বৃহস্পতিবার ৩ এপ্রিল ২০০৮ দিন ৩৫৭একসময় রাজনীতিবিদদের সাথে জেলখানার ভিতরে অত্যন্ত সম্মানজনক আচরণ করা হতো; কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। অতীতে কোনো কারা জীবনেই আমি এমন ধরনের নাজেহাল, নির্যাতন, অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হইনি। দরজার বাইরে বিদ্যুৎ বাতির সুইচগুলো মেরামত করা হয়েছে। ফলে আমাদের যখন ঘুমাতে যাওয়ার সময় তখন থেকে সারা রাত অবধি বাতিগুলো ঘরের ভেতর জ্বলতে থাকবে। এখন আর আমরা বাইরে থেকে কোনো বিস্কুট, জেলি বা জ্যাম-জুস আনতে পারি না। এমনকি আমাদের নিজেদের খরচেও না। আজ শেখ সেলিমের বোন তার জন্য কিছু খাবার নিয়ে এসেছিল, কিন্তু জেলগেটে সেগুলো আটকে দেওয়া হয়েছে। ফলে ভীষণ রকমের ক্ষুব্ধ হয়েছে শেখ সেলিম।
ডিআইজি মেজর হায়দার সিদ্দিকী এবং জেল সুপার গোলাম হায়দার বলেছেন, তারা কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন নাই। ফিল্ড ইন্টেলিজেন্সের সেনা অফিসাররাই এর নির্দেশ দিয়েছেন। জেল কর্তৃপক্ষ এখন আর জেল পরিচালনা করেন না।
শুক্রবার ৪ এপ্রিল ২০০৮ দিন ৩৫৮জেলখানা এখন আমাদের জন্য ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক ধরনের টর্চার চেম্বারে পরিণত হয়েছে।
দেশের ৪০ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করলে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ কোটিতে। এদের মধ্যে ৩০ ভাগ সহায়-সম্বলহীন। অর্থাৎ প্রায় দুই কোটি লোক বাস করছে চরমতম দারিদ্র্যসীমায় যাদের ক্রয়ক্ষমতা বলতে কিছু নেই। এরাই হবে প্রথম দুর্ভিক্ষের শিকার। যাদের যৎসামান্য ক্রয়ক্ষমতা আছে তারা কেবল চাল ও শুকনো মরিচ কিনে কোনোরকম জীবনধারণ করতে পারবেন। বাদবাকি অন্যরা প্রতি দুই- তিনদিনে মাত্র একবার অন্নের সংস্থান করে ক্রমশ হারিয়ে ফেলবেন তাদের দেহের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং যখন তাদের দেহ আর সহ্য করতে পারবে না, তারা আলিঙ্গন করবেন চরম মৃত্যুকে। ভিক্ষুকদের আয় গেছে বহুলাংশে কমে এবং তাদের বিরাট অংশ এখন অনাহারে মৃত্যুবরণ করছে। গ্রামাঞ্চলে লোকজন নিজেরাই খেতে পায় না, ফলে ভিক্ষুকদের চাল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বিরাট সংখ্যার জনগণ গ্রাম ছেড়ে চলে আসছে শহরের দিকে, যাদের মূল লক্ষ্যস্থল হলো রাজধানী ঢাকা।
খাদ্য উপদেষ্টা বলছেন, দেশে সুপ্ত অনাহার (hidden hunger) চলছে। অন্তত তিনি জনসমুক্ষে স্বীকার করছেন দেশ এখন দুর্ভিক্ষাবস্থার কবলে, তা সুপ্তই হোক আর প্রকাশ্যই হোক।
শনিবার ৫ এপ্রিল ২০০৮ দিন ৩৫৯সব সংবাদপত্রে এখন বিভিন্ন রিপোর্টে পরিষ্কারভাবে জনগণের দুর্ভোগের কথা বলা হচ্ছে এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে যে, এই দুর্ভিক্ষাবস্থা আরো ২ থেকে তিন মাস চলবে। আমাকে দেখতে আসা লোকজন বলছে যে, বাইরের পরিস্থিতি এখন বিস্ফোরণমুখী; কিন্তু জনগণকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ নেই। ওপেন মার্কেট সেলে যে চাল বিতরণ করা হচ্ছে তার পরিমাণ নগণ্য। বেলা ১২টার মধ্যেই সরবরাহ করা চাল শেষ হয়ে যায় ও সকাল থেকে লাইনে দাঁড়ানো অধিকাংশ লোককে শূন্য হাতে ফিরে যেতে হয়। শুধু চাল নয়, বিস্কুট, সাবান, রুটি ইত্যাদিসহ প্রতিটি ভোগ্যসামগ্রীর দাম নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে চলেছে। সংবাদপত্রে বলা হচ্ছে যে, দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার মাত্রা সম্ভবত ১৯৭৪ সালকেও ছাড়িয়ে যাবে।
রবিবার ৬ এপ্রিল ২০০৮ দিন ৩৬০ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে গত এক বছরে দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ঘুষ বেড়েছে এবং ঘুষের সীমানাও এখন বিস্তৃততর হয়েছে। সরকারি দফতরে যেকোনো কাজ সারতে অধিকতর সময়ক্ষেপণ করতে হচ্ছে। দুর্নীতিমূলক আচরণ চলছে আগের মতোই, তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ করে ভূমিসংক্রান্ত, পুলিশ, স্থানীয় সরকার, ওয়াসা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, জেলা ও উপজেলা, গণপূর্ত, রাজউক অফিসসমূহ এবং সচিবালয়, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও কর্পোরেশনে দুর্নীতির পরিমাণ বেড়েছে।
এতদিন ধরে সরকার বলে আসছিল যে, জরুরি অবস্থা যথাসম্ভব শিগগিরই প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু পররাষ্ট্র উপদেষ্টা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে সরকারের অভিপ্রায় জানিয়ে ঘোষণা করেছেন যে, সরকারের টিকে থাকার প্রয়োজনে এবং অবৈধ এই সরকারের কর্মকাণ্ডের বৈধতা নিশ্চিত না হওয়া অবধি জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা সম্ভব হবে না। একথা সত্য, কারণ সংবাদপত্রগুলো বলছে যে, জরুরি আইন না থাকলে এ সরকার একদিনের জন্যও টিকে থাকতে পারবে না এবং জরুরি আইন প্রত্যাহার কেবল জনগণ মুক্ত অবস্থায় নিঃশ্বাস নিতে সক্ষম হবে।
সোমবার ৭ এপ্রিল ২০০৮ দিন ৩৬১পণ্যের ওপর মুদ্রাস্ফীতির মাত্রা বেড়ে উন্নীত হয়েছে ২৩ শতাংশে, যার ফলে কর্মসংস্থান ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা পরিস্থিতির আরেক দফা অবনতি ঘটেছে, অসহায় এক খোড়া হাঁসের মতো ফখরুউদ্দিন প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে বসে বৈঠকগুলোতে সভাপতিত্ব করছেন, অথচ কোনো কিছুর ওপর তার কোনো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই। আর দূরে থেকে যারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন, তারা কোনো কিছুর দায়ভার বহন করছে না।
সেনাপ্রধানের চাকরির মেয়াদ আরো এক বছর বাড়িয়ে তা ২০০৯ সালের ১৫ই জুন পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়েছে। ফলে নিজের রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও ব্যক্তিগত অভিলক্ষ পরিনির্ণয়ের জন্য তিনি বাড়তি কিছুটা সময় পেলেন।
গতকাল আমার বন্ধু স্থানীয়, সাবেক মন্ত্রী ও রাজনৈতিক সহকর্মী নাজিউর রহমান মাত্র ৫৯ বছর বয়সে বারডেম হাসপাতালে পরলোকগমন করেছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন একজন ব্যক্তি। আমার অনেক দুর্যোগকালে তিনি আমাকে সাহায্য করেছেন। তার স্ত্রী শেখ সেলিমের বোন এবং শেখ হাসিনার ফুফাতো বোন। তবে তার রাজনৈতির ধারা ছিল ভিন্নতর।
মঙ্গলবার ৮ এপ্রিল ২০০৮ দিন ৩৬২অ্যালকোহল মামলায় হাজিরা দিতে কোর্টে গিয়েছিলাম। এ ছিল কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা। জেলখানার বাইরে খোলা আকাশের নিচে বিচরণ করা ছাড়াও এ সময় আমি আমার অসংখ্য আইনজীবী, সহকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীদের সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছি। এ সময় আমি আমার নোট ও পাণ্ডুলিপি বিনিময় করেছি। লেখা পাণ্ডুলিপি ওদের কাছে দিয়ে আমি সংশোধনীর জন্য সংগ্রহ করেছি পাণ্ডুলিপি টাইপ করা অংশ।
মাইনাস-টু থিওরির প্রবক্তাদের যারা দুই নেত্রীকে মূলধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার পাঁয়তারা করছিলেন, ধীরে ধীরে তারা উপলব্ধি করতে পারছেন যে, তাদের পরিকল্পনার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। বরং শান্তিপূর্ণভাবে এই পথ থেকে বের হয়ে আসার জন্য তাদের কতিপয় নেতার সাহায্য নেওয়া দরকার হবে।
প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমেদ বলেছেন যে, দুই নেত্রীর অংশগ্রহণ ছাড়া রাজনৈতিক কোনো সংলাপ সফল হবে না। কিছুদিন আগে প্রফেসর কবির চৌধুরীও বলেছিলেন একই কথা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুই নেত্রীর মুক্তি এবং জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।
বুধবার ৯ এপ্রিল ২০০৮ দিন ৩৬৩কোনো কোনো জায়গায় জরুরি আইনের নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফরিদপুরে বিএনপি’র ছাত্রদল ও অন্যান্য জেলায় আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগ এ ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ।
সাংবাদিকদের সাথে প্রায় এক ঘণ্টা মতবিনিময়কালে সেনাবাহিনী প্রধান খাদ্য, দুর্ভিক্ষ, দ্রব্যমূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, কর্মসংস্থানহীনতা ইত্যাদি বিষয়ক প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন। তবে দু’টি বিষয়ে তিনি মিথ্যাচার করেছেন। (১) তার চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য তিনি প্রত্যাশী ছিলেন না বা এর জন্য তিনি কোনো আবেদনও করেননি। অথচ তার নিজস্ব আবেদন ছাড়া প্রশাসনিকভাবে কোনো সরকারের পক্ষে তার চাকরির মেয়াদ বাড়ানো সম্ভব নয়। (২) সরকার পরিচালনায় সামরিক বাহিনীর কোনো ভূমিকা নেই। এতো বড় একটা অসত্য কথা তিনি কীভাবে বললেন? তার এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া দরকার এবং যদি দেখা যায় যে, তিনি মিথ্যা বলেছেন তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে কোর্ট মার্শালে পাঠানো উচিত।
গতকাল ফখরুদ্দীনের সরকার আওয়ামী লীগের সাথে একটি অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বসেছিলেন।
বৃহস্পতিবার ১০ এপ্রিল ২০০৮ দিন ৩৬৪আমাকে নেওয়া হয়েছিল পিজি হাসপাতালে। পায়ের ফোলা কিছুটা কমেছে, তবে অজানা কারণে ব্লাড প্রেসার হঠাৎ অনেক বেড়ে গেছে। আজ এর পরিমাণ ছিল অনেক। ভালো লাগে। আসমা, দুলি, মৃদুলা, শহীদ ও ফরিদ এসে তৌফিকের সাথেও দেখা হলো।
রবিবার ১৩ এপ্রিল ২০০৮ দিন ৩৬৭মধ্যবিত্ত ঘরের গৃহিণীরা সরকারি বিক্রয়কেন্দ্র থেকে কম দামে চাল কেনা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় প্রায়ই তারা ঘোমটা টেনে মুখ রাখেন যাতে কেউ সহজে তাদের চিনতে না পারে। কিন্তু লজ্জা ভেঙেই তারা লাইনে গিয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হন- কারণ সন্তানদের মুখে তাদের অন্ন তুলে দিতে হবে। চিত্রগ্রাহকেরা তাদের ছবি তুলতে চাইলে তারা ছবি না তোলার জন্য করজোড়ে মিনতি জানান।
হাজিরা দেওয়ার জন্য আমাকে যেতে হয়েছিল বিচারিক আদালতে। সব তথ্য নিয়ে এসেছিল ব্যারিস্টার খোকন। আমি আমার অন্যান্য মামলার বিষয়েও তাকে বিশদভাবে নির্দেশ দিয়েছি।
প্রাক-সংলাপ আলোচনার জন্য সরকার আওয়ামী লীগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সোমবার ১৪ এপ্রিল ২০০৮ দিন ৩৬৮আমি জেলে আছি এক বছর ধরে। আমাকে জেলে নিয়ে আসার আগে ইন্টেলিজেন্সের লোকজন কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই যেভাবে দু’চোখ বেঁধে আমাকে বাসা থেকে বের করে এনে অপমান, নাজেহাল ও নির্যাতন করেছে এবং মানসিক নির্যাতন করে আমাকে যেভাবে অন্ধকূপে বন্দি করে রেখেছিল, তা ভাবতে গেলে আজো আমার শরীর শিউরে ওঠে।
আওয়ামী লীগের ৭ জন নেতা ফখরুদ্দীন সরকারের ৪ জন উপদেষ্টার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ‘মেঘনায়’ এক সংলাপ-পূর্ব আলোচনায় বসেছিল। সামরিকরা নিজেদের কার্যসিদ্ধির জন্য আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণের জন্য প্রায়শই এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করে থাকে।
আজ বাংলা নববর্ষ। বাসা থেকে খাবার এসেছিল। জেলখানার নিম্নমানের খাবারের তুলনায় তা ছিল পরমভাবে উপাদেয়।
চলবে...