মহামারি করোনাভাইরাস রোধে আসন্ন লকডাউনে শিল্প-কারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষের চলাচলে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী ও আর্মড ফোর্স, সরকারের এজেন্সিগুলোকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে নামানোর পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সোমবার সিপিডি আয়োজিত ‘কোভিড অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ: কীভাবে সামলাবো’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে এ পরামর্শ দেন গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় আলোচনায় বক্তব্য রাখেন ব্র্যাকের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মুস্তাক রেজা চৌধুরী, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর, এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিজিএমইএ’র নতুন সভাপতি ফারুক হাসান, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলালউদ্দিন।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমরা জানি ইতিমধ্যেই সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সুতরাং এর আলোকে এখন স্বাস্থ্যবিধিকে গুরুত্ব দিতে হবে। কল-কারখানায়, বাজারে স্বাস্থ্যবিধি বিশেষ করে মাস্ক পরা সুনিশ্চিত করার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, এজন্য (স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে) আর্মড ফোর্স, সরকারের এজেন্সিগুলোকে ব্যবহার করতে হবে। সরকারের যেসব এজেন্সি রয়েছে, সেখানে লোকবল কম, প্রয়োজনে অন্যান্য এজেন্সি থেকে লোকবল নেয়া যেতে পারে। এলাকাভিত্তিক জোন ভাগ করে পর্যবেক্ষণ করা, যে মাস্ক ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা।
তিনি বলেন, প্রয়োজনবোধে সেনাবাহিনী ও আর্মড ফোর্সকে ব্যবহার করা যেতে পারে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে। পরিপালনগুলো কঠোরভাবে শিল্প-কারখানায় হোক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হোক, এমনকি সাধারণ মানুষের চলাচলেও এনফোর্সমেন্টের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এটা এনফোর্সমেন্ট না হলে জরিমানা, এমনকি সংক্রমণের আশঙ্কা থাকলে প্রতিষ্ঠান বা কল-কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার মতো ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা এই কর্মকর্তাদের দেয়া যেতে পারে।
আলোচনা শেষে সারসংক্ষেপ তুলে ধরে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, আলোচনায় সুপারিশগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো- স্বাস্থ্যবিধি, চিকিৎসা এবং অন্যান্য সহায়তা। স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে অনেকে বলেছেন জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য। মাস্ক পরা এবং মাস্ক আরো বেশি পরিমাণে বিতরণ করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, জনসমাগম না হওয়ার বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ এসেছে। তিনি বলেন, চিকিৎসার বিষয়ে ফিল্ড হাসপাতালের সুপারিশ এসেছে। সেখানে কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার ব্যবহারের সুপারিশ এসেছে। আমরা দেখছি যে, টিকা দেয়া শুরু হয়েছে, সেখানে একটা অসামঞ্জস্যতা দেখা যাচ্ছে। টিকার সরবরাহ কম এবং জনসচেতনতাও কম। টিকার সরবরাহ কম হওয়ার জন্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে টিকা আমদানির সুপারিশ এসেছে। সেই সঙ্গে কোভিড চিকিৎসার ওষুধ কীভাবে সুলভমূল্যে দেয়া যায় তার সুপারিশ এসেছে। ফাহমিদা বলেন, কারখানা কর্মীদের স্বাস্থ্যের কথা আলোচনায় উঠে এসেছে। তাদের সব ধরনের স্বাস্থ্যগত সুবিধা দেয়ার জন্য কারখানা মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতে কারখানাগুলো খোলা থাকে এবং কর্মীদের কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হলে, যেন সেই সহযোগিতা দেয়া হয়। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিচ্ছেন। তাদের পুরস্কার দেয়ার সুপারিশ এসেছে। ক্ষুদ্র দোকান মালিকদের কথা চিন্তা করে ক্ষুদ্র দোকান খোলা রাখার সুপারিশ এসেছে। সেই সঙ্গে দরিদ্র জনগণের জীবিকার ওপর যে আঘাত আসে, তার জন্য নগদ অর্থ সহায়তা বাড়ানোর সুপারিশ এসেছে। গত বছর ৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেয়া হয়, কিন্তু সবাই পাইনি এখনো। এটার ব্যাপ্তি আরো বাড়ানোর সুপারিশ এসেছে।
সিপিডি জানায়, গত বছরের চেয়ে চলতি বছর সংক্রমণের হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর লকডাউন বেশ ঢিলেঢালাভাবে হয়েছিল। গত বছরের লকডাউন সাধারণ মানুষের আর্থিক পরিস্থিতি ও জীবিকার উপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। এই সংকট এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। উৎপাদন প্রক্রিয়া চলমান রাখা ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখার গুরুত্ব তুলে ধরে সংস্থাটি।
এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, আমাদের করোনাভাইরাস নিয়েই বাঁচতে শিখতে হবে। বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতার কথা উল্লেখ করে সকলকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
ব্র্যাকের সাবেক ভাইস চেয়ারপারসন ড. আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে এর আগেও কোভিড-এর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার প্রচেষ্টা থাকলেও তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হয়নি।
সিপিডি’র বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, লকডাউনের অর্থনৈতিক একটি প্রভাব রয়েছে; কিন্তু এটি সংক্রমণ ছড়িয়ে পরা রোধে বাধা দেবে। জীবন এবং জীবিকার মধ্যে এখন জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়ার সময় এসেছে এবং এর জন্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত।