মঙ্গলবার ২৫ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৪৮গতরাতে আকস্মিকভাবে সাদা পোশাকধারী আটজনের একটি টিম এসে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আমার ঘরে আবার তল্লাশি চালিয়েছে। এর জন্য কোনো কারণ দেখানো হয়নি। কেবল আমাকে নাজেহাল করার জন্যই এই ব্যবস্থা।
সংবাদপত্রগুলোতে এখন অনাহারে মৃত্যুর কিছু কিছু খবর প্রকাশ করা হচ্ছে এবং সেখানে স্বীকার করা হচ্ছে যে, দেশে বিরাজ করছে দুর্ভিক্ষাবস্থা।
পিজি হাসপাতালে আজ স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি কড়া প্রহরার আয়োজন করা হয়েছিল এবং আমাকে ডাক্তার ছাড়া আর কারো সাথে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। আমাকে দেওয়া হয়নি কোনো খবরের কাগজ পড়তে । খুবই কড়াভাবে তল্লাশি চালানো হয়েছে আমার সারা দেহে।
বুধবার ২৬ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৪৯আজ স্বাধীনতা দিবস। মজার ব্যাপার হলো প্রধান উপদেষ্টা কিংবা বর্তমান সেনাপ্রধান কারোরই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে কোনো ভূমিকা ছিল না কিংবা সে সময়ে বা তার আগে বা পরে জনগণের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
আশা করা গিয়েছিল যে, প্রধান উপদেষ্টা এই দিনে জাতিকে জরুরি আইন প্রত্যাহারের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানাবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সরকার জানেন যে, এখন তারা বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছে এবং নেমে গেলেই তাদের শেষ করে ফেলা হবে।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, যতদিন সম্ভব জরুরি ক্ষমতা আইন বহাল রেখে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে টিকে থাকা ছাড়া তাদের কোনো গত্যন্তর নেই এবং যতদিন পারা যায় কেবল সে প্রচেষ্টাই তারা করে যাবেন।
যে কোনো উৎসবের দিনেই বাইরে থেকে খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা উন্মুক্ত থাকে। দর্শনার্থীদের জন্যও সেদিন দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ফলে আমাকে দেখতে এসেছিল অনেকে এবং অনেকরকম খাবারও নিয়ে এসেছিল তারা। সেলে আমরা খাবারগুলো সাধারণত ভাগাভাগি করে খাই, তবে বেশির ভাগ খাবারই দিয়ে দেওয়া হয় আমাদের দেখাশোনাকারী লোকজন ও প্রহরীদের।
বৃহস্পতিবার ২৭ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৫০যে ঘরটিতে আমার দিনের প্রায় ২৪ ঘণ্টা সময় কাটে সে ঘরটি ১০ ফুটx১৮ ফুট, উঁচু ছাদসম্পন্ন একটি প্রকোষ্ঠ। এ জায়গাটুকুতেই আমার সবকিছু। আমার বিছানা, টেবিল- যেখানে চলে আমার পড়াশোনা, লেখা, খাওয়া ও প্রার্থনার কাজ। আলাদা দুটি টেবিল ও চার তাকের একটি সেলফে আমার বই ও ফাইলপত্র আছে। বাসনপত্র রাখার জন্য একটি কাঠের চোকি, ছোট ঘেরা একটি জায়গায় টয়লেট-বেসিনশাওয়ার। দেয়াল পুরোপুরি স্যাতসেঁতে, সস্তা রঙ দিয়ে অমসৃণভাবে রঙ করা, পূর্ব দিকে রয়েছে একটা জানালা আর এই দক্ষিণমুখী ঘরটাতে রয়েছে একটি স্টিলের সিক লাগানো দরজা। উত্তর দিকে আরেকটি জানালা যেটা পাশের নর্দমা থেকে দুর্গন্ধ আসা রোধ করার জন্য প্রায় সময়ই বন্ধ রাখা হয়। ফলে বাতাস আসা-যাওয়ার পথ নেই। শুধু পূর্বদিকের জানালা দিয়েই যা বাতাস পাওয়া যায়।
মশা, পোকামাকড় ও বিচিত্র সব ধরনের ইঁদুর ও বিড়াল আমার নিত্যসঙ্গী। আমার নিজের খরচে প্লাস্টিকের ম্যাট এনে বিছিয়েছি মেঝেতে। এখন এই ছোট্ট পরিসরের ঘরে থাকতে আমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি এবং এই রকম দুঃসহভাবেই কেটে যাচ্ছে আমার জীবন। এখন এই ছোট পরিসরের ঘরটিই হলো আমার পৃথিবী।
শুক্রবার ২৮ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৫১এই ২৬নং সেলের নাম এখন চম্পাকলি। এখানে রয়েছে ১২টি রুম। বিভিন্ন সময়ে সাধারণত রাজনীতিবিদেরাই এখানে থাকেন।
সিনিয়র বন্দী হিসেবে আমার মেট জিয়াউদ্দিন জেলে আছে ২০ বছরের বেশি সময়। অন্য হেলপারদের সর্দার হিসেবে তার পদবী হলো মেট। কোনোরকম বদলি ছাড়াই সবসময় আমার সাথে রয়েছে।
জেল কমিটির একটি বৈঠকে যোগ দিতে মোস্তফা জামান আব্বাসী আবার এসেছিল জেলখানায়। গতবারের মতো বৈঠক শেষে আমাকে দেখতে চাওয়ার কারণে এই সাক্ষাত । আমাদের অতীতের মধুর দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে অনেকক্ষণ আমরা সময় কাটালাম। আব্বাসী অর্থাৎ তুলু এবারও তার ছাপানো আত্মজীবনী বইটা দিল- “জীবন নদীর উজানে”। খুব সুন্দর নাম ।
শনিবার ২৯ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৫২আজও অনাহারে মৃত্যুর খবর বের হয়েছে কাগজে। দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ গণতন্ত্র থাকলে খাদ্যাভাবে ঠিক কী সংখ্যক লোক মারা যাচ্ছে তার পরিষ্কার একটা চিত্র পাওয়া যেতো। ভেতরের পাতায় ছোট্ট খবর না হয়ে তা হতো প্রথম পাতার খবরের শিরোনাম, যা হতো সরকারের জন্য ভীষণভাবে ব্রিতকর। কিন্তু এখন সবাই নীরব। সরকার নীরব। নীরবে চলছে দুর্ভিক্ষ আর লোকজনও মারা যাচ্ছে নীরবে।
রবিবার ৩০ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৫৩২৮ বছর আগে এই দিনে আমাদের প্রথম সন্তান আসিফ ঢাকায় অজানা কারণে প্রাইমারি পালমুনারি হাইপারটেনশনে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। যুক্তরাজ্যের সেরা হাসপাতাল লন্ডনের গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট চিনে হাসপাতালে ও যুক্তরাষ্ট্রের সেরা বস্টন চিল্ড্রেন হাসপাতালে তার চিকিৎসা করা হয়েছিল। অসুখটি ছিল অত্যন্ত দুর্লভ ধরনের। সে যাবৎ যার কোনো চিকিৎসা বা ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। আমেরিকার ডাক্তারদের পরামর্শক্রমে তাকে পরীক্ষামূলকভাবে রাখা হয়েছিল বিশেষ ধরনের অক্সিজেন তাঁবুতে। আমেরিকা থেকে ফেরার পরপরই বেশির ভাগ সময় তার কেটেছে আমদানি করা সেই অক্সিজেন টেন্টে। অক্সিজেনও যখন তাকে নিঃশ্বাস নিতে সাহায্য করতে পারেনি, তখন আমার কোলে আমারই বাহুবন্ধন অবস্থায় নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল আমার প্রাণের টুকরা আসিফ।
আসিফ ছিল আমার দেহ ও আত্মার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাণোচ্ছল, সক্রিয় ও আনন্দোজ্জ্বল। মাত্র ১৬ মাস বয়সে যখন সে সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে তখনই জেলগেটে আমাকে দেখতে আসতো সে । সে ছিল এই একই জেলগেট যেখানে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় প্রথা চালু করার জন্য ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা জারি করে আমাকে আটক করে কারাবন্দী করে রাখা হয়েছিল। প্রত্যেকবার জেলখানায় এসেই কোনো উপায়ে আসিফ জেলগেটে ফ্লোর পার হয়ে মায়ের কোল থেকে এপারে চলে আসতো আমার কাছে ও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে আমার সান্নিধ্য পাওয়ার উপায় খুঁজতো। বড় হওয়ার সাথে সাথে আসিফ আমার রাজনীতির অংশ হতে শুরু করে। মাঝে মাঝে সে আমার সাথে চলে আসতো জনসভায়। সকলের সাথে সুর মিলিয়ে তুলতো স্লোগান।
আসিফের মৃত্যু আমার জীবনের এক চরমতম দুঃখবহ ঘটনা। এখন শায়িত আছে শেষশয্যায় উপমহাদেশের বিশিষ্ট কবি, তার নানা, কবি জসিম উদ্দিনের কবরের পাশে।
সোমবার ৩১ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৫৪দেশের মানুষ যখন মারা যাচ্ছে অনাহারে, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান তখন সরকারি খরচে হেলিকপ্টারে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারাদেশে। যেখানেই তিনি যাচ্ছেন শত শত স্কুল ছাত্রছাত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন ধরে খোলা আকাশের নিচে প্রখর রৌদ্রের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। আর দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান সর্বত্র আওড়ে যাচ্ছেন তার তথাকথিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপ্তবাণী। তার সফরের মাত্রা যত বাড়ে, তার সাথে প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে জিনিসপত্রের দাম। এর কারণ হলো, তার প্রতিটি সফর ও বক্তৃতার পর একেক জন বড় আমদানিকারকের মনে যে ভীতি জন্মায়, তার প্রতিক্রিয়ায় সে ব্যবসায়ী বা আমদানিকারক তার উদ্যোগ থেকে হাত গুটিয়ে নেন। বিঘ্নিত হয় আমদানি ও সরবরাহ পরিস্থিতি, আর বাজার ও পণ্যমূল্য চলে যায় নাগালের বাইরে ।
একইভাবে দেশ যখন চরম খাদ্যসংকটের মুখে এবং জনগণ ন্যূনতম পর্যায়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার জোগাড় করে উঠতে পারছে না, সে সময় হঠাৎ করে সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান এ.কে. খোন্দকার ও সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ ৩৭ বছর নীরব থাকার পর আকস্মিকভাবে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি তুলে বসলেন। ১৯৭২-৭৫ সালে এবং ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে এ দুজনই ছিলেন বিভিন্ন মেয়াদে সংসদের সদস্য বা মন্ত্রী। কিন্তু তখন তারা এ প্রশ্নে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। তাহলে মনে হয় বর্তমান সরকারের অবৈধ কর্মকাণ্ডকে সুরক্ষার জন্য এই উদ্যোগ তারা নিয়েছেন।
মঙ্গলবার ১ এপ্রিল ২০০৮ দিন ৩৫৫কোনো না কোনো পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই অনাহারে মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হচ্ছে। দৈনিক মানবজমিন-এ গাইবান্ধা এবং দৈনিক ইত্তেফাক-এ কুড়িগ্রামে অনাহারে করুণ মৃত্যুর বিস্তৃত প্রতিবেদন বের হয়েছে। আজ দৈনিক সমকালে ছিল দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি’র ওপর বিশাল প্রতিবেদন। অথচ কতিপয় তথাকথিত সিভিল সোসাইটি সংগঠন সরকারের তল্পিবাহক হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের ওপর সেমিনারের আয়োজন করে সেনাপ্রধানের হাতে দেশের প্রশাসনে আরো প্রত্যক্ষ ভূমিকা প্রদানের বিষয়ে ওকালতি করছে।
একদিকে জনগণ দিন কাটাচ্ছে প্রবল খাদ্য ঘাটতির মুখে। অন্যদিকে জাতীয় সার্বভৌমত্ব হতে চলেছে বিপন্ন। রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সমূলে বিনাশসাধন ও অর্থনীতির প্রান্তিকীকরণের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাদি এমনই দুর্বল হয়ে পড়তে বসেছে যে, এর পক্ষে আবার কোমর সোজা করে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে এবং তাই হতে চলেছে দেশের ভবিষ্যৎ।
আমাকে আবার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাসপাতালে। পা ফুলে যাওয়ার চিকিৎসা এখনো চলছে এবং উন্নতির লক্ষণ খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। এখন আমার দেখাশোনা করছেন প্রফেসর আবদুল্লাহ। টাস্কফোর্স তার ডানার পরিধি ক্রমশ বিস্তত করে পরিব্যপ্ত হয়েছে এই হাসপাতালেও।
বুধবার ২ এপ্রিল ২০০৮ দিন ৩৫৬দেশে এখন চলছে দুর্ভিক্ষাবস্থা। প্রতিদিন প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। বাইশ দিন অনাহারে থাকার পর মৃত্যু হয়েছে একজন কৃষি শ্রমিকের। পরিবারের জন্য খাদ্যের সংস্থান করতে না পেরে আরেকজন কৃষক বেছে নিয়েছে আত্মহত্যার পথ। রাজধানীতে অনাহারে একজনের মৃত্যু ঘটেছে। গ্রামাঞ্চলে গৃহস্থের ঘরে খাবার চুরি, ভাত চুরি নিত্যনৈমিত্ত্যিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্ত খবর থেকেই পরিস্থিতির বাস্তব একটা চিত্র পাওয়া যায়।
মধ্যবিত্ত ঘরের গৃহিণীরাও এখন সমস্ত লাজলজ্জা পরিত্যাগ করে মুক্ত বাজার বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে চাল সংগ্রহ করছেন। যাদের সামান্য অর্থবল আছে, তারা হয়তো লাইন দিয়ে হলেও সামান্য খাবার সংগ্রহ করতে পারছেন। দেশের ৬ কোটি লোকের যেখানে কোনো ক্রয়ক্ষমতা নেই, তারা কী করবেন? অনাহারে দিন কাটানো ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। এদের একমাত্র পথ হলো, অন্যদের অনুসরণ করে নীরবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা।
ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। একই সাথে চালের দাম বাড়িয়ে নিয়ে গেছে টন প্রতি ১০০০ ডলারে যার অর্থ হলো, কেজি প্রতি প্রায় ৭০ টাকা। এই চাল আমদানি করে বাংলাদেশে বিক্রি করার পদক্ষেপ নিলে এই দামে কোনো সরকারের পক্ষেই তা সংকুলান করা সম্ভব হবে না।
(চলবে..)