× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮) / ‘তারা লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে পেটাতে শুরু করলো’

বই থেকে নেয়া

স্টাফ রিপোর্টার
২৮ মার্চ ২০২১, রবিবার

সেই সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আতাউর রহমান খান- দু’জনেই ছিলেন বাঙালি প্রতিনিধিদের নেতা এবং মিশরের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে সহানুভূতিশীল। কিন্তু সোভিয়েত পরাশক্তির বিরুদ্ধে মার্কিনিদের গড়ে তোলা উদীয়মান সিয়াটো ও সেন্টোর সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে মিশরের ব্যাপারে পাকিস্তানের কী ভূমিকা হওয়া উচিত- এ নিয়ে উপরোক্ত দুজনই ছিলেন দোদুল্যমান। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনকে মনে করা হতো পশ্চিমা ও পুঁজিবাদবিরোধী একটি সংগঠন এবং অনেকটা বিশ্ব সমাজতন্ত্রবাদের প্রতিনিধিত্বকারী সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। এভাবে দুই পরাশক্তি দ্বিধাবিভক্ত পৃথিবীতে নিজ নিজ বলয়কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এক দীর্ঘস্থায়ী স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ওই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার মিশরের পক্ষে কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়।
যাই হোক, গোটা শহরের সকল শ্রেণীর ছাত্রদের সমন্বয়ে বিশাল এক বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করা হয়। মিশরের ওপর ইঙ্গ-ফরাসি বাহিনীর বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে সরকারিভাবে নিন্দাবাদ জানানোর জন্য বিক্ষোভ মিছিল থেকে দাবি উত্থাপন করা হয়। প্রথমে আমরা ধানমন্ডির ২নং সড়কে ফরাসি কনস্যুলার কার্যালয়ে যাই এবং পুলিশের ব্যারিকেড সত্ত্বেও সেখানে ঢুকে ফরাসি পতাকা নামিয়ে দেই। সেখান থেকে দীর্ঘপথ মিছিল নিয়ে আমরা যাই বর্তমান প্রেস ক্লাবের কাছে তোপখানা রোডে অবস্থিত বৃটিশ কনস্যুলার অফিসের দিকে।
ছাত্ররা পুলিশের প্রবল প্রহরা ভেদ করে হাইকমিশন ভবনের দিকে এগিয়ে যায়। সে সময় ভবনের ছাদে দক্ষিণা মৃদু বাতাসে বৃটিশ ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা উড়ছিল।
কনস্যুলার ভবনটির চারপাশে ছিল সুউচ্চ দেয়াল এবং রাস্তার সামনের দেয়ালের ঠিক ধারঘেঁষে ছিল ছোট একটা নালা। আমি তখন কেবল ফার্স্ট ইয়ারের একজন ছাত্র। মিছিলের সামনে আমার থাকার কোনো কথা ছিল না, যেটা ছিল আমার চাইতে অনেক সিনিয়র নেতাদের জন্য নির্ধারিত। কিন্তু কিছুটা দূরে হলেও ভবনটির ছাদ ও উড্ডীয়মান পতাকাটির দিকে দৃষ্টি পড়ায় আমি আরো কয়েকজনের সাথে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। এক ধরনের উত্তেজনা ও অ্যাডভেঞ্চারের বশবর্তী হয়েই আমি অন্যদের মধ্যে প্রথমে দেয়ালের উপরে উঠতে থাকি। আমি যখন দেয়ালের প্রায় উপরে উঠে ভেতরের দিকে কম্পাউন্ডের ভিতরে লাফ দিতে যাচ্ছি, ঠিক সেই সময়ে একজনকে ‘চার্জ’ বলে নির্দেশ দিতে শুনলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের একটি দল আমার দিকে ছুটে এলো। তারা লাঠি দিয়ে আমার পুরো শরীরে নির্দয়ভাবে পেটাতে শুরু করলো। দেয়ালের ওদিকে আর যাওয়া হয়নি। আমি নালাতে পড়ে যাওয়ার পরেও পুলিশ আমাকে শরীরের ডান দিকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে চলছিল। একপর্যায়ে আমার নাড়ির গতি মৃদুতর হয়ে আসে, তীব্র ব্যথা ও যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আমি হয়ে পড়ি অচেতন। তিনদিন অক্সিজেন নিয়ে টিকে থাকা পর আমার চেতনা ফিরে আসে। আমি দেখি আমার পা দুটো উপরের দিকে উঁচু করে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমার গোটা বিছানায় ফুলের ছড়াছড়ি। বিছানা ঘিরে আছেন তখনকার তিন রাজনৈতিক নেতা। এদের মধ্যে রয়েছেন এক ভঙ্গুর যুক্তফ্রন্ট কোয়ালিশন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী পদ নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতায় রত দুই নেতা- জনাব আতাউর রহমান খান আর জনাব আবু হোসেন সরকার এবং মাঝখানে ছাত্রদের দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় বসে আছেন উদীয়মান আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। আমাকে রাখা হয়েছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডের একটি বেডে, যেটা ছিল পুরনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় গায়ে লাগানো। শক্তিশালী ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পরও আমার সারা শরীরে ব্যথা ছিল। ওষুধের প্রভাব আস্তে আস্তে কমতে থাকায় ব্যথাও ক্রমশ তীব্রতর হয়ে উঠছিল। সেদিনকার সেই প্রচণ্ড আঘাতের প্রতিক্রিয়া আমার জীবনে এখনও বহন করে যেতে হচ্ছে।
পরের দিন আমি জানলাম আমার একজন বন্ধু দীন মোহাম্মদ দীনু আমাকে একটা রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। পুলিশরা রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে এক সময়ে মৃত মনে করে আমাকে ফেলে চলে যায়। দীনু বলে, ‘আল্লাহ তোমাকে মরার হাত থেকে তুলে এনেছেন।’ আমার উপর পুলিশের বর্বরোচিত আক্রমণের পর যখন আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি তখন ‘একজন ছাত্র নিহত হয়েছে’- এ গুজব ছড়িয়ে পড়লে জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং কাছেই আমার বন্ধু আব্বাসীদের বাড়ির কাছে কাঠ দিয়ে তৈরি পুরো বৃটিশ ইনফরমেশন সেন্টারে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
আমি অনুভব করতে পারলাম যে, আমার ডান হাত ও ডান পা একেবারেই নিথর হয়ে পড়েছে। জিজ্ঞাসা করার পর একজন নার্স আমাকে জানালো যে, আমার ডানদিকের হাত ও পা প্রায় অবশ হওয়ার পর্যায়ে চলে এসেছে। ডানপায়ের অবস্থা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি খারাপ। সার্জারি বিভাগের প্রধান প্রফেসর কে.এস. আলম আমার জীবন বাঁচানোর স্বার্থে ডান পা হাঁটুর উপর থেকে কেটে ফেলে দেয়ার কথা চিন্তা করছেন। নার্সের কথা শুনে আমি তো ভয়ে শিউরে উঠলাম। গোটা শরীরে আরো যন্ত্রণা যেন ছড়িয়ে পড়লো। আমি একরকম বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। গোটা বাকি জীবনে আমাকে এক পা নিয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হবে, এই অসহায় পঙ্গুত্বের কথা চিন্তা করতে পর্যন্ত আমার কষ্ট হচ্ছিল। এরকমভাবে আমার বেঁচে থাকাটাই হবে অর্থহীন। তার চাইতে মৃত্যুই হবে শ্রেয়। নার্স জানালো, ‘ডাক্তার সাহেব কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাকে দেখতে রাউন্ডে আসবেন। ইচ্ছা করলে আপনি ওনার সাথে কথা বলতে পারেন।’ নার্স তখন তাকিয়ে ছিল অন্য দিকে, বোধহয় আমার দিকে তাকাতে তার মন চাইছিল না। হয়তো আমার ভবিষ্যত কী হবে, গোটা জীবন কীভাবে আমাকে কাটাতে হবে এবং কে আমাকে কীভাবে দেখাশোনা করবে,
এসব চিন্তাই তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এক সময় আমার দিকে একপলক তাকিয়ে সেই নার্স নীরবে সেখান থেকে চলে গেল। আমি তখনো প্রচণ্ড ব্যথায় মুহ্যমান আর আমার দু’গালে অশ্রু ঝরে পড়ছিল।
কিন্তু সৌভাগ্যবশত মনে হয় দ্রুত সেরে ওঠার কারণেই ডাক্তার শেষ পর্যন্ত আমার পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। কিন্তু সার্জারির সেই অধ্যাপক আমাকে এই বলে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, আমার হাঁটুর অবস্থা দুর্বলই থেকে যাবে। আমার ডান কাঁধেও স্থায়ী একটা ক্ষত থেকে যাবে। তিনি আমাকে সব সময় খুব সতর্ক থাকার পরামর্শ দিলেন। তবে এই ভেবে আমি পরম স্বস্তি পেলাম যে, বাকি জীবন আমাকে শুধু এক পা নিয়ে ‘ল্যাংড়া’ পদবি বহন করে বেঁচে থাকতে হবে না, অন্য সবার করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকতে হবে না। তবে একেক সময়ে চরম হতাশাভরে আমি সবিস্ময়ে অনুভব করেছি যে, রাজনীতির এই অন্ধকূপে যন্ত্রণাময় জীবনে বেঁচে থাকার চাইতে বোধহয় সারা জীবন এক পা নিয়ে পঙ্গুত্ববরণ করে নেয়াই ছিল আমার জন্য শ্রেয়তর- সে অবস্থায় জীবন বোধহয় এখনকার প্রিজন ভ্যানে ভ্রমণের চাইতে কম অভিশপ্ত হতো।
আমার হাসপাতালে অবস্থানকালে সে পর্যন্ত আমার বাবা একদিনের জন্যও আমাকে দেখতে আসেননি। অথচ আমি ছিলাম তার প্রিয়তম সন্তান। তার এই না আসার পেছনে মূল কারণ ছিল, বাকি সারা জীবন এক পা নিয়ে আমাকে পঙ্গু অবস্থায় ক্রাচে ভর করে কাটাতে হবে- এ কথা মনে করে শয্যাশায়ী অবস্থায় আমাকে দেখতে আসার যন্ত্রণা সহ্য করার মতো শক্তি তার ছিল না। আমার সেই অবস্থা নিজ চোখে দেখার কথা তিনি তার কল্পনায় আনতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত আমার মামা, ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত সুবিখ্যাত লেখক দুই ভাই- শহীদুল্লাহ কায়সার ও জহির রায়হানের বাবা, মওলানা হাবিবুল্লাহর বিশেষ অনুরোধে আমার বাবা আমাকে দেখতে আসেন। ইতিমধ্যে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, আমার পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হয়েছে। আমার শয্যার একপাশে বসে অশ্রুভারাক্রান্ত বাবা মাথা নিচু করে দু’হাত একটু তুলে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে দীর্ঘসময় ধরে আল্লাহর দরবারে আমার জন্য দোয়া করেন।
আরো প্রায় এক মাস পরে বাড়িতে ফিরে দেখতে পেলাম যে, আমার পরম করুণাময়ী মা আর স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তিনি খুবই রক্ষণশীল স্বভাবের মানুষ ছিলেন, কিন্তু আমার এই দুর্ঘটনার পর এতদিনে তার জ্ঞানশক্তি পুরোপুরিভাবে হারিয়ে ফেলেছেন। মাঝে-মধ্যে হঠাৎ করেই তিনি বোরখা ছাড়াই উদ্ভ্রান্তের মতো মহল্লা দিয়ে হেঁটে গিয়ে একটা রিকশা নিয়ে একাই তার পীরসাহেব পরিবাগের শাহ সাহেবের দরবারে চলে যেতেন। আমার গোটা জীবনে তাকে এরকম উদ্ভ্রান্ত হতে কখনো দেখিনি। বিছানার নিচে টিনের ট্রাংকে সারা জীবনের অতি কষ্টের সময় গোপন সঞ্চয় তিনি আমার জন্য খরচ করে ফেললেন। যতদিন আমি বিছানায় পড়ে ছিলাম ততদিনই তিনি হাইপার ডেলিরিয়ামে ভুগেছেন। তার অন্তরে আমার জন্য যে কতটুকু ভালোবাসা ছিল এ থেকে আমি তা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারছিলাম। আমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করলে তিনিও ক্রমশ সেরে উঠতে থাকেন। তবে মাকে নিয়ে আমার জীবনের সেই স্মৃতি আমি কোনোদিনও বিস্মৃত হতে পারিনি।

(চলবে..)

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর