× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে-(৯) /‘ভ্যান থামালে আমার চোখের বাঁধন খুলে নেয়া হয়’

বই থেকে নেয়া

স্টাফ রিপোর্টার
২৯ মার্চ ২০২১, সোমবার

বৃটিশ কনস্যুলার ভবনে পাওয়া আঘাতের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমাকে সব রকমের শারীরিক খেলাধুলা ছেড়ে দিতে হয়। ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম একজন দক্ষ অ্যাথলেট। সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে সবেমাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ই আমি ছিলাম স্কুলের হকি টিমের একজন খেলোয়াড়। যে নবকুমার স্কুল থেকে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেই সেই স্কুলের আমি ছিলাম স্কুল ক্যাপ্টেন। ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া পর্যন্ত আমি স্থানীয় লীগে নিয়মিতভাবে হকি, ক্রিকেট ও ফুটবল খেলেছি।

খেলাধুলায় বার্ষিক প্রতিযোগিতাগুলোতে আমি সাইক্লিংসহ অনেক ক্ষেত্রে পুরস্কার পাওয়ার পর্যায়ে ছিলাম। অথচ আমাকে সবকিছু ছেড়ে দিতে হয়েছে। ছাত্রজীবনের পরবর্তী সময়গুলোতে আমি আর কোনো খেলাধুলায় অংশ নিতে পারিনি। একটু অসতর্ক অবস্থায় নড়াচড়া করলেই আমার ডান হাত কাঁধের জোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো আর আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তো অসহ্য যন্ত্রণা।
আবার জোড়া লাগা পর্যন্ত সেই প্রচ- ব্যথার দাবদাহ অব্যাহত থাকতো। আমি লেখাপড়ার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার পর সেখানকার একজন মিশরীয় বৃটিশ সার্জন ৬ ঘণ্টার এক কঠিন ও জটিল অপারেশন করে জোড়ার হাড়টিতে একটি পিন লাগিয়ে দেন। এতে আমার ডান হাতের নড়াচড়ায় স্বাভাবিকতা কিছুটা ফিরে আসে, আগের মতো কাঁধের জোড়া বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না। কিন্তু ডান হাতের পুরো ক্ষমতা আর ফিরে পাইনি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পুরনো সেই ব্যথা ক্ষণে ক্ষণেই চাড়া দিয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে ক্ষয়প্রাপ্ত পিনটি আমার ডান হাত ও কাঁধের সংযোগস্থলে তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। সিঙ্গাপুর ও লন্ডনের বিশেষজ্ঞদের মতে আমার ডান কাঁধের সংযোগ হাড়ের প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন। সে জন্য ২০০৫ সালে নিউইয়র্কের বিশ্বখ্যাত স্পেশাল সার্জারি হাসপাতালে অপারেশনের জন্য দিনক্ষণও স্থির করা হয়। কিন্তু দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শেষ পর্যন্ত সেখানে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এদিকে আবার ডান হাঁটুতে ক্ষত থাকায় সেখানে সাপোর্ট দিতে গিয়ে আমার বাম হাঁটুর ওপরেও বাড়তি চাপ পড়তে থাকে। যার ফলে আমার ভালো থাকা বাম হাঁটুও ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে এ সমস্ত ইনজুরি থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার স্বর্ণোজ্জ্বল চারটি বছরে কর্মব্যস্ত। একজন ছাত্রনেতা হিসেবে আমাকে একনিষ্ঠভাবে রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে হয়েছিল।
আমাকে বহনকারী পুরনো প্রিজন ভ্যানটির অবস্থা ছিল আসলেই করুণ। একবার থামার সময় ভ্যানটি বিকট শব্দে প্রচ- এক ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যেত, যার ফলে আমার গোটা শরীর ব্যথায় ভরে যেত, আবার চালু হওয়ার সময় একই রকম ঝাঁকুনি দিয়ে আরম্ভ হতো এর পথচলা। নিজের নিরাপদের জন্য আমাকে সোজা ও শক্তভাবে বসে থাকার চেষ্টা করতে হয়েছে। পুলিশম্যানরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় ভ্যানের প্রতিটি মুভমেন্টের সময়ে তারা একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়ছিল। এ সময় বাইরে বৃষ্টি শুরু হওয়ার সাথে সাথে ভ্যানের উপরের দিকের ঘুলঘুলির ভেতর দিয়ে বৃষ্টির পানি ছিটকে এসে আমার পরনের কাপড় ভিজিয়ে দিচ্ছিল। সেই অবস্থাতেও চুপ করে বসে থাকতে হলো। এ সময় বলা হলো যে, আমরা তখন নবাবপুর রোডের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। নবাবপুর হলো পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী অন্যতম প্রাণকেন্দ্র এবং সরাসরি দেওয়ানী ও ফৌজদারি নিম্নআদালত, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস এবং জেলা প্রশাসকের দফতরমুখী যাওয়ার প্রধান সড়ক।

ভ্যান থামালে আমার চোখের বাঁধন খুলে নেয়া হলো। দিনের ধাঁধানো আলো এবং কোর্টের চারদিকের পরিবেশের সঙ্গে চোখ দুটোকে অভ্যস্ত করতে সময় লাগলো কিছুক্ষণ। ইতিমধ্যে বিপুল সংখ্যক আইনজীবী আমাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য সেখানে সমবেত হয়েছে। পুলিশ প্রহরায় তাদের সঙ্গে আমাকে আদালত ভবনে নিয়ে যাওয়া হলো। এ সময় লোকজন চারদিক থেকে ছুটে এলো আমার দিকে। অনেকেই হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। অনেকে এসেছিল কেবলমাত্র আমার খানিকটা স্পর্শ পাওয়ার জন্য। অনেকে শুধু দূর থেকে আমাকে একনজর দেখার জন্য চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ আবার আমাকে লক্ষ্য করে ফুল বা ফুলের পাঁপড়ি ছুড়ে দিচ্ছিল। গত রাতের সেই মশার কামড় ও কুৎসিত যৌথবাহিনীর ব্যবহারের তুলনায় এ ছিল আমার জন্য মহামনোমুগ্ধকর এক দৃশ্য। একজন রাজনীতিবিদের জন্য এটা ছিল সবকিছু পাওয়ার এক তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি। এটা ছিল যে জনগণের জন্য আমাদের কর্ম ও সংগ্রাম সেই জনগণের মাঝখানে থাকার এক তীব্র আনন্দানুভূতি। আমি জানতাম না যে, আমাকে আজকে আদালতে আনা হবে বলে প্রচার মাধ্যম ইতিমধ্যেই খবর ছড়িয়ে দিয়েছিল।

জনাকীর্ণ আদালতের একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনের কাঠগড়ায় আমাকে দাঁড় করানো হলো। একজন আইনজীবী বাইরে থেকে ফিসফিস করে জানালো যে, গোয়েন্দা বাহিনীর লোকজনে চারদিক গিজগিজ করছে। আরো বললো যে, আমার জামিনের জন্য আবেদন জানানো হবে। আমি মৃদু হেসে তার দিকে মাথা দুলিয়ে আমার সম্মতি জানালাম। সে ছিল জুনিয়র একজন ব্যারিস্টার। বেশ কয়েক বছর ধরে আমার জন্য কাজ করছে। সে জানালো যে, কমপক্ষে ১০০ জন আইনজীবী আমার জামিনের জন্য ওকালতনামায় স্বাক্ষর দিয়েছে। আমি তাকে কোনোরকম গোলযোগ সৃষ্টি করতে নিষেধ করে বললাম যে, কেবলমাত্র সবচাইতে সিনিয়র আইনজীবী এককভাবে জামিনের আবেদন পেশ করবে এবং সবাই যেন একসঙ্গে কথা না বলে। আদালতকে কোনোভাবে বিব্রত করতে আমি বিশেষভাবে নিষেধ করে দিলাম।

তবে সবচেয়ে আগ্রহ ছিল আমার বিপক্ষে কী অভিযোগ আনা হয়েছে সে সম্পর্কে জানার। ওরা আমার কী পরিমাণে লুকানো টাকার খোঁজ পেয়েছে এবং আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কী কী অভিযোগ রয়েছে তা জানার জন্য আগ্রহ ছিল প্রবল। জিজ্ঞাসাবাদের সময় সওয়ালকারীরা বারবার বলছিল যে, রাজনীতিবিদেরা সবাই দুর্নীতিবাজ এবং দেশের জন্য তারা কিছুই করেনি। কথাগুলো প্রতিনিয়ত আমার কানে একরকম অনুরণন তুলছিল। সেই অপমানজনক কথাগুলো আমার ভেতরে ক্রমাগতভাবে যে ক্রোধের সঞ্চার ঘটাচ্ছিল তা থেকে কিছুতেই আমি নিজেকে মুক্ত করতে পারছিলাম না।

গত রাতে ইয়ং অফিসাররা আমার সাথে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিল, তা মনে হতেই আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনা হবে সে সম্পর্কে ভেবে একরকম নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু দেখা গেল নিয়মানুযায়ী পুলিশের একজন কোর্ট ইন্সপেক্টর আমার বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে আনীত অভিযোগসংবলিত এফআইআর পাঠ করে শুনিয়ে বললেন যে, আমি অননুমোদিতভাবে বিদেশ থেকে মদ চোরাচালান করে এনেছি, যা বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(খ) ধারাবলে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদ-। এতে কতিপয় আইনজীবী ও সাধারণ লোক নিজেদের মধ্যে ফিসফাস শুরু করলেন। কারো কারো মধ্যে তা হাসিরও উদ্রেক করলো। অভিযোগ শুনে কেউ কেউ মৃদু কণ্ঠে গলাখাকারি দিলেন। উপস্থিত সাংবাদিকরা এতে অনেকটা কৌতুকবোধ করলেন এবং ম্যাজিস্ট্রেট মাথা নিচু করে খুব মনোযোগ সহকারে কাগজপত্র পরীক্ষা করার ভান করলেন।

আমি সেদিন আরো জানলাম যে, একই দিনে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহ করা তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদপত্রগুলো বিরাট বড় বড় অক্ষরে হেডলাইন প্রকাশ করেছিল যে, আগের রাতে জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমি নাকি আমার বিশাল সম্পদের কথা স্বীকার করেছি। রাজনীতিবিদদের জনগণের চোখে খাটো করে তাদের চরিত্রহনন করার জন্য সামরিক কর্মকর্তাদের প্রায়ই এই কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে দেখা যায়। এর চাইতে বেশি বিস্ময়কর ব্যাপার হলো যে, সরকারপক্ষ আরো ৭ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করলে ম্যাজিস্ট্রেট অবনত মস্তকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলেন। অথচ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রিমান্ডের ক্ষেত্রে আগেই এরকম বাধ্যবাধকতামূলকভাবে পালনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল যে, কেবলমাত্র তদন্তকারী অফিসার একজন আইনজীবীর উপস্থিতিতে তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তদন্তের আগে ক্ষমতাপ্রাপ্ত একজন ডাক্তার কিংবা মেডিক্যাল বোর্ড অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবেন এবং তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের পরে এই ডাক্তার কিংবা মেডিক্যাল বোর্ড রিমান্ডের পর অভিযুক্তের শরীরে ইনজুরি হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখবেন। এই প্রেক্ষিতে জামিনের আবেদন করা হলে ম্যাজিস্ট্রেট তাৎক্ষণিকভাবে জামিনের আবেদন নাকচ করে দিয়ে বিক্ষুব্ধ এক কোর্টরুম পেছনে রেখে দ্রুত আদালত ত্যাগ করেন। জনগণ ও আইনজীবীরা ততক্ষণে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার অভিযোগ তুলে ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে শুরু করেন।

(চলবে...)

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর