বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০০৮ দিন ৪৩৪অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বেগম জিয়া সামরিক অফিসারদের সাথে দেনদরবারে বেশ কিছুটা উন্নতির স্বাক্ষর রাখছেন। আজ তারেক রহমানের জন্য একটা মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে যাতে করে এই বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে তারেক রহমানকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবার অনুমতি দেওয়া যায়। কিন্তু তাকে চূড়ান্তভাবে মুক্তির জন্য খালেদা জিয়াকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে খালেদা জিয়া তা মানতে অস্বীকার করেছেন। তিনি চান দু’ছেলের নিঃশর্ত মুক্তি।
আজ রাতেও অফিসাররা তাঁর সাথে দেখা করবেন। সরকারের ওপর যে কোনো ধরনের সমঝোতার জন্য চাপও ক্রমশ বাড়ছে।
আমার ডান বাহুর ওপরের কাঁধের ব্যথা ফিরে এসেছে এক প্রচণ্ডতা নিয়ে। লেখার সময় ভীষণ যন্ত্রণা হয়।
শুক্রবার ২০ জুন ২০০৮ দিন ৪৩৫বিকেল ৫টার সময় হঠাৎ করে আমাকে তলব করা হলো জেলগেটে। সেখানে পৌঁছার পর নিয়মমাফিক দেহ তল্লাশির পর আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। ডিআইজি হায়দার সিদ্দিকী সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
আমি ভাবলাম বিষয়টি নিশ্চয়ই গুরুতর। কিন্তু দেখা গেল, এটি অত্যন্ত সাধারণ ব্যক্তিগত একটি বিষয়। তার পাশে বসা ছিল তারই একজন আত্মীয়। সেই আত্মীয়টি একসময় ব্যবসা করছিল আমার এক ভাগিনার সাথে এবং ব্যবসায়িক সূত্রে সে তার কাছে পাওনা ছিল ২ লাখ টাকা সে উদ্ধার করতে পারছিল না। ঠিক এমন সময় ঘরে এসে ঢুকলো আমার ভাগিনা জিয়া, যার সাথে আমি মুক্ত থাকাকালেও দেখা-সাক্ষাৎ প্রায় হয় না বললেই চলে। পুরো বিষয়টি আমার কাছে অত্যন্ত কৌতুকপ্রদ বলে মনে হলো। এই একই ডিআইজি অনেকদিন আমার অনেক আত্মীয়স্বজনকে জেলগেটের বাইরে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় আটকে রেখে দিয়েছে, একসময় ব্যারিস্টার খোকনকে বলেছে যে, আবার সে আমার সাথে দেখা করতে এলে আমাকে দিনাজপুর জেলে বদলি করে দেওয়া হবে। এই একই ডিআইজি তিন মাসে একবারও আমার কোনো খোঁজখবর নেওয়ার জন্য আমাদের সেলে ভিজিটে আসেননি এবং গত ১৫ মাস ধরে তিনি অসংখ্য রকমের কাজকর্মের মাধ্যমে আমার জীবনকে ভয়াবহ এবং অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। অথচ আজ তিনি আমারই এক আত্মীয়কে জেলগেটের বাইরে অপেক্ষায় না রেখে সরাসরি নিয়ে এসেছেন আমার কাছে এবং উদ্দেশ্য হলো আমার ভাগিনা ও তার ব্যবসায়িক অংশীদার আত্মীয়ের সাথে ব্যক্তিগত একটি বিবাদ মীমাংসা করা। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা না হলে আমি হয়তো টাকা বুঝিয়ে দিয়ে আমার আত্মীয়কে এই অপদস্থ হওয়া থেকে মুক্ত করতাম। কিন্তু আমি দুঃখ প্রকাশ করে বললাম যে, এ ব্যাপারে আমার কিছু করণীয় নেই এবং যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার জন্য জিয়াকে পরামর্শ দিলাম। আমার জন্য এ ছিল এক তিক্ত অভিজ্ঞতা। এমনও হতে পারে যে, ডিআইজি সরল বিশ্বাসেই তার নিজ আত্মীয়কে সাহায্য করার জন্য এই নাটকের অবতারণা ঘটিয়েছিলেন। তবে এর মধ্যে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র ছিল কি না জানি না।
শনিবার ২১ জুন ২০০৮ দিন ৪৩৬আমি এটা শুনে আজ অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছি যে, বিচারপতি এম.এ. রশিদ আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের চার্জশিটের বিরুদ্ধে আনীত রিট পিটিশনটি খারিজ করে দিয়েছেন। রিটে আমি বলেছিলাম যে, আমার ব্যক্তিগত-পারিবারিক ও পেশাগত ব্যয় দেখানো আইন বহির্ভূত, কিন্তু আইনের মূল ধারাগুলো বিচারপতি তার রায় দেয়ার সময় টেনে আনেননি এবং তার রায় ও আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার মধ্যে কোনো সংলগ্নতাও নেই। রুলটিকে অ্যাবসলিউট ঘোষণা করার জন্য এটা ছিল অত্যন্ত উপযুক্ত একটি মামলা।
রবিবার ২২ জুন ২০০৮ দিন ৪৩৭বিচারপতি রশিদের রায় আমাকে দারুণভাবে হতাশ করেছে। আমি তাঁর কাছ থেকে এমনটি আশা করিনি। আমি নিশ্চিত বিচারপতি রশিদও নিঃসন্দেহে অনুভব করছেন যে, তিনি কাজটি ঠিক করেনি। সবার কাছে তিনি পরিচিত ‘জ্ঞানী রশিদ’ হিসেবে। অর্থাৎ ইচ্ছে করেই তিনি এমনটি করেছেন। আওয়ামী পন্থী হিসেবে চিহ্নিত এই বিচারক কি তাহলে কারো দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছেন? নাকি আইনি ধারার বাইরে গিয়ে খেলাধুলার সময় তার মাথায় রাজনীতির পোকা কিলবিল করছিল? আইনের সেই একই পয়েন্টে এর আগে আমি আমার পক্ষেই আদালতের রায় পেয়েছি এবং আপিল বিভাগ সেখানে আমার পক্ষেই সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এরপরও তিনি তা বিবেচনা করেন নাই।
সোমবার ২৩ জুন ২০০৮ দিন ৪৩৮আল্লাহ্ সবসময়ই আমাকে তাঁর রহমত ও করুণায় অভিষিক্ত করেছেন। আইনের বিধানের ওপর পরিস্থাপিত আমার অত্যন্ত যৌক্তিক একটি আবেদন আদালত থেকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি তোফাজ্জল ইসলাম বিচারপতি রশিদের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে মামলার সব কাজকর্ম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি ভেবেছিলাম যে, বিচারপতি বোধহয় মামলাটি সিভিল মিসেলিনিয়াস পিটিশন হিসেবে বিবেচনা করার জন্য আমার দেওয়া আবেদন অগ্রাহ্য করবেন কিংবা শুনানি করার জন্য সেটি পাঠিয়ে দেবেন পূর্ণ বেঞ্চে। এর ওপর সরাসরি স্থগিতাদেশ আমি প্রত্যাশাই করিনি। বিষয়টি এতো তাড়াতাড়ি চেম্বার জজের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ব্যারিস্টার খোকনের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। সব সংবাদপত্রে ফলাও করে খবরটি প্রকাশ করা হয়েছে। মনে হচ্ছে যৌথবাহিনী এ যাত্রায় বিচারপতিকে কব্জা করতে পারেনি।
মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০০৮ দিন ৪৩৯শেখ হাসিনা তার মুক্তির বিনিময়ে সরকারের সাথে কোন কোন শর্তের ভিত্তিতে সমঝোতা করেছিলেন তা কেউ জানে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জাতীয় একটি স্বার্থকে বিলিয়ে দিতে আওয়ামী লীগ কখনোই দ্বিধাবোধ করে না।
নির্বাচন কমিশন এখন স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অথচ অন্তর্বর্তীকালীন এই সময়টাতে এমন নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া হয়নি। তাদের একমাত্র দায়িত্ব হলো সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা ।
বুধবার ২৫ জুন ২০০৮ দিন ৪৪০জরুরি আইন জারির অব্যবহিত পরে উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অবঃ) এম.এ. মতিনের নেতৃত্বে ‘গুরুতর অপরাধ দমন সংক্রান্ত’ স্বঘোষিত একটি কমিটি গঠন করা হয়। এটি গঠনের পেছনে আইনি ভিত্তির কোনো বালাই ছিল না এবং এর কাজ ছিল। দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের নামের তালিকা পত্রিকায় প্রকাশ করে তাদের চরিত্রহনন করতঃ উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিশনের কাছে পেশ করা। সরকার তার নিজস্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আইনবহির্ভূতভাবে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করে প্রচারণায় লিপ্ত হয় যা নিতান্তই ছিল। দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা ও কর্তৃত্বের পরিপন্থি। এযাবৎ ওই কমিটি অনুরূপ চারটি তালিকা প্রকাশ করেছে এবং তালিকাভুক্ত অনেককে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের অধীনে ক্যাঙ্গারু কোর্টে বিচার করে সাজাও প্রদান করা হয়েছে।
কিন্তু আজ সব সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে যে, একই উপদেষ্টা জেনারেল মতিন (অবঃ) প্রচার মাধ্যমের কাছে স্বীকার করে নিয়েছেন, যেহেতু তার সেই তথাকথিত কমিটি আইন বহির্ভূত ছিল সেই জন্য সেই কমিটির কাজ স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে দেশে দুর্নীতিসংক্রান্ত সকল কাজকর্ম দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমেই পরিচালিত করা হবে। কি আশ্চর্য এবং হাস্যকর একটি ঘটনা! এতোদিন যাবৎ সরকারের সবচাইতে ক্ষমতাধর কমিটি হিসেবে এই কমিটিই বাজনীতিবিদদের ধ্বংস সাধনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে এবং দুর্নীতিবাজদের তালিকা প্রকাশ করা ছাড়াও জনসমক্ষে তাদের চরিত্রহননের জন্য সবরকম পদক্ষেপ গ্রহণে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছে। অথচ সেই মতিন আজ নিজেই বলছেন যে, তার কমিটি ছিল অবৈধ অর্থাৎ কাজ করছিল অবৈধভাবে। অর্থাৎ এতদিন যাবৎ কমিটি যা করেছে তার সবই ছিল অবৈধ এবং কমিটির সকল কাজকর্ম ও এ যাবৎ দেওয়া বিচার ও সাজা এখন অবৈধ কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। তাহলে এ কমিটি রাজনীতিবিদ ও জাতির যে বিপুল সামাজিক ও আর্থিক ক্ষতিসাধন করেছে তার ক্ষতিপূরণ বহন করবে কারা? ঠিক এভাবেই বর্তমান সরকার দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে যাচ্ছে একের পর এক।
বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০০৮ দিন ৪৪১বেগম জিয়ার সাথে দেনদরবার অব্যাহত রয়েছে। নাইকো মামলায় এজলাসে আমি ছিলাম তার পাশে। চিকিৎসার জন্য তাঁর দুই ছেলেকে বিদেশ পাঠানো না হলে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে কোনো আলোচনায় তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আমার সাথে আলোচনার সময় ঠিক এমনটিই ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি ।
তথাকথিত সংলাপ অনুষ্ঠান এবং রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করে সরকার জনগণের দুঃখদুর্দশা থেকে প্রচার মাধ্যমকে আড়াল করে রাখতে একরকম সফলই হয়েছে বলা চলে। এখন ক্ষুধা, দারিদ্র, জনগণের অনাহারে মৃত্যু, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ক্রমাবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ইত্যাদি সংবাদপত্রের পাতায় প্রায়ই দ্বিতীয় মাত্রার অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ।
শুক্রবার ২৭ জুন ২০০৮ দিন ৪৪২আজ প্রথমবারের মতো গোপন বার্তাবাহকের মাধ্যমে আমি লন্ডনে আইন বিষয়ে অধ্যায়নরত আমার মেয়ে আনার একটি চিঠি পেয়েছি। ৯ জুন তারিখে ই-মেইলের মাধ্যমে আমাকে উদ্দেশ করে ইংরেজিতে লেখা সুদীর্ঘ এই চিঠিটিতে আনা লিখেছে, “আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা বজায় রেখো। এটা সত্যি ভালো একটা সিদ্ধান্ত যে, তুমি সবসময় ইতিবাচকভাবে চিন্তা করছো (ইতিবাচক চিন্তা ও বিশ্বাস ইতিবাচক ফলাফল এনে দেয়। প্রকৃতির আইনের এটাই চিরন্তন ও সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য)। আমি তোমাকে বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী ও সৎ পিতা হিসাবে ফাদার্স ডে’র (রোববার ১৫ জুন) শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। নিজস্ব চেতনাকে সবসময় ইতিবাচক শক্তি দিয়ে পারিপার্শ্বিকতার ঊর্ধ্বে স্থান দিও” ইত্যাদি।
আনার অন্তর্নিহিত গভীর অনুভূতির প্রতিফলনমূলক চিঠিটি পড়ে গর্বে বুক ভরে গেল আমার।
শনিবার ২৮ জুন ২০০৮ দিন ৪৪৩আমানের ক্ষেত্রে ঘটনা অন্যরকমের। লেখা ও পড়ার ক্ষেত্রে তার উৎসাহ সুপ্রচুর। অথচ সেই ক্ষমতা তার নেই। অংকের কোনো ধারণা তার নেই। বাংলা লেখা বা পড়া সে শেখেনি। ইংরেজিতে তার শব্দচয়ন অত্যন্ত সীমিত। প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও নিজের মনের ভাব সে বাক্য দিয়ে প্রকাশ করতে পারে না। নিজের সবকিছু ডায়েরিতে লিখে রাখতে তার আগ্রহ প্রবল, অথচ কাজটি তার জন্য খুবই কঠিন। কলমটাকে মুঠোর মধ্যে সে ধরে রাখে অনেক শক্ত করে, কারো কাছ থেকে বানানের সাহায্য নিয়ে থাকা ধীরে ধীরে সে একটি একটি করে শব্দ আয়েশসাধ্য প্রচেষ্টায় লিখে শেষ করতে পারে। লেখা শেষ হয়ে গেলে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার চেহারা, চোখেমুখে দেখা যায় এক মহাসন্তুষ্টির ছাপ। শুভেচ্ছা কার্ড পাঠানোর সময় সে কেবল লেখে, 'ডিয়ার ড্যাডি। লাভ ফ্রম আমান। ব্যস, এই পর্যন্তই। আমান সব ব্যাপারে আমাকে কপি করার চেষ্টা করে, অনেকটা অজ্ঞাতসারে। নামাজের সময়বোধ, শৃঙ্খলা, পরিছন্নতা, পোশাকপরিচ্ছদ, আচার আচরণে আমার মতোই তার অভ্যাস। তার শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তার এসব স্বভাব আমাকে মুগ্ধ করে। আমি যদি তাকে সামান্য একটু সময় দেই, সঙ্গ দেই তাতেই সে মহাখুশি। আমান আমার জীবনে সূর্যের দীপ্তি । তার মুখের সামান্য হাসি, তার সামান্য সুখ ও পরিতৃপ্তি আমার দেহমনে বিস্তার করে দেয় এক স্বর্গসুধা!
(চলবে..)