দেশে করোনা শনাক্ত ও মৃত্যু বেড়েই চলছে। প্রতিদিনই করোনায় শনাক্তে ও মৃত্যুতে রেকর্ড হচ্ছে। যা গত পহেলা মার্চ থেকে ফের করোনার ঊর্ধ্বমুখী আচরণে দেখা যাচ্ছে। একদিনের রেকর্ড পরের দিনই ভেঙে যাচ্ছে। হাসপাতালে রোগীর জায়গা হচ্ছে না। আইসিইউ পেতে স্বজনরা হাহাকার করছেন। দেশে গত এক সপ্তাহে করোনায় প্রাণহানি হয়েছে ৪০১ জনের। এই সময়ে শনাক্ত হয়েছেন প্রায় ৪৮ হাজার মানুষ।
পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে গত শনিবার ৫৭ জন করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছিলেন। তাদের ২৮ জনেরই করোনা পজিটিভ আসে। অর্থাৎ নমুনা দেয়াদের প্রায় ৫০ শতাংশ করোনা আক্রান্ত ।
করোনায় গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৬২৬ জন, যা একদিনে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। এ সময়ে মারা গেছেন ৬৩ জন। এর আগে মঙ্গলবার সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হয়। এদিন ৬৬ জনের মৃত্যুর খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর আগে গত বছরের ৩০শে জুন সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল ৬৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরের সব রেকর্ড ভেঙে গত ২৯শে মার্চ করোনা শনাক্ত হন ৫ হাজার ১৮১ জন। ১লা এপ্রিল শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৬৯ জন। ২রা এপ্রিল আবারও আগের রেকর্ড ভেঙে শনাক্ত দাঁড়ায় ৬ হাজার ৮৩০ জনে। এরপর ৪ঠা এপ্রিল একদিনে শনাক্ত দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮৭ জন। মঙ্গলবার আগের রেকর্ড ভেঙে শনাক্ত হয় ৭ হাজার ২১৩ জন। এরপর গতকাল দেশের ইতিহাসে আবার সর্বোচ্চ শনাক্ত পাওয়া গেল। দেশে সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত শনাক্ত ৬ লাখ ৫৯ হাজার ২৭৮ জন। এ পর্যন্ত মোট মৃত্যু ৯ হাজার ৪৪৭ জন। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৩ হাজার ২৫৬ জন। এখন পর্যন্ত সুস্থ ৫ লাখ ৬১ হাজার ৬৩৯ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয় ৩৪ হাজার ৬৬৮টি, অ্যান্টিজেন টেস্টসহ নমুনা পরীক্ষা করা হয় ৩৪ হাজার ৬৩০টি। এখন পর্যন্ত ৪৮ লাখ ৮২ হাজার ৫৬৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। শনাক্ত বিবেচনায় গত ২৪ ঘণ্টায় ২২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ এবং এখন পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৫ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং মারা গেছেন ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ৩৯ জন পুরুষ এবং নারী ২৪ জন। এখন পর্যন্ত পুরুষ ৭ হাজার ৮২ জন এবং নারী মৃত্যুবরণ করেছেন ২ হাজার ৩৬৫ জন। বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬০ বছরের উপরে ৪০ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ১২ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ৫ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ২ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৩ জন এবং ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে রয়েছেন ১ জন। বিভাগ বিশ্লেষণে দেখা যায়, মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে মারা গেছেন ৪১ জন, চট্টগ্রামে ১০ জন, রাজশাহীতে ৪ জন, খুলনায় ২ জন, বরিশালে ১ জন, ময়মনসিংহে ২ জন এবং সিলেটে ৩ জন। ২৪ ঘণ্টায় ৬৩ জনই হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন।
করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না: গতকাল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, করোনার সুনামি পৃথিবীকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। আর এটা কেবল স্বাস্থ্য সেক্টরেই না, অর্থনীতি, খাদ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা সব ক্ষেত্রেই। পৃথিবীর সব দেশের সব ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়েছে। আমরা করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করছি। হাসপাতাল বেড়েছে, আইসিইউ বেড়েছে, চিকিৎসা সম্পর্কে এখন জানা গেছে। করোনার নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বেড়েছে। দেশে টিকাদান কার্যক্রম চলছে। এরপরও করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না। করোনা রোগীর চাপের কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। চিকিৎসকরা ছুটি পাচ্ছেন না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে সামনে হাসপাতালে রোগীদের জায়গা দেয়া সম্ভব হবে না। জাহিদ মালেক বলেন, করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে ক্যান্সার, কিডনি, স্ট্রোকের রোগীসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগীদের চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে, তাদের চিকিৎসা দিতে পারছি না। তিনি বলেন, করোনায় সংক্রমণের হার কমিয়ে আনা গিয়েছিল। কিন্তু মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানেনি, টিকা নিয়ে উদাসীনতা দেখিয়েছে। দলবেঁধে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়েছে। বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মাস্ক ছাড়া, সামাজিক দূরত্ব না মেনে জড়ো হয়েছে। এসব কারণে এখন সংক্রমণের হার অনেক বেশি বেড়ে গেছে।
মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানেনি, আর তাই সরকারকে লকডাউন দিতে হয়েছে। একইসঙ্গে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। এখন লকডাউন চলছে। মানুষকে এখন ১৮ দফা নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য, অর্থনীতির জন্য সাধারণ মানুষকে সবকিছু ভেবে কাজ করতে হবে।
আজ থেকে টিকার দ্বিতীয় ডোজ শুরু: করোনার টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়া শুরু হচ্ছে আজ ৮ই এপ্রিল বৃহস্পতিবার থেকে। যারা প্রথম ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা নিয়েছেন তাদের দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হবে। পাশাপাশি প্রথম ডোজও চলবে। এদিকে, দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেয়ার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় বলা হয়- (১) প্রধম ডোজের টিকা নিয়ে থাকলে আট সপ্তাহ পর মোবাইলে এসএমএস পেলে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে গিয়ে দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিতে টিকা কার্ডসহ চলে আসুন। (২) কোনো কারণে মোবাইলে এসএমএস না পেলেও আট সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার পর নির্দিষ্ট কেন্দ্রে গিয়ে দ্বিতীয় ডোজের টিকা গ্রহণ করা যাবে। (৩) যারা ২৭ থেকে ২৮শে জানুয়ারি ও ৭ থেকে ৮ই ফেব্রুয়ারি প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন, তার কোনো এসএমএস না পেলেও নির্ধারিত টিকা কেন্দ্রে টিকার কার্ডসহ ৮ই এপ্রিল দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিতে চলে আসুন। (৪) একইসঙ্গে প্রথম ডোজ টিকা দেয়া চলমান রয়েছে। তাই প্রথম ডোজ টিকা নিতে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করুন, আপনার নির্ধারিত দিনে নির্ধারিত কেন্দ্রে টিকা নিন।
এদিকে, সারা দেশে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরুর ৪৯তম দিনে ভ্যাকসিন নিয়েছেন ১৩ হাজার ২৮ জন। এর মধ্যে ঢাকায় নিয়েছেন ২ হাজার ৯৬৭ জন। এ পর্যন্ত দেশে মোট টিকা নিয়েছেন ৫৫ লাখ ৬৮ হাজার ৭০৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩৪ লাখ ৫৩ হাজার ২৯১ জন এবং নারী ২১ লাখ ১৫ হাজার ৪১২ জন। টিকা নেয়ার পর সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে মোট ৯৩৯ জনের। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত টিকা নিতে অনলাইনে মোট নিবন্ধন করেছেন ৬৯ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩৯ জন। গত ২৭শে জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে গণ টিকাদান শুরু হয় ৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে।