× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৩) / ‘ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি মোটেই পছন্দ করেননি’

বই থেকে নেয়া

স্টাফ রিপোর্টার
৩ এপ্রিল ২০২১, শনিবার

এরপর ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল কোলকাতায় বসে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। ১৯৭০-৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পরদিন থেকে এই ঘোষণাপত্র কার্যকর করে। এই আইনগত আচ্ছাদনের ভিত্তিতে প্রবাসী সরকারের সদস্যরা ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের এক আম্রকাননে স্বাধীন দেশের সরকার হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। ঐতিহাসিক এই আম্রকাননেই ২০০ বছর আগে একদিন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করতে গিয়ে সংঘটিত হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধ। তখন পর্যন্ত আম্রকানন পাক বাহিনীর দখলমুক্ত ছিল। মেহেরপুরের তৎকালীন এসডিও পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য তৌফিক এলাহী চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে গোটা অনুষ্ঠানটি সংগঠিত করা হয় এবং এসডিপিও মাহবুব উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি গার্ড অব অনারের ব্যবস্থা করা হয়। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শেষ হবার সাথে সাথে নবগঠিত সরকার কোলকাতায় অবস্থিত থিয়েটার রোডে স্থানান্তরিত হয়। এই সরকার ভারতীয় সরকারের রসদ ও আশ্রয়ের পরিপূর্ণ সহযোগিতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এক সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে।
১৯৭১ সালের মে মাস নাগাদ মুক্তিযোদ্ধারা পুরোপুরি সংগঠিত হওয়ার পর পর্যন্ত পাকিস্তান বাহিনী খুব একটা প্রতিরোধ ছাড়াই রাজধানী ঢাকা ও বেশির ভাগ জেলা সদরে তাদের অবস্থান সুসংহত করতে সক্ষম হয়।
একই সময় গোটা বিশ্বের প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের এই সংগ্রামকে ভিয়েতনামের আদলে এক দীর্ঘ প্রলম্বিত যুদ্ধ হিসেবে ভবিষ্যদ্বাণী করা শুরু হলো। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বহির্বিশ্বের সাহায্য ও সহায়তা অর্জনের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হলো। ইতিমধ্যে ছোট একটি টিম তৈরি করে আমি স্ব-উদ্যোগে  কোলকাতার ৯ নম্বর সার্কাস এভিনিউতে পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব হোসেন আলীর অফিসে সরকারের জন্য বহিঃপ্রচারণা বিভাগ স্থাপন করি। সেখানে একটি সেল গঠন করে বিভিন্ন ইস্যুর উপর গবেষণা, বিদেশি সংবাদ ও প্রচার মাধ্যমকে ব্রিফিং দান, প্রচারণা পুস্তক প্রস্তুত ও বিলিকরণ, গুরুত্বপূর্ণ পজিশন পেপার তৈরি করে তাজউদ্দীন আহমদের সরকারকে সাহায্য করতে থাকি।
সময়টা ছিল সর্বাংশে রোমাঞ্চকর ও উত্তেজনাপূর্ণ। এ সময় আমরা যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক বুলেটিন প্রকাশ করতে থাকি ও সারা বিশ্বে সেটি প্রচারণার ব্যবস্থা করি। এর সাথে সাথে ভারত সরকারের সহযোগিতায় স্থাপিত ‘বাংলাদেশ বেতার’-এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের খবর গোটা দেশে যে প্রচার শুরু হয় তাতে ছদ্মনামে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন প্রতিবেদন উপস্থাপন করি এবং সাংবাদিকদের জন্য ডেইলি ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা করি। এভাবে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা আমার দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে।
সংবাদ মাধ্যমে আমাদের যুদ্ধাবস্থা প্রচারের স্বার্থে সে সময় আমি পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর প্রভাবমুক্ত এলাকাসমূহে প্রবেশ করার জন্য বেশ কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ গড়ে তুলি। অবশ্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি মোটেই পছন্দ করেননি। এ ধরনের যোগাযোগের ভিত্তিতে বিশ্বে সর্বাধিক প্রচারিত প্রতিদিন দুই কোটি প্রচার সংখ্যার ডেইলি মিরর পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার হেডলাইনে প্রখ্যাত সাংবাদিক জন পিলজার ‘ডেথ অব এ নেশন’ নামে চাঞ্চল্যকর এক সংবাদ প্রকাশ করেন। আমার মনে আছে, অন্যান্যের মধ্যে আমি গোটা বিশ্বের অসংখ্য শ্রোতানন্দিত বিবিসি’র এক ঘণ্টাব্যাপী ‘প্যানোরামা’ অনুষ্ঠানের প্রযোজক মাইকেল চার্লটনের সঙ্গে আমাদের দেশের সীমানার ভেতর থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে বসে দেশের মুক্তির পরিস্থিতির উপর একঘণ্টাব্যাপী দীর্ঘ সচিত্র প্রতিবেদন দেওয়ার আয়োজন করি। এই প্রতিবেদন বিবিসিতে সম্প্রচারিত হওয়ার পর সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। একই ধরনের রিপোর্টিংয়ের জন্য গার্ডিয়ান পত্রিকার মার্টিন উলাকট, নিউজউইক ম্যাগাজিনের লরেন জেনকিনস ও টনি ক্লিফটন এবং টাইম ম্যাগাজিনের আন্দ্রে ডি বরচগ্রেভসহ আরো অনেকজনের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি। যুদ্ধের গোটা সময়ে আমি প্রায় আড়াই শ’ সাংবাদিককে ব্রিফ করেছি, পার্টি বহির্ভূত স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মাসিক ৩০০ রুপি ভাতার উপর সম্বল করে একটা শার্ট, একজোড়া প্যান্ট প্রতিসপ্তাহে একবার হাতে ধুয়ে পরিধান করে একটা সোফার ওপর রাতে ঘুমিয়ে অনবরত কাজ করে গেছি।
মে মাসের শেষ নাগাদ প্রায় এক কোটি শরণার্থী জীবননাশের আশঙ্কায় এবং পাক বাহিনীর অত্যাচার, লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় সীমান্তের লাগোয়া ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্যাম্পগুলো ছিল কোলকাতা এবং তার আশপাশের এলাকায়। এ সময় মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি কোলকাতার সল্টলেক এলাকাসহ বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করলে তা সপ্তাহজুড়ে বিশ্বব্যাপী প্রচারলাভ করে এবং স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহে এক বিশাল ভূমিকা রাখে। কিন্তু এরপরেও বাংলাদেশের যুদ্ধাবস্থা সংক্রান্ত সংবাদ প্রচারণা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছিল। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দিল্লিতে অবস্থানরত দি টাইমস পত্রিকার বিখ্যাত সংবাদদাতা পিটার হ্যাজেলহাস্টকে আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে লেখার জন্য টেলিফোনে অনুরোধ জানালে পিটার বলেছিল, “আমি সেটা পারবো না। এ নিয়ে নতুন কিছু লেখার নেই এবং এ যুদ্ধ চলতেই থাকবে।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বিশ্ব-প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশকে জীবিত রাখার জন্য এ মুহূর্তে কী করা যেতে পারে?” পিটার বললো, “এ বিষয়ে রিপোর্ট করার জন্য আমি আমার এডিটরকে কেবলমাত্র তখনই রাজি করাতে পারবো যখন তুমি তোমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সাথে আমার একটা ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। তুমি দাবি করছো তাঁর নেতৃত্বে বাঙালিরা যুদ্ধ করছে। আমরা তার প্রমাণ চাই।” এই বলে পিটার ফোন রেখে দিলো।
তাজউদ্দীন তখন কোলকাতার থিয়েটার রোডে বসে সরকার পরিচালনা করছিলেন। আমরা সরকারিভাবে স্বীকার না করলেও বাংলাদেশের চারদিকে তখন পুরোপুরি যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল। আমি তাজউদ্দীনের মুখ্য সহকারী ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলামকে ফোন করার সাথে সাথে তিনি এর গুরুত্ব বুঝতে পারলেন এবং আমরা একটা ইন্টারভিউয়ের আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরদিনই আমি পিটারকে ফোন করে বললাম যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছেন। ‘চমৎকার’ বলে পিটার সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রস্তুতিতে লেগে গেল। লন্ডনে তার পত্রিকার সম্পাদকের অনুমতিও পেয়ে গেল।
পিটার যখন জুন মাসের শেষ সপ্তাহে কোলকাতা এসে পৌঁছলো তখন বর্ষার মৌসুম এসে গেছে। আগের ব্যবস্থা অনুযায়ী আমির-উল ইসলাম তাজউদ্দীনকে ভোরবেলায় কোলকাতা থেকে রওনা দিলেন সীমান্তের দিকে। মেহেরপুরে একটি জায়গায় এসে তারা থামলেন। কারণ, এই জায়গাটি তখনও পাক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। একঘণ্টা পর আমি ও পিটার সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তাজউদ্দীনের অপেক্ষায় আমরা পূর্ব-নির্ধারিত একটা মাটির ঘরে অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় দূরে ঘন একটা আমবাগানের ভেতর থেকে এক হাতে আটোমেটিক রাইফেল, পায়ে বুট, মাথায় হেলমেট ও মিলিটারি পোশাকসজ্জিত তাজউদ্দীন আহমেদকে হেঁটে আমাদের দিকে আসতে দেখা গেল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন দখলদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত একজন গেরিলা সৈনিক। স্বভাবসুলভ মুচকি হেসে তাজউদ্দীন পিটারকে অভ্যর্থনা জানালেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল দৃঢ়চেতা এবং যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে পুরোপুরিভাবে আস্থাবান ও তেজস্বী একজন ব্যক্তিত্ব। ঘরের শেডের নিচে রাখা একটা টুলে বসে তারা কথা বললেন এবং আমরা দু’জন বাইরে দাঁড়িয়ে চারপাশ চোখের নজরে রাখছিলাম। সাক্ষাৎকার চললো প্রায় ৪০ মিনিট ধরে। এক পর্যায়ে দূর থেকে কামানের গর্জন ভেসে আসার পর তৎক্ষণাৎ পিটারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুতপায়ে যেদিক থেকে শব্দ ভেসে আসছিল সেদিকেই তাজউদ্দীন রওনা হয়ে গেলেন। তিনি এমন একটা ভাবভঙ্গি দেখালেন যে, অনতিবিলম্বে তাকে তার যুদ্ধরত বাহিনীর কাছে ফিরে যেতে হবে। পরদিন লন্ডনের দি টাইমস পত্রিকায় তিন কলামে এই সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়। তাতে ছিল গেরিলা সাজে রাইফেল হাতে তাজউদ্দীনের একটি ছবি এবং খবরের শিরোনাম ছিল ‘বাঙালিরা যুদ্ধজয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একপর্যায়ে আমি আমেরিকার টাইম ম্যাগাজিনের সিনিয়র এডিটর সুবিখ্যাত আন্দ্রে ডি বরচ গ্রেভের জন্য একই ধরনের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছিলাম। সেটার আয়োজন অবশ্য করা হয়েছিল কোলকাতায়।

(চলবে.. )

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৯) 
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১২)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর