× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৪) /‘আমি গোটা বিশ্বকে নাড়া দিতে যাচ্ছি’

বই থেকে নেয়া

স্টাফ রিপোর্টার
৪ এপ্রিল ২০২১, রবিবার

জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ পিটার কোলকাতায় অবস্থান করে যুদ্ধের উপর অন্যান্য বিষয়াদি, বিশেষ করে যুদ্ধের সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ততা নিয়ে কাজ করছিল। কোলকাতায় তখন ঘনবর্ষা। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ও পানির ঢলেতে চারদিক তখন একাকার। হাজার হাজার শরণার্থীর জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্যোগ। এমনি এক সন্ধ্যায় পিটার আমাকে কোলকাতার কাছে সল্টলেকের কাছাকাছি কোনো এক শরণার্থী শিবির থেকে ফোন করলো। ইংরেজিতে বললো, “I am going to shake the world- মওদুদ, আমি গোটা বিশ্বকে নাড়া দিতে যাচ্ছি।” “কী ঘটলো আবার?” জিজ্ঞেস করলাম। “তুমি জানো না এই শরণার্থী শিবিরে কী ঘটছে! দুগ্ধপোষ্য শিশুরা ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় যন্ত্রণাকাতর, ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলা পানিতে ভেসে যাচ্ছে শিশুরা, গৃহবধূরা বৃষ্টির ঠাণ্ডা পানিতে হি হি করে কাঁপছে। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের দুর্দশাই এখন চরমে।
খাবার নেই, পানি নেই, চিকিৎসার জন্য ওষুধ নেই, স্বাস্থ্যসেবা, পয়ঃনিষ্কাশন কোনো কিছুরই নাম নিশানা নেই। সবকিছু মনে হচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সব ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। হাজার হাজার মানুষ এখন মারা যাওয়ার পথে। আমার রিপোর্টে আমি বিশ্ব মানবতার কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি।” আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে, আবেগ-উত্তেজনায় পিটার রীতিমতো কাঁদছে। আমার দু’চোখেও তখন পানি এসে গেছে।
আমার আবার এই ভেবে ভালো লাগছিল যে, বাংলাদেশের খবর আবার পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে যাচ্ছে। পাকিস্তান বাহিনীকেই বাংলাদেশের জনগণের এই দুর্গতির পূর্ণ দায়ভার বহন করতে হবে। ভারতের একার পক্ষে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা অসম্ভব, এর জন্য প্রয়োজন হবে বিশ্ব সাহায্যের। দুর্গত এই মানবতার অবসান ঘটাতে গেলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আশু পরিণতি ঘটাতে হবে। এদিকে একই বৃষ্টি ও বন্যার সূত্র ধরে ততদিনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোটা পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর জওয়ান ও অফিসাররা তাদের গোটা জীবনে কোনোদিন এ ধরনের বৃষ্টি ও বন্যার মুখোমুখি হয়নি। ফলে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তারা ছাউনিতে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা চোরাগোপ্তা আঘাত এবং প্রত্যাঘাতের মাধ্যমে পাক বাহিনীকে পথে-প্রান্তরে, খালে-বিলে নাস্তানাবুদ করে তাদের শক্তি ও আক্রমণের ধার কমিয়ে দেয় ও একপর্যায়ে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে নেয়। ভরা মৌসুমে বাড়তি পানির চাপ পাক বাহিনীকে একেবারে নাজেহাল করে দেয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আরো উদ্বুদ্ধ করে তোলে। পুরো বর্ষা নামলে মুক্তিযোদ্ধারা সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। আগস্ট মাসের শেষ নাগাদ পাক বাহিনী তাদের ছাউনীতে আরো একঘরে হয়ে পড়ে এবং মোটামুটিভাবে পাকা বাঁধানো সড়কগুলো ছাড়া অন্য কোথাও তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এই সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা গোটা বাংলাদেশের বাদবাকি স্থানগুলোতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে নেয়।
পিটার হ্যাইজেলহার্স্টের প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে কোলকাতা শহরে গোটা বিশ্বের সাংবাদিকরা এসে ভিড় জমাতে থাকেন। সঙ্গত কারণেই শরণার্থী অবস্থা রিপোর্ট করতে আসা সাংবাদিকদের আমি বোঝানোর চেষ্টা করি যে, তারা যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সে অনুযায়ী আমাদের যুদ্ধ একটি দীর্ঘ প্রলম্বিত যুদ্ধের আকার নিচ্ছে না, বরং অল্প সময়ের মধ্যেই এ যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করবে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কতিপয় শক্তিশালী দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও ততদিনে বিশ্বজনমত নিরঙ্কুশভাবে বাংলাদেশের পক্ষে চলে আসে । নিউ ইয়র্ক টাইমস এর সিডনি শ্যানবার্গ ইতিমধ্যেই ভিয়েতনামের অবস্থা সম্পর্কে তার লেখার উপর ভিত্তি করে নির্মিত “দি কিলিং ফিল্ডস’- ছবির জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এবার তিনি ভাবাবেগতাড়িতভাবে জড়িয়ে পড়লেন বাংলাদেশের ঘটনাবলীর সঙ্গে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এই দুই মহান সাংবাদিকের সঙ্গে ছিলেন মার্টিন উলাকট, সাইমন ড্রিং, পিটার গিল, লরেন জেনকিন্স, জন পিলজার, টনি ক্লিফটন ও আরো কয়েকজন। তাঁরা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর অব্যাহতভাবে সমর্থন দান করে গেছেন। এমনকি দিল্লি থেকে আসা পি হ্যাইজেলহার্স্ট অনেক দিন অবধি দিল্লি ফিরে যাননি।
এ সময়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতির আন্তর্জাতিকীকরণ পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং নিজেদের সীমানার ভেতরে অবস্থান করে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত এক সরকারের মানমর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশি জনগণের ব্যবহারের জন্য ইংল্যান্ড থেকে ডাকটিকেট ছাপিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৃটিশ লেবার পার্টির একজন সাবেক মন্ত্রী ও পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউস এস ক্রিস্টিয়ান এইড ও অক্সফামের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশ্বখ্যাত সমাজকর্মী ডনাল্ড চেসওয়ার্থ এ কাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
এটি ছিল একটি অবিস্মরণীয় দিন। সারা রাত অঝোর ধারায় বৃষ্টির পর সেদিন এসেছে উজ্জ্বল রৌদ্রস্নাত এক সকাল। ছনপাতার ছাউনী দিয়ে এক সপ্তাহ আগে থেকেই তৈরি করে রাখা হয়েছে একটি মাটির ঘর। ঘরটির ওপর মৃদুমন্দ বাতাসে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ঘরটির একটি পরিচিতিমূলক সাইনবোর্ড যাতে লেখা রয়েছে, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগ, কেশবপুর শাখা।” সাইনবোর্ডটির নিচে বাঁশের বেড়া দিয়ে স্থাপিত হয়েছে নয়া গণপ্রজাতন্ত্রের সর্বপ্রথম ডাকঘর। অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে এই ডাকঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। দু’জন বিশিষ্ট অতিথি লাল রঙের ফিতা কেটে এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। কয়েকশ’ মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের স্লোগান, হর্ষনিনাদ ও করতালিতে সহসাই চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। চারদিকে ঝলসে ওঠে অসংখ্য সাংবাদিকের ক্যামেরার ফ্লাশ। চারপাশে সমবেত জনতা আবালবৃদ্ধবনিতা-যুব-কিশোরের চোখে ছিল প্রত্যাশার দ্যুতি, বুকে ছিল অদম্য সাহস ও মনে ছিল সকল প্রতিকূলতাকে জয় করার গভীর স্পৃহা। এর মধ্যে কৃত্রিমতার কোনো অবকাশ ছিল না। বিভিন্ন আকার ও মুদ্রামানের আটটি সুদৃশ্য ডাকটিকেট ছাপানো হয়েছিল। ডাকটিকেটের মধ্যে সবচেয়ে দর্শনীয় বিষয় ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। সুন্দরভাবে সিল মেরে ও গালাবদ্ধ করে স্ট্যাম্পগুলো সাজানো হয় টেবিলে যার একপাশে বসানো হয় আমাকে। দেশি-বিদেশি উপস্থিত সকলের বক্তৃতায় আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে ভূষিত করা হয় স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম পোস্টমাস্টার জেনারেল হিসেবে। কোনো সরকারি আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বাংলাদেশের ডাক বিভাগে আজ অবধি প্রথম পোস্টমাস্টার জেনারেল হিসেবে আমার নামই চলে আসছে। যাই হোক, সেদিন অনুষ্ঠান শেষে খামের ভেতর বাংলাদেশ সংক্রান্ত খবর, তথ্য, প্রচার সামগ্রী ভরে দিয়ে তার উপর সেই সব ডাকটিকেট লাগিয়ে আমি ডাকের মাধ্যমে তা গোটা দুনিয়ায় প্রচার করার ব্যবস্থা গ্রহণ করি।

(চলবে..)

আরো পড়ুন-
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৯) 
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৩)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর