× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১১) /সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য

বই থেকে নেয়া

স্টাফ রিপোর্টার
১ এপ্রিল ২০২১, বৃহস্পতিবার

ইতিমধ্যে সাংবাদিকরা তাড়াহুড়া করে যার যার ঘরে গিয়ে নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অপরদিকে একটি রুমে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার প্রতিনিধি সাইমন ড্রিং এবং এপি’র একজন ফটোগ্রাফারকে আমি বিছানার নিচে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করলাম। তারা চূড়ান্ত খবর না নিয়ে যেতে চাইছিলেন না। পরে আমরা জানতে পারি যে, এয়ারপোর্টে সমস্ত বিদেশি সাংবাদিককে চরমভাবে হেনস্তা করে। এমনকি তাদের জুতা, আন্ডারওয়্যার পর্যন্ত খুলে সার্চ করে নোট ফিল্মসমেত সবরকম তথ্য রেখে দেয়া হয় এবং জোর করে উঠিয়ে দেয়া হয় পাকিস্তানগামী একটি উড়োজাহাজে। সূর্য ওঠার ঘণ্টাখানেক আগে ছাইরঙের ঘন কুয়াশায় চারদিক যখন আবৃত, ঠিক সেই সময়ে হোটেল ছেড়ে চলে গেলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। করাচি পৌঁছেই তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আল্লাহ পাকিস্তানকে রক্ষা করেছেন।’ একই দিনে বৃটিশ হাইকমিশনে কূটনৈতিক আশ্রয়াধীনে থেকে সাইমন ড্রিং তার পাঠানো প্রথম মেসেজে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন যে, ‘পাকিস্তান শেষ হয়ে গেছে।’
পরদিন কারফিউ ২ ঘণ্টার জন্য তুলে নেয়ার পর সাইমনসহ আমরা তিনজন একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রাবাসের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিহত ৯ জন বিশিষ্ট অধ্যাপকের সারি দিয়ে শোয়ানো মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে শোকাভিভূত অবস্থায় ইতিহাসের বর্বরতম নরহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও বীভৎসতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে সবকিছু দেখলাম। দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী হত্যা, লুট, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী যথেচ্ছভাবে স্বাধীন এক জাতি হিসেবে বাঙালিদের আত্মপ্রকাশের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
২৭শে মার্চ বিকালের দিকে আমরা রেডিওতে মেজর জিয়ার কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করতে শুনি এবং এর পরপরই শুরু হয়ে যায় রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ। দু’দিন পর কারফিউ আরো শিথিল করা হলে আমার বাবা-মাকে না জানিয়ে, আইনব্যবসা পেছনে ফেলে আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাই স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন সৈনিক হিসেবে অংশ নিতে। অবিবাহিত থাকায় তখন আমার বাবা-মা ছাড়া তেমন পারিবারিক অন্য কোনো পিছুটানও ছিল না। আমার অন্তর থেকে আসা অনন্য এক তাগিদে একক সিদ্ধান্ত মতে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের একটি অংশ হতে আমাকে উজ্জীবিত করেছিল। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।
আমার সঙ্গী হলেন বিশিষ্ট কবি গোলাম মোস্তফার ছেলে সুবিখ্যাত শিল্পী মোস্তফা মনোয়ার। আমরা দুজনেই ভাবাবেগ তাড়িত অবস্থায়, ভয় ও অনিশ্চয়তার দোলায় উদ্বেলিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রহরাধীনে থাকা প্রকাশ্য জায়গাগুলো সন্তর্পণে এড়িয়ে যাত্রা শুরু করলাম। এটি ছিল আমাদের একটি দুঃসাহসিক যাত্রা। ছোট্ট একটা ব্যাগে যা কিছু সম্বল সঙ্গে নিয়ে আমরা কখনো ধানক্ষেতের আইলের ওপর দিয়ে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে, কখনো গ্রাম্য আধা বাঁধানো পথে, রিকশায় কিংবা অতি পুরাতন বাসে চড়ে অজানা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলাম। দূর থেকে মাঝে মাঝে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম মহাসড়কের ওপরে যানবাহনের সুদীর্ঘ লাইন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেখানে যানবাহন থামিয়ে তীব্র গালিগালাজ ও চিৎকার-চেঁচামেচি করে প্রতিটি আরোহী ও মালামাল তল্লাশির মাধ্যমে তাদের ‘শত্রুদের’ সন্ধান করছে।
আমরা রাত্রিযাপন করার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক গ্রামে এককালের জনপ্রিয় কলেজ শিক্ষক প্রফেসর নোমানের বাসায় ঢুকলাম। সারা দিন অভুক্ত থাকায় কোনো প্রকার সামাজিকতার অপেক্ষা না করে আমরা যখন তার দেয়া খাবারের ওপর দ্রুত হাত বাড়ালাম, প্রফেসর নোমান আমাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। তার চোখে তখনো সেই স্নেহপূর্ণ দৃষ্টি যা দিয়ে তিনি ক্লাসে লেকচার দেয়ার সময় প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে সম্মোহিত করতেন এবং সভ্যতার ক্রমবিকাশে যুক্তিবিদ্যার অবদান ব্যাখ্যা করতেন। সস্নেহে আমাদের বললেন, ‘তাহলে তোমরা কেবল বাঁশ ও লাঠি সম্বল করে শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অটোমেটিক চাইনিজ রাইফেলের মোকাবিলা করতে চাইছো, তাই না?’ আমি বললাম, ‘ভিয়েতনামীরা কিন্তু শক্তিশালী আমেরিকানদের বিরুদ্ধে তাই করেছে।’ মনে হলো, এই জবাবে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি বললেন, ‘এ ধরনের যুদ্ধ চালাতে গেলে তোমাদের জন্য দরকার হবে আশ্রয়স্থল, পর্যাপ্ত রসদের জোগান। সেগুলো তোমরা কোথায় পাবে? ঢাকার অবস্থা কী হয়েছে তা তো তোমরা দেখেছই।’
এ যুদ্ধ কেমন হবে বা যুদ্ধ আমাদের কোনদিকে নিয়ে যাবে, আসলে সে সম্পর্কে বাস্তব কোনো ধারণা তখনো আমাদের ছিল না। কিন্তু সেই গ্রামের অধিবাসীদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, তারা ইতিমধ্যেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতি নেয়ার কথা চিন্তা করে প্রথমে নিজেদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদের অনেকে ইতিমধ্যেই প্রফেসর সাহেবের বাড়ির বিশাল চত্বরে সমবেত হয়েছে। কিন্তু ‘তোমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কে?’ এ কথা জিজ্ঞেস করতেই সবাই সমস্বরে জবাব দিলো, ‘প্রফেসর নোমান।’ এতক্ষণে আমাদের কাছে পরিষ্কার হলো কেন প্রফেসর নোমান আমাদের আসল মনোভাব জানতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করছিলেন। পরদিন সকালে তার বাসা থেকে বের হয়ে ভারতীয় এলাকা ত্রিপুরার সীমান্তের দিকে যাত্রার প্রস্তুতি নিলে প্রফেসর নোমান সাজোরে হাত চেপে ধরে আমাদের জন্য শুভ কামনা করলেন। তার দু’চোখে দেখা দিয়েছে অশ্রু।
আমরা বললাম, আমরা দু’জনে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর মোকাবিলা করতে যাচ্ছি না। আমাদের সর্বপ্রথমে প্রয়োজন হলো একটি রেডিও স্টেশন যা থেকে আমরা জনগণকে জানাতে পারবো কোথায় কী হচ্ছে এবং কী তাদের করা উচিত। যুদ্ধে জেতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। এ জন্য শক্ত প্রচারযন্ত্র প্রয়োজন।
মোটা ও উঁচু সুদীর্ঘ গাছের সারি দিয়ে সাজানো এক চা বাগানের ভেতর দিয়ে তেলিয়াপাড়ায় পৌঁছার পর আমরা সবিস্ময়ে দেখতে পাই যে, সেখানে ইতিমধ্যেই এলাকার তরুণ ও যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য একটি সামরিক ছাউনি স্থাপন করা হয়েছে এবং সেখানে একটি গ্রুপকে শারীরিক কসরত ও আরেকটি গ্রুপকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। সেখানে মেজর খালেদ মোশাররফকে পেয়ে আমরা আরো স্বস্তিবোধ করি। এককালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই তুখোড় অফিসার এখন সেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন- অসম এক যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অচিরেই তার সঙ্গে এসে মিলিত হলেন মেজর নুরুল ইসলাম। পঞ্চাশের দশকে ইউনিভার্সিটিতে সমকালীন ছাত্র থাকায় এরা দুজনেই ছিলেন আমার পরম বন্ধু-স্থানীয়।
তাদের কাছ থেকে জানা গেল যে, সীমান্তের ওপারে ভারতীয় বাহিনীর কতিপয় অফিসার আমাদের যুদ্ধের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে আমাদের প্রাথমিক শঙ্কা দূর হলো। কারণ সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে যারা যুদ্ধ করবে, তাদের জন্য প্রাথমিক প্রয়োজন আশ্রয়স্থল ও রসদের নিশ্চয়তা। সেটি ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে বলে মনে হলো। সেখানে আমরা এটাও নিশ্চিত হলাম যে, পাকিস্তানি বাহিনী যদি সুদূর বেলুচিস্তান থেকে এখানে আসেও তাহলে গভীর অরণ্যঘেরা এই এলাকায় কেবল লাঠি ও বাঁশ সম্বল করেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা কঠিন নয়। জঙ্গলপূর্ণ এই এলাকায় তাদের আধুনিক মেশিনগানও অকার্যকর করে দেয়া সম্ভব। নদী-খাল-বিল-দীঘি-পুকুর-খানাখন্দ-ধানক্ষেত-পাটক্ষেত-ইক্ষুখেত, দুর্গম পার্বত্যাঞ্চল পরিবেষ্টিত উত্তরাংশ ও দক্ষিণাংশের ঘন ঝোপ দ্বারা আবৃত এ দেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের সঙ্গে এক লাখ সৈনিক কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধ করে কুলিয়ে উঠতে পারবে না।
যুদ্ধে যোগ দেয়ার পেছনে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের উত্তর, পশ্চিমাংশের জনগণের জন্য আমাদের একক নিয়ন্ত্রণাধীন ছোট একটা রেডিও স্টেশন স্থাপন করা। এ লক্ষ্যে আমরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় এসে পৌঁছাই। সেখানে দু’দিন অবস্থানের পর আমরা বুঝতে পারি যে, এ ধরনের অভিযানের ব্যাপারে আমাদের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও আমরা সেগুলো ব্যবহার করতে পারবো না। আমাদের দরকার হবে নিজস্ব রেডিও ইঞ্জিনিয়ার। কারণ, ত্রিপুরায়ও এ ধরনের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোকের ছিল তীব্র অভাব। এ ধরনের সমস্যার সামনা সামনি হওয়ার বিষয়টি আমরা আগে একবারও ভেবে দেখিনি। নিতান্তই হতাশ হয়ে আমরা দেখলাম যে, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল আমরাই প্রথমবারের মতো জনগণকে নিজেদের উদ্যোগে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আহ্বান জানাতে পারবো। কিন্তু দু’দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও আমাদের সে আশা পূরণ হয়নি। শেষ পর্যন্ত একজন রেডিও ইঞ্জিনিয়ার জোগাড় করার জন্য আমরা ঢাকায় ফিরে যেতে মনস্থ করলাম।

(চলবে...)

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৯) 
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১০)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর