× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

এফ-কমার্স: বাংলাদেশের ফেসবুক-ভিত্তিক অর্থনীতি

বিশ্বজমিন

মানবজমিন ডেস্ক
(৩ বছর আগে) এপ্রিল ১২, ২০২১, সোমবার, ৮:০৫ অপরাহ্ন

গত বছরের এপ্রিলে, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ মোকাবিলায় জারি হওয়া লকডাউনের মধ্যে একটি টিয়া পাখি কেনার সিদ্ধান্ত নেন আহমেদ ইমরান কবির। তিনি ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। লকডাউনের কারণে ক্লাস বাতিল হয়ে যায় বা অনলাইনে শিফট হয়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজের পাখি পালার শখ পূরণ করতে নেমে যান তিনি।

কবির তার প্রথম পাখির জোড়া কেনেন ৩০০০ সদস্যের একটি ফেসবুক গ্রুপ 'এ.এস. ককটেল পাখি হাত বদল' থেকে। বিক্রয়কারী ব্যক্তিগতভাবে পাখিগুলো কবিরের কাছে পৌছে দিয়ে যান। তাকে নগদে অর্থ পরিশোধ করেন কবির। পাখি কিনে তিনি এতই খুশি হয়েছিলেন যে, পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনি নানান প্রজাতির আরো ২৪ জোড়া পাখি কেনেন। এই কেনা-বেচার পুরো প্রক্রিয়াই সম্পন্ন হয়েছে ফেসবুকের মাধ্যমে।

কবিরের এই পাখি কেনার গল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের বেশিরভাগ ব্যবসা কিভাবে সম্পন্ন হয় তার প্রতিফলন দেখা যায়।

দেশটিতে অ্যামাজনের মতো বড় প্ল্যাটফর্মগুলোর অনুপস্থিতিতে হাজার হাজার ফেসবুক পেজ ও গ্রুপের মাধ্যমে চলছে অনলাইন ব্যবসা। এর পরিমাণ এত বেশি যে, ফেসবুক-ভিত্তিক স্টোরের সংখ্যা স্থানীয় ই-কমার্স সাইট আজকেরডিল, ইভ্যালি বা দারাজের মতো ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত বিক্রেতার সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশে ফেসবুকে এমন ব্যবসার সংখ্যা কত তার কোনো নির্দিষ্ট হিসাব নেই। তবে ধারণা করা হয়, তা ৩ লাখ ছাড়িয়েছে। কেবল ইন্টারনেট সংযোগ ও ব্যবসা শুরুর জন্য ৩৫০ ডলারের মতো পুঁজি থাকলেই ফেসবুকে ব্যবসা খুলতে পারেন যেকোনো উদ্যোক্তা। দেশের ক্রমবর্ধমান কর্মসংস্থান ঘাটতির মধ্যে তরুণ প্রজন্মের জন্য এটি এক বিশাল সুযোগ। একইসঙ্গে নারী ক্ষমতায়নেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে ফেসবুক ভিত্তিক অনলাইন ব্যবসা। দেশে প্ল্যাটফর্মটির অর্ধেক ব্যবসায়ীই নারী।

মোটাদাগে ফেসবুক স্টোরগুলো 'ক্লিক-অ্যান্ড-অর্ডার' শপিংয়ের সম্মুখ সারিতে চলে এসেছে। আনুষ্ঠানিক মার্কেটপ্লেসের মতো প্ল্যাটফর্মটিতে পরিচালিত বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই লাইসেন্স নেই। তাদের পণ্য মজুদ রাখা হয় বাড়িতে। আর সেগুলো ভোক্তাদের কাছে সরবরাহ করে তৃতীয় কোনো লজিস্টিক কোম্পানি। পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ সহজ। কোনো ক্রেতা স্টোরগুলো থেকে পণ্য নির্বাচন করেন। অর্থ অনলাইন বা অফলাইন পদ্ধতিতে পরিশোধ করা হয়। পণ্যটি ক্রেতার কাছে সরবরাহ করা হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে ফেসবুকের এমন প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশে সমালোচনার হার পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় অত্যন্ত কম। দরিদ্রতা ও কর্মসংস্থান ঘাটতিতে ভোগা ১৬ কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশটিতে নতুন এই ব্যবসার মডেল বেশ কার্যকর হিসেবে দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে বিশেষ নামে পরিচিতিও পেয়েছে ফেসবুক ভিত্তিক এই ব্যবসা প্রক্রিয়া: এফ-কমার্স।

গত ছয় বছর ধরে ফেসবুকে ব্যবসা করছেন নুজহাত আকতার। ইতিমধ্যে প্ল্যাটফর্মটিতে ঝানু ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তার। তার সাইট 'পশ ওয়ার্ল্ড'-এর ৮ হাজার অনুসারী রয়েছে ফেসবুকে। বাংলাদেশে বসে বাইরের দেশ থেকে নানা ধরণের পণ্য—হেলমেট, হ্যান্ডব্যাগ, রালফ লরেন ব্র্যান্ডের শার্ট, গাড়ির পার্টস— এনে বিক্রি করে থাকেন তিনি। ক্রেতারা চাইলে তার সাইটে নেই এমন পণ্য এনে দিতেও অনুরোধ করতে পারেন তার কাছে। সাধারণত দুই সপ্তাহের মধ্যেই পণ্য সরবরাহ করে থাকেন আকতার।

৩৪ বছর বয়সী আকতারের সকাল কাটে দ্য বডি শপ, সুপারড্রাগ, ক্লার্কস ও অন্যান্য জনপ্রিয় বৃটিশ ওয়েবসাইটগুলো ঘেটে দেখে। সাইটগুলোয় ফ্ল্যাশ-সেল বা ডিসকাউন্ট খুঁজে বেড়ান তিনি। পছন্দসই অফার পেয়ে গেলে সেটির লিংক তার ফেসবুক গ্রুপে শেয়ার করেন। সেখান থেকে আগ্রহী ক্রেতারা তার কাছে পণ্যটি অর্ডার করে থাকেন। গত জুনে এক মাসে ৬৭ হাজার টাকার বেশি অর্ডার পেয়েছেন তিনি।

হাজারো বাংলাদেশিরা আকতারের ওপর বিদেশি পণ্য এনে দিতে নির্ভর করার অন্যতম কারণ হচ্ছে, তার কাছে একটি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড আছে। তার ভাষায়, এটি আমার গোপন হাতিয়ার।

অর্থ পাচার ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকার প্রায় ১৫ লাখ ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করেছে। যদিও সেগুলো ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ ডলার সমমূল্যের পণ্য কেনা যায় এক মাসে।

বিশ্বজুড়ে অনলাইন ব্যবসায়ীদের মধ্যে সাম্প্রতিক জনপ্রিয় ট্রেন্ড হচ্ছে লাইভস্ট্রিমিং বা ফেসবুক লাইভে পণ্য প্রদর্শন। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো অপশনটি চালু করছে। তবে ওই দেশগুলোয় এখন অবধি আশানুরূপ সফলতা পায়নি লাইভস্ট্রিমিং। কিন্তু বাংলাদেশে পরিস্থিতি ভিন্ন।

আকতার বলেন, মানুষজন ত্বক সাদা করার ক্রিমের জন্য পাগল প্রায়। এসব ক্রিমের কোনো লাইভ ডেমো দেখে থাকেন এক থেকে দুই হাজারের বেশি মানুষ।

ঢাকা-ভিত্তিক সিম্বল ফ্যাশন হাউজের মালিক সোলাইমান লকডাউনের মধ্যে নিজের বাড়িতে বসে শাড়িসহ বিভিন্ন পোশাকজাত পণ্য লাইভস্ট্রিমিং করে থাকেন। ক্রেতাদের কোনো পণ্য পছন্দ হলে সেটির স্ক্রিনশট পাঠাতে বলেন। সুলাইমান জানান, তিনি ফেসবুক লাইভে পণ্য প্রদর্শন শুরু করেন মাত্র ছয় মাস আগে। এরপর থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৩ লাখ ৮০ হাজারের বেশি টাকার অর্ডার পেয়ে আসছেন তিনি।

বাংলাদেশে এফ-কমার্সের উত্থানের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে ব্যবসাগুলো সামাল দেয়ার মতো কোনো বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের অনুপস্থিতি।  ফেসবুক ভিত্তিক ব্যবসার এই মডেল কেবল বাংলাদেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও দেখা যায়। থাইল্যান্ডের মোট অনলাইন ব্যবসার প্রায় অর্ধেকই সম্পন্ন হয় ফেসবুকের মাধ্যমে। সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের জন্য অনুকূল ফিচার যোগ করেছে ফেসবুক। তাদের নিজস্ব পেজ পছন্দ অনুসারে সাজানোর সুযোগ করে দিয়েছে। সহজ করেছে অর্থ পরিশোধের প্রক্রিয়াও।

বাংলাদেশে এফ-কমার্সের উত্থানের পেছনে ভূমিকা রেখেছে আরো কিছু বিষয়। অনেক বাংলাদেশির কাছে ইন্টারনেট ব্যবহার মানে মূলত ফেসবুক ব্যবহার করা। গত মে মাসে বাংলাদেশে সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল আনুমানুক ৩ কোটি ৯০ লাখ। এই বাড়ন্ত ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এফ-কমার্সকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এফ-কমার্স বাংলাদেশে অনলাইন ব্যবসায় আরো কিছু পরিবর্তন এনেছে। কয়েক বছর আগে অবধি অনেকটা ডাক বিভাগের মতো সরবরাহ সেবার উপর নির্ভর ছিল ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসাগুলো। এখন অনেকেই লজিস্টিক সংস্থা নিয়োগ দিচ্ছে তাদের পণ্যের গুণগত মান যাচাই, ডেলিভারি (সরবরাহ) সেবা প্রদানের জন্য। পণ্য সরবরাহের পাশাপাশি ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহও করে থাকে এসব সংস্থাগুলো। বাংলাদেশে এমন সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ইকুরিয়ার্জ, শপআপ ও পেপারফ্লাই। এদের মধ্যে দেশজুড়ে ৩ হাজার ৫০০'র বেশি ফেসবুক ব্যবসায়ীর সাথে চুক্তি রয়েছে পেপারফ্লাই'র।

তবে এফ-কমার্সের এমন জমজমাট সময় বেশিদিন নাও থাকতে পারে। খাতটির সম্ভাবনা বিবেচনা করে বিদেশি বিনিয়োগ টানার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ সরকার। এ নিয়ে স্থানীয় সংস্থাগুলো আশঙ্কায় রয়েছে। পেপারফ্লাইয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রাজিবুল আলমের কথায়, অ্যামাজন এই দেশে প্রবেশ করলে, তারা (বিদ্যমান) বাজার ধ্বংস করে দিতে পারে।

 কিন্তু অ্যামাজনের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। প্ল্যাটফর্মটিতে কোনো ব্যবসায়ী হাজারো প্রতিযোগীর সঙ্গে টক্কর দিয়ে কুলিয়ে নাও উঠতে পারেন। কিন্তু ফেসবুক-ভিত্তিক ব্যবসায় নিজেকে আলাদাভাবে ফুটিয়ে তোলার সুযোগ থাকে তার। যেমন কোনো স্থানীয় আম ব্যবসায়ী তার আম গাছে থাকার সময় থেকে শুরু করে, পাকা শুরুর সময়ের ছবি, লাইভস্ট্রিমিং, বিজ্ঞাপনসহ নানা উপায়ে নিজের পণ্যকে আলাদাভাবে তুলে ধরতে পারেন, যা অ্যামাজনে সম্ভব নয়।

তবে এফ-কমার্সের সীমাবদ্ধতাও অনেক। এতে প্রায়ই ভুয়া পণ্য বা সেবার শিকার হতে হয় ভোক্তাদের। পাখি পালক কবির জানান, চলতি মাসে ১৫ হাজার অনুসারীসম্পন্ন একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে নেটফ্লিক্সের একটি সাবস্ক্রিপশন প্যাকেজ কেনেন তিনি। এক মাসের জন্য ২ ডলারের মতো পরিশোধ করোতে হয়েছে তাকে। কিন্তু চার দিনের মাথায়ই তার একাউন্টটি বন্ধ হয়ে যায়। একইসঙ্গে ডিলিট হয়ে যায় সেবা প্রদানকারী ফেসবুক পেজটিও। এ ধরণের পরিস্থিতিতে ভোক্তাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোনো প্রক্রিয়া বিদ্যমান নেই।

বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান বলেন, এদেশে ই-কমার্স এখনো পরিপক্ক হয়ে উঠেনি। বর্তমানে দেশটির অনলাইন ব্যবসার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ফেসবুক ভিত্তিক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এসব ব্যবসায় অর্থ ফেরত দেওয়ার কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই, আইনি কাঠামো নেই, পণ্য পাল্টে দেওয়া হয় না, আর অর্থ পরিশোধের মাধ্যমের সংখ্যাও সীমিত।

ই-কমার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ-এর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে ফেসবুক-ভিত্তিক ব্যবসায়ীদের আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। এক্ষেত্রে কৌশলগত বিনিয়োগ ও বিধান তৈরির আগ পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ভিত্তিক ব্যবসা নিজ থেকেই বেড়ে উঠতে থাকবে।

(রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ থেকে অনূদিত। মূল প্রতিবেদনটি লিখেছেন নিলেশ ক্রিস্টোফার)

 

অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর