× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭) /‘এদের সবাই ছিল ক্রোধান্বিত’

বই থেকে নেয়া

স্টাফ রিপোর্টার
২৭ মার্চ ২০২১, শনিবার

প্রিজন ভ্যানটি যাচ্ছিল খুব ধীরে ধীরে। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা ঠিক কোথায় আছি?” “সোনারগাঁও হোটেলের কাছে ভিআইপি রোডে।” একজন জবাব দিলো। আমি ভ্যানে ওঠার পরমুহূর্ত থেকে পুলিশম্যানরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ক্রমাগত অভিযোগ করে চলছিল। কোনো কোনো জিনিসের দাম বেড়ে গিয়েছিল শতকরা ৭০ ভাগ থেকে ২৪০ ভাগ পর্যন্ত। সাধারণ মানুষের প্রতিদিনকার প্রধান খাদ্য এক কেজি মোটা চালের দাম এখন ৩৮ টাকা, যা বিগত সরকারের সময় এক বছর আগে ছিল ১৬ টাকা। এক লিটার ভোজ্য তেলের দাম ৪২ টাকা থেকে এখন পৌঁছেছে ১৩০ টাকায়, ডালের দাম কেজিপ্রতি ৩৫ টাকার স্থলে দাঁড়িয়েছে ১০০ টাকায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি সকল শ্রেণির জনজীবনকে করে তুলেছে এক কথায় দুর্বিষহ।
“কিন্তু আপনারা তো অনেক কম দামে রেশনে কেনার সুবিধা পাচ্ছেন?” উত্তর এলো, “তা মোটেই আমাদের গোটা পরিবারের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রায়ই বাড়তি সদাই আমাদের খোলাবাজার থেকে কিনতে হয়।
এদের সবাই ছিল ক্রোধান্বিত। তারা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য ক্রমাগতভাবে সরকারকে গালাগাল করছিল। শুনলাম, ওদের একজনের ভাই কাজ করছিল খুলনার এক জুট মিলে। সেসহ ৬০০ জনকে কোনোরকম ক্ষতিপূরণ না দিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। গত তিন মাসে এ ধরনের কমপক্ষে ৬টি কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, এ কারণে হাজার হাজার শ্রমিকই শুধু নয়, তাদের শিশু-সন্তানেরাসহ পরিবারবর্গ অশেষ দুর্গতির মধ্যে রয়েছে। ওদের অভিযোগের কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না। মাথার ওপর বসে সবকিছুতে খবরদারি করায় মিলিটারি অফিসারদের ওপরও ওরা ছিল ত্যক্ত-বিরক্ত। শুনলাম, তাদের সিনিয়র অফিসাররা সর্বদা সামরিক গোয়েন্দাদের নজরদারিতে রয়েছে। জেলখানার গোটা ব্যবস্থাপনা ও জেল প্রশাসন সামরিক কর্মকর্তাদের অঙ্গুলি হেলনে চলছে। ওদের একজন বললো, “আমরা হলাম সামান্যমাত্র কনস্টেবল, পেট ভরে খাওয়ার, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর সঙ্গতিও অনেকের নেই, অথচ আমাদেরও বলা হচ্ছে আমরা যেন আমাদের সম্পদের বিবরণী দাখিল করি। আমরা গরিব, আমাদের আবার কী সম্পদ থাকতে পারে! অথচ সেনাবাহিনীর সাধারণ সিপাহিদের তাদের বড় বড় অফিসারদের বেলায় তো এমন ধরনের বিবরণী দাখিল করার কথা বলা হচ্ছে না।”
পুলিশদের মধ্যে একজন নিজেকে হাবিলদার উল্লেখ করে বললো, “আর্মি অফিসারেরা আমাদের চাইতে অনেক বেশি ভালো অবস্থায় রয়েছে। তারা এবং তাদের বড় কর্তারা বাড়িঘর কিংবা ব্যবসা বাণিজ্যের অধিকারী হলেও তাদের কোনোভাবে তাদের স্পর্শ করা হচ্ছে না।” আমি কিছু বলার আগেই হাবিলদারটি নিজের এবং তার সহকর্মী ও পরিবারবর্গসহ অন্যদের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী একাধারে বলেই যাচ্ছিল। এরমধ্যে ওদের একজন জানালো যে, আমরা পিজি হাসপাতাল ও বারডেম পার হয়ে শাহবাগের মোড়ের কাছ দিয়ে যাচ্ছি। বারডেম হলো দেশের বৃহত্তম ডায়াবেটিক হাসপাতাল এবং এর পরের মোড়েই বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের কাছে রয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিস্থল। এগুলো সবই নতুন নির্মাণ করা সৌধ এবং মূলত এখান থেকেই শুরু হয়েছে নতুন ঢাকার সীমানা।
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। ১৯৫৬ সালে আমি তখন সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বি.এ. অনার্স ক্লাসে ভর্তি হয়েছি। কোর্স তখনো শুরু হয়নি, আমরা তখন ক্লাস শুরু হওয়ার অপেক্ষায়। সর্বগ্রাসী এক বন্যা গোটা দেশকে আঘাত করে নিমাঞ্চলগুলোকে পুরোপুরি প্লাবিত করে দিয়েছে- দুর্দশায় পড়েছে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। অসংখ্য পরিবার শিশুসন্তানসহ যথাসম্ভব সহায়সম্বল নিয়ে বাড়িঘর পরিত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে সরকার দেশব্যাপী লঙ্গরখানা ও আশ্রয় শিবির স্থাপনে বাধ্য হয়েছে। শত শত স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ঐসব ক্যাম্পে গিয়ে দুর্গতদের সাহায্যার্থে খাদ্য, কাপড়-চোপড় ও ঔষধপত্র বিতরণ করছে। যার যতটুকু সম্ভব সাহায্যদানের ও সেবা করার এই মনোবৃত্তি ছিল অসাধারণ এক ঘটনা এবং জাতীয় যে কোনো দুর্যোগকালে দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের এক অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলে আমরাও গঠন করলাম ছোট একটা স্বেচ্ছাসেবী দল এবং রওনা দিলাম ঢাকা থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহজাদপুরের দিকে। সেটা ছিল সবচাইতে দুর্গত এলাকাগুলোর মধ্যে একটি এবং বর্ষীয়ান জনপ্রিয় নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী স্বয়ং সেখানে সাহায্য ক্যাম্পে কাজ করছিলেন।
সেটি ছিল সবচেয়ে বেশি লোকজনের আশ্রয় নেয়া আশ্রয় শিবিরগুলোর একটি, এতে ৩০০-এর বেশি পরিবার, একটি মাত্র তারপুলিনে মোড়া তাঁবুর নিচে সকলে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রাইভেসির কোনো বালাই ছিল না- ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে কোনোরকমে দিন কাটাচ্ছিল আবালবৃদ্ধবনিতা। শিশু কিশোরদের আর্তচিৎকারে চারদিকে এক পরিত্রাহি অবস্থা। এর পরেও তাদের মধ্যে অপরিসীম সহিষ্ণুতা ছিল। ছিল একে অন্যকে সাহায্য করার ব্যাকুল আগ্রহ। খাওয়ার সময় হলে যুবকেরা বৃদ্ধদের সাহায্য করেছে। মেয়েরা শিশুদের, হলুদ ব্যাজ লাগানো স্বেচ্ছাসেবকেরা সাহায্য করছিল অক্ষম বা পঙ্গুদের। এক সারিতে দীর্ঘকাল অপেক্ষায় থাকা অভুক্ত লোকগুলোর হাতে তুলে দেয়া হচ্ছিল চাল ও ডালে মেশানো খিচুড়ি জাতীয় একরকম খাবার। আশ্রয় শিবিরের লোকজন ব্যাপকভাবে ডায়রিয়া ও পেটের পীড়াসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছিল। স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে জনসাধারণ একই সঙ্গে ধোয়া-মোছা ও খাওয়ার পানি সংগ্রহের জন্য পার্শ্ববর্তী নদীর পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছিল। টিনের তৈরি চোঙা ফুঁকে সকলের উদ্দেশে বারংবার চিৎকার করে স্বাস্থ্য বিষয়ে নানান সতর্কবার্তা জানানো হলেও বাস্তবে কেউ তাতে তেমন কান দেয়নি।
এই ক্যাম্পটিতে আমাদের প্রথম পাঁচদিনে সাতজন নবজাতক ভূমিষ্ঠ হয়। মূলত প্রাথমিক চিকিৎসার ডাক্তারদের সাহায্য এবং তাদেরই ঔষধপত্র ব্যবহার করে এবং গ্রাম্য মহিলা ধাত্রীদের সহায়তা ও পরিচর্যায় এসব নবজাতকের জন্মদান কার্যক্রম চালানো হয়। এ ধরনের একটি জন্মদানের সময় আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম। শাড়ি দিয়ে ঘের দেয়া পর্দার অন্তরালে একজন গ্রাম্য ধাত্রী কীভাবে মায়ের নাড়ি থেকে ছোট ছুরি দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে একজন শিশুকে ভূমিষ্ঠ করান - এই প্রথমবারের মতো তা আমি আমার জীবনে প্রত্যক্ষ করি।
আশ্রয় শিবিরে জেনারেটরগুলো বন্ধ করে দেয়ার পর যখন সবগুলো বাতি নিভে যেতো তখন কেবলমাত্র শিশুদের কান্নার আওয়াজ বাদ দিলে চারদিকে সুনসান নীরবতা নেমে আসতো। দিনের কাজ শেষ হওয়ার পর আমাদের প্রধান করণীয় ছিল পরের দিনের জন্য কী কী কাজ করতে হবে তা গুছিয়ে নেয়া। এরপর আমাদের কাজ ছিল নদীর তীরে একটু হেঁটে বেড়ানো। সেখানে একদিন চোখে পড়লো লম্বা খুঁটিতে বাঁধা নৌকার সারি- নদীর পানিতে চন্দ্রচ্ছটার দেয়ালী উৎসব এবং ক্রমশ ক্ষীয়মাণ চাঁদের বিলীয়মান আলো। সারাদিনের কর্মক্লান্ত শরীরে সকলে মিলে একসঙ্গে খাওয়ার পর আমাদের সবচেয়ে কাম্য ছিল নৌকার বুকে একচিলতে নিদ্রা। চাঁদ ধীরে ধীরে বিদায় নিলে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসতো। নদীপাড়ে অসংখ্য জোনাকীর আলো আর মৃদুমন্দ বাতাসের তালে তালে নৌকার দুলুনী, চোখে কোমল নিদ্রা নেমে আসতো।
আমাদের কাজের পঞ্চম দিনে, অন্যান্য দিনের মতোই নিকটস্থ বাজার থেকে একজন ডাকপিয়ন চিঠি বিলি করতে আসে। চিঠিগুলো মূলত ছিল সরকারি অফিসারদের জন্য এবং তাতে এলাকার বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হতো। এরইমধ্যে একটি টেলিগ্রাম আমার কাছে বিলি করা হলো- টেলিগ্রামে ইংরেজিতে লেখা ছিল, “রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংকটাপন্ন- তাড়াতাড়ি চলে এসো।” টেলিগ্রামটি পাঠিয়েছিলেন আমাদেরই ছাত্র সংগঠন ছাত্রশক্তির সভাপতি ও স্বনামধন্য ছাত্রনেতা ফরমানুল্লাহ খান।
সঙ্গে সঙ্গে আমি ক্যাম্প ছেড়ে চলে এলাম এবং সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকায় পৌঁছলাম। ঢাকায় এসে খবর পেলাম যে, মিশরের শাসক এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা কর্নেল গামাল আবদেল নাসের ইঙ্গ-ফরাসি কোম্পানির কাছে লিজকৃত বিশ্বখ্যাত সুয়েজ খালের আন্তর্জাতিক নৌপথ পরিচালনার বিষয়টি জাতীয়করণ করায় এক যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বৃটিশ ও ফরাসি বোমারু বিমানগুলো মিশরে নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করে নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করছে। ইসরাইলও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এমতাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই জঘন্য আক্রমণের নিন্দা জানিয়ে আফ্রো-এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার নিপীড়িত জনগণের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে। তখনকার জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘প্রভুত্ববাদী ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও’। বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হলো। মিছিল করে বৃটেন এবং ফ্রান্সের ঢাকাস্থ কূটনৈতিক মিশনগুলোর সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হলো।

(চলবে..)

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর