পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, পরিবেশ সুরক্ষায় আইন ও নীতির বাস্তবায়নের পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ‘স্বাধিনতার ৫০ বছর পূর্তীতে পরিবেশ সুরক্ষায় অর্জন, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। ধরিত্রী দিবসের ৫০ তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে চেঞ্জ ইনিসিয়েটিভ, ক্লিন, বেলা, বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট এন্ড ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, ইনিসিয়েটিভ ফর রাইটস, মালেয়া ফাউন্ডাশনস ও রিভারাইন পিপল সম্মিলিতভাবে এ ওয়েবিনারের আয়োজন করেছে । ওয়েবিনারের মূল বক্তব্যে পরিবেশ ও জলবায়ু অর্থায়ন বিশ্লেষক ও চেঞ্জ ইনিসিয়েটিভ এর নির্বাহী পরিচালক এম জাকির হোসেন খান বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে পরিবেশ রক্ষার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক আইন ও নীতি প্রণীত হয়েছে পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশে। সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এর যথাযথ বাস্তবায়ন। নিরাপদ পানি নিশ্চিত বা নির্মল বায়ু এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্ত্বপূর্ন লক্ষ্যমাত্রা হলেও পানি দূষণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি মনে করেন, পরিবেশ রক্ষায় সকলকে সমন্বিত ভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ, প্রযুক্তির ব্যবহার, পরিবেশ বান্ধব আবাসন কাঠামো, দুষণকারীদের উপর কর আরোপ করাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
এছড়াও যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রয়েছে তাদের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সকলকে পরিবেশ রক্ষার্থে সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমিরেটাস ড. আইনুন নিশাত মনে করেন পরিবেশ সংরক্ষনে শুধু এস ডি জি অনুসরন করলেই যথেষ্ট। বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের মধ্যে সমন্বয় এবং পর্যবেক্ষণের অভাব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের আইন বা নীতিমালার অভাব নেই অভাব রয়েছে এর কার্যকারীতায়। এর কার্যকারীতা সফল করতে তিনি আইনসভাকে এগিয়ে আসার আহ্ববান জানান। তিনি মনে করেন, মন্ত্রণালয়ের সকলকে কার্যক্রম মনিটর করতে হবে এবং তাদের কার্যক্রম অবশ্যই হতে হবে পরিবেশ বান্ধব।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পুর্তীতে পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্যে আমারা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য মাত্রাকে অর্জন করতে পারলে পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব, কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনে মূল চ্যলেঞ্জ হচ্ছে সুশাসনের ও স্বমন্বিত উদ্যোগের অভাব। তিনি মনে করেন স্বমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা না করতে পারলে এই লক্ষ্য অর্জন ব্যর্থ হবে ।
আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেসেন্টেটিভ রাকিবুল আমিন বলেন, বাংলাদেশ সব সেক্টরে অনেক অর্জন করলেও পরিবেশে সুরক্ষায় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে । বাংলাদেশে বর্তমানে নেতৃত্বে ধারবাহিকতা লক্ষণীয় কারন যুব সমাজ পরিবেশ রক্ষায় সম্মুখ থেকে নেতৃত্ত্ব দিতে সকল পর্যায় থেকে এগিয়ে এসেছে। উন্নয়ন জরুরি কিন্তু এর জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে আপস করা যাবে না।
এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন, জলজ সম্পদ রক্ষায় আমরা এগিয়ে আছি কিন্তু আমরা বায়ুদূষনের দিকে বিপদজনক জায়গায় অবস্থান করছি। এবং এ ব্যপারে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে।
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পরিবেশ রক্ষায় আমাদের অঙ্গ সংস্থার প্রতিষ্ঠান গুলো যেমন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বের এবং সদিচ্ছার অভাব রয়েছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা বা পর্যবেক্ষনণর জন্য লোকবলের অভাব রয়েছে। এইসকল প্রতিষ্ঠানের সংশোধন প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, বিগত ৫০ বছরে পরিবেশ সেক্টরে বাংলাদেশে সচেতনতা অর্জিত হয়েছে। তিনি অন্যান্য বক্তাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলেন, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অজন ছাড়া পরিবেশ রক্ষা সম্ভব নয় । অগ্রাধিকার বাছাই, পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়ানো সহ সুশাসনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
ফোরাম অব ইনভারন্মেন্টাল জার্নালিষ্ট অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দেশে পরিবেশ ও বন রক্ষায় বিভিন্ন আইন ও নীতি থাকে এর সঠিক বাস্তবায়ন বা প্রয়োগের অভাব রয়েছে।
ক্লাইমেট জাস্টিস এন্ড ন্যাচারাল রিসোর্সের প্রধান এনামুল মাজিদ সিদ্দিক অক্সফামের পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষন কার্যক্রম তুলে ধরে বলেন, পরিবেশ সংরক্ষনের ভার যেন শুধু গরীব বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠির উপর না বর্তায়। প্রাকৃতিক সুরক্ষার ক্ষত্রে নেয়া সকল সিদ্ধান্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে মাথায় রেখে ও তাদের সাথে নিয়ে করার আহ্ববান জানান তিনি।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ব্যরিষ্টার দেবাশীষ রায় কার্যকর বন নীতি ও আইন প্রনয়নের উপর গুরুত্ত্ব দেন এবং সকলকে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সাথে নিয়ে বিশেষ করে আদিবাসি জনগোষ্ঠী যারা বন ও পরিবেশের উপর সম্পুর্ন ভাবে যুক্ত তাদের নিয়ে এই আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
ওয়েবিনারের প্রধান অতিথি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, পরিবেশ সুরক্ষা মানবাধিকারের অংশ, মানবাধিকার নিশ্চতেই পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। তিনি আরো বলেন, উন্নয়ন অবশ্যই হতে হবে পরিবেশের সুরক্ষাকে মাথায় রেখে। পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে কার্কর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
রিভারাইন পিউপল মহাসচিব শেখ রোকন সকলকে স্বাগত জানিয়ে অনুষ্ঠানের সুচনা করেন এবং পরিবেশ রক্ষায় বিগত ৫০ বছরে বিভিন্ন সংস্থার অবস্থান তুলে ধরেন।
প্রসঙ্গত, সারা বিশ্বে ২২ এপ্রিল ধরিত্রী দিবস পালন করা হয়। পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার মাধ্যমে ধরিত্রীকে টিকিয়ে রাখতে “সকলে মিলে পৃথিবী পুনরুদ্ধার” প্রতিপাদ্য নিয়ে এই বছর পালিত হচ্ছে ধরিত্রী দিবস। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জর্জরিত। এমন প্রেক্ষাপটে প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং সারা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশের পরিবেশ সুরক্ষায় এই ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়েছে।