দরবারে। ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান ২৫ বছরও টিকেনি। আজ বালাদেশ পাকিস্তান তো বটেই বহু ক্ষেত্রে ভারতকেও টপকে গিয়েছে। এর পেছনে সরকারগুলোর সর্বক্ষেত্রে সহযোগিতা থাকলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এক বিস্ময়। যে হাত ভিক্ষার জন্য প্রসারিত হতো এমন কি জাতীয় পর্যায়েও সে হাত এখন কোদাল, শাবল হতে কম্পিউটারের সফ্‌টওয়্যার তৈরি করতে পারদর্শী। বাংলাদেশের গার্মেন্ট এখন হোয়াইট হাউস হতে অক্সফোর্ড স্ট্রিটের ভেন্ডরের হাতে। এই এখন বাংলাদেশের পরিচিতি।
এত সবকিছুর মধ্যেও যে ঘাটতিটি এখন বাংলাদেশের মানুষকে ব্যথিত করে, বিশেষ করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে যে বিষয়টি বাংলাদেশ বিগত প্রায় দেড় দশক ধরে আস্তে আস্তে উদার গণতান্ত্রিক দেশ হতে সংকুচিত গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে- ‘হাইব্রিড ডেমোক্রেসি’। ২০১৪ সাল হতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে যতগুলো মতান্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে কোনোটিকে নির্বাচন অঙ্কে গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হয় তাকেই হাইব্রিড নির্বাচন বলা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই ৫০ বছরের ইতিহাসে সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নতির গল্প যেমন আছে, তেমনি ভালো সরকার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অবক্ষয় তেমনি নির্বাচনী ইতিহাসও গৌরবোজ্জ্বল নয়। এখানে আমিসহ দেশের সিংহভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন এই এক জায়গায় বাংলাদেশের উন্নতির বদলে অবনতি হয়েছে। এর কারণ যথেষ্ট থাকলেও যৌক্তিকতা তা মানে না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল নায়ক বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে বাঙালির ভাতের ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের দর্শন নিয়ে এগিয়েছেন। জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। এ বিষয়টি তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীর’ প্রতি পাতায় বিস্তৃত রয়েছে। সে সব মনে রেখেই ১৯৭২ সালে একটি উদার গণতান্ত্রিক আধুনিক রাষ্ট্রের সংবিধান রচনা করে ছিলেন। অথচ তিনি তার সংক্ষিপ্ত সময়ে বালাদেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। ওই সময়ে যে কয়েকটি বিরোধী বলে কথিত দল ছিল যার মধ্যে স্বাধীনতা-উত্তর দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ (জেএসডি) প্রতিষ্ঠিত হলেও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে ১৯৭৩ সাল, জেএসডিকে উঠতে দেয়া হয়নি। অভিযোগ যে, জেএসডি’র কয়েকটি আসনের ফলাফল বদলানো হয়েছিল। এর সঙ্গেই স্বাধীন দেশের স্বাধীন নির্বাচন কমিশন হোঁচট খেয়েছিল সেই (মহিউদ্দিন আহমদ: জেএসডি’র উত্থান পতন) হোঁচট থেকে বের হতে প্রায় দুই দশক লেগে যায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের হৃদয়বিদারক সবচাইতে কালো অধ্যায়ের পর দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর প্রায় একবছর দেশের সামরিক বাহিনী তথা দেশ এক চরম অশান্তি আর অস্থিরতার মধ্যে পড়ে ছিল। নবীন দেশ, যে দেশটি স্বাধীন হয়েছিল সামাজিক ন্যায়-নীতি ও উদার গণতান্ত্রিক ভ্যালু প্রতিষ্ঠার জন্য সে দেশ তিন বছরের মধ্যে বহুদলীয় গণতন্ত্র হতে একদলীয় সরকার এবং দেশে পরিণত হয়েছিল। এর মধ্য দিয়েই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আর দাঁড়াতে পারেনি। এর পরের অধ্যায় প্রায় একযুগের ‘মার্শাল ডেমোক্রেসি’ যার মাধ্যমে সব প্রতিষ্ঠান ভঙ্গুর অবস্থায় পড়লো। ওই সময় মাল্টিপার্টি ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠার আবরণ দেয়া হলেও সময়টি ছিল সামরিক বাহিনীর রাজনীতিকরণ। অপরদিকে সামরিক শাসকদের যে দল তৈরি হয় তাকে একদিকে যেমন দলছুট রাজনীতিবিদ এবং প্রাক্তন আমলা, সামরিক কর্মকর্তা ও ধনকুবের ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে যুক্ত হওয়াতে রাজনীতিতে অঢেল অর্থের প্রলোভন যেমন চালু হয়, তেমনি চালু হয় ভোট কেনা-বেচার সংস্কৃতি। নির্বাচনে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করা হয়। জিয়া হতে এরশাদ, তৎকালীন বিএনপি (জিয়ার প্রতিষ্ঠিত) হতে এরশাদের জাতীয় পার্টি একই ধারায় গঠিত ও পরিচালিত হয়। ওই সময়ের ওই ক’টি নির্বাচন কমিশন কার্যত পোস্ট অফিসের মতো কাজ করে।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতন হলে আশা জাগে যে, বাংলাদেশে বহুদলীয় উদার গণতন্ত্র ও সরকার গঠিত হবে নির্ভেজাল নির্বাচনের মাধ্যমে। ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন হয় জাস্টিস সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্বাবধানে। জাস্টিস আব্দুর রউফ পঞ্চম নির্বাচন কমিশন নতুনভাবে গঠন করেন। নির্বাচনী আইনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। নির্বাচন নির্বিঘ্নে দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। ওই নির্বাচনে অনেক পণ্ডিতকে অবাক করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জয়ী হয়। নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের বিচ্যুতির কোনো প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও দেশের রাজনীতির মাত্রায় যোগ হয় নির্বাচনকে নিয়ে পরাজিত দলের প্রশ্ন তোলা এবং সহজে ফলাফল না মানার সংস্কৃতি। এক্ষেত্রে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। মনে করা হয় যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে কারচুপির মাধ্যমে হারানো হয়েছে। শুরু হয় বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে এক অলিখিত দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে।
১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ হলেও আওয়ামী লীগের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকাই পালন করেছে। এর মধ্যে দু’টি ঘটনা দুই দলের দ্বন্দ্বে নতুন উপাত্ত যুক্ত হয়েছিল। এর সূত্রপাত হয় বিএনপি যখন সরকারে তখন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর নিরঙ্কুশ বিজয় হয়। খোদ রাজধানী ঢাকায় ১৯৯৪ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হওয়া ক্ষমতাসীন দলের জন্য এক চরম রাজনৈতিক ধাক্কা ছিল। বিএনপি সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছিল যে কারণে ঠিক ঢাকার মেয়র নির্বাচনের পর পরই মাগুরা-২ এর আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যের মৃত্যুতে উপ-নির্বাচনে বিএনপি মরিয়া হয়ে আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যবাহী আসন দখলের সকল প্রচেষ্টা চালায়। সরাসরি এক অরাজনৈতিক ধনকুবের ব্যবসায়ীকে মনোনীত করে এবং আসন দখলের জন্য প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী বাহিনীকে জড়ানো হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘মানি অ্যান্ড মাসল’- ব্যবহারের এমন নজির সেনা-গণতন্ত্রের পরে দেখা যায়নি। ওই নির্বাচন শুধু ত্রুটিপূর্ণই ছিল না যত ধরনের অনিয়মের নজির প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে তেমন ইতিপূর্বে আর ঘটেনি। নির্বাচন কমিশন সরকারের চাপের কাছে মাথা নত করে এমন নির্বাচন বৈধ করিয়েছিল। ওই কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রশংসা কুড়ালেও এই ব্যর্থতার জন্য মেয়াদ পূর্তির আগেই পদত্যাগ করতে হয়েছে।
মাগুরা-২ উপনির্বাচন শুধু নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তিই নষ্ট করেনি বরং বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার উপরে এক বড় প্রশ্ন রেখেছিল। অপরদিকে বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল- যার গভীর প্রভাব থেকে এখনও বের হতে পারেনি। রাজনীতিকে আরও সংঘাতময় করে তুলতে সহায়তা করেছে। এর ফলে দেশের প্রধান দু’টি দলের মধ্যে সংঘাতপূর্ণ অবস্থানের সৃষ্টি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন শুরু হয় যেখানে প্রথমবারের মতো সরকারি কর্মকর্তারা সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় বাংলাদেশে প্রশাসনকে রাজনৈতিক ও দলীয়করণ।
যাইহোক ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার পর তিনটি নির্বাচন আন্তর্জাতিক মানের স্বীকৃতি পায়। তথাপি রাজনৈতিক সংঘাতের শেষ হয়নি। সংঘাতের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দলের ওপর মারাত্মক গ্রেনেড হামলার মধ্যদিয়ে। দুই বৃহৎ দলের মধ্যে হিংসা, অবিশ্বাস আর রাজনৈতিক হানাহানির কারণে কথিত ১/১১ এর সূত্রপাত। ২ বছর পর ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনই বাংলাদেশে যে কয়েকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও জনগণের ভোট নিশ্চিত করে তার চরম বিপর্যয় ঘটে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর হতে আজ পর্যন্ত। বর্তমানে পুনরায় নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় ধস নামে। এখন কোনো স্তরের নির্বাচনই মানুষের প্রত্যাশার ধারে-কাছেও নেই।
এ সময়ে বাংলাদেশ যখন গর্বের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি গণতন্ত্রের ঘাটতির কারণে সাধারণ মানুষ ‘গুড গভর্নেন্স’- হতে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশকে এখন বলা হয় ‘হাইব্রিড ডেমোক্রেটিক’- দেশ। অথচ আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন আর বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনের সংগ্রাম ছিল উদার গণতন্ত্রের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। এখানে বাংলাদেশ এখনও গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তবুও বাংলাদেশে এই গৌরবময় ৫০ বছর পূর্তি এবং বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকীতে আমরা আশা করবো যে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন এবং উদার গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করবে। যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন।

(প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার, বর্তমানে সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট ফর পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্সের, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, সিনিয়র ফেলো)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর