আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার (আইএলও) উদ্যোগে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস প্রথমবার পালিত হয় ২০০২ সালের ১২ই জুন। তারপর মোটের উপর কুড়ি বছর পেরিয়ে গিয়েছে। শিশুশ্রম প্রতিরোধ দূরে থাকুক, বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে শিশুদের সামগ্রিক পরিস্থিতি আরও নাজুক ও ভয়াবহ হয়েছে। বিশ্বময় দেখা যাচ্ছে, শ্রম জর্জরিত শিশু মুখের করুণ, মলিন, বেদনাদীর্ণ ছবি।
২০২০-২১ সময়কালে চলমান করোনার আর্থ-সামাজিক, স্বাস্থ্যগত বিপদের মুখে শিশুশ্রম প্রতিরোধের বদলে লাফিয়ে বেড়েছে শিশুশ্রমের প্রথা। পরিবার-পরিজন হারিয়েছে লক্ষ লক্ষ শিশু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হু হু করে বেড়েছে এতিম শিশু। যাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। শ্রমবাজারে কিংবা যৌনপল্লীতে পাচার হওয়ার বিপদ ঝুলছে এসব শিশুর ভাগ্যে।
ভারতে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে অনাথ শিশুদের দত্তক নেওয়ার জন্য। আর্থিক কারণে পড়াশোনা ছেড়ে নিজের ও পরিবারের জীবন বাঁচাতে লড়তে হচ্ছে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার হাজার হাজার শিশু-কিশোরকে।
২০২১ সালের ১২ই জুন আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম বিরোধী দিবসকে সামনে রেখে যে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে।, তার পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৮ মিলিয়ন। শুধু তাই নয়, বিগত ২০ বছরের মধ্যে এই প্রথম বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমিকের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
করোনা অতিমারীর কারণে লকডাউন শুরু হতেই বন্ধ হয়ে যায় সমস্ত স্কুল। এক বছর পেরিয়ে গিয়েও বেশিরভাগ দেশে শিক্ষাব্যবস্থা থমকে রয়েছে। অনলাইন পড়াশোনার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত অধিকাংশ পড়ুয়া। সেইসঙ্গে হানা দিয়েছে প্রবল আর্থিক সংকট। অভিভাবকদের অনেকেরই রোজগার বন্ধ। স্থায়ী জীবিকা ছেড়ে তাঁরা নিজেরাও যোগ দিচ্ছেন নির্মাণ প্রকল্পে বা অন্যান্য নানা অস্থায়ী কাজে। সেইসঙ্গে তাঁদের সন্তানরাও যোগ দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সরকার শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই অভিযোগ তুলছে ইউনিসেফ।
২০০০ সালে সারা পৃথিবীজুড়ে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৪৬ মিলিয়ন। তখন থেকেই শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার শুরু করে ইউনিসেফ। ফলস্বরূপ প্রতি বছর সংখ্যাটা একটু একটু করে কমতে থাকে। ২০১৬ সালে সংখ্যাটা এসে দাঁড়ায় ১৫২ মিলিয়নে। এরপর আর সেভাবে হ্রাস না পেলেও কোনো বছরই সংখ্যা বাড়েনি। কিন্তু ২০২০ সালে ১৬০ মিলিয়ন শিশুশ্রমিকের তথ্য এসে পৌঁছায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের হাতে। হাত ঘুরে যা এসেছে আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম বিরোধী দিবসের প্রাক্কালে প্রকাশিত রিপোর্টে।
দুঃখজনক বিষয় হলো, ২০২১ সালকে আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর হিসাবে আগেই ঘোষণা করেছিল জাতিসংঘ এবং সেইসঙ্গে ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ বিলোপ করার লক্ষ্যমাত্রাও গৃহীত হয়েছিল। করোনার ফলে পুরো পরিকল্পনা থমকে গিয়েছে। বরং পরিস্থিতি হয়েছে আরও মারাত্মক।
ইউনিসেফের বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুশ্রম ঘৃণ্য প্রথা হলেও আজ বিশ্বের বহু শিশুর কাছে সেটাই বেঁচে থাকার সম্বল। করোনা পরিস্থিতি সমস্যাটি আরও ঘনিয়ে তুলেছে। গতবছরের চেয়ে এ-বছর অর্থনীতির অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও শিশুশ্রমিকের সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে সামগ্রিকভাবে সরকারি ও বেসরকারি পরিসরে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে পরিস্থিতি হয়ত সামাল দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু করোনা প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত দেশগুলোর পক্ষে আলাদাভাবে শিশুশ্রম প্রতিরোধের জন্য আর্থিক বরাদ্দ ও মনোযোগ দেয়া আদৌ কতটুকু সম্ভব হবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণার তথ্যানুযায়ী, করোনা মহামারিতে এখনও পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৩৮ লক্ষের কাছাকাছি মানুষ। প্রিয়জন হারানোর শোক ছেয়ে ফেলেছে গোটা বিশ্বকেই। তবে সবচেয়ে বিপর্যস্ত হয়েছে শিশুরা। প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে ওঠার আগেই মহামারিতে অভিভাবকদের হারানো ভয়ঙ্করভাবে তাদের পরিচালিত করছে হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতার দিকে। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত আরেকটি সমীক্ষায়।
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে 'জামা পেডিয়াট্রিক্স' পরিচালিত এক গবেষণা সমীক্ষায় দাবি করা হয়, শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে মহামারির কারণে বাবা-মায়ের মধ্যে অন্ততপক্ষে একজন অভিভাবককে হারিয়েছে অনূর্ধ্ব ১৫ বছরের ৪৩ হাজার শিশু। কেউ কেউ আবার দু’জনকে হারিয়েই সম্পূর্ণ অনাথ। তবে অভিভাবকবিয়োগের এই ঘটনা সবথেকে বেশি প্রকট কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যেই। এমনই জানাচ্ছে মার্কিন সংস্থাটির গবেষণা।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর মার্কিন দেশের বিভিন্ন প্রদেশে নানান কারণে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে গড়ে ৩৪ হাজার শিশু। এবার শুধুমাত্র মহামারির কারণেই সেই সংখ্যাটা পৌঁছেছে ৪৩ হাজারে। ফলে ভয়াবহ এক পরিস্থিতির সম্মুখীন যুক্তরাষ্ট্র। রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ১২ জন মার্কিন শিশুর মধ্যে ১ জন অভিভাবকহীন হয়েছে কোভিডের জন্য। উপযুক্ত সময়ে কোভিডের ভ্যাকসিনেশন শুরু না হলে, এই সংখ্যাই তিনগুণ হত বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্টোন ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কিডম্যানের জানাচ্ছেন, এক ধাক্কায় হঠাৎ অভিভাবকহীনতার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়া ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলতে চলেছে সমাজে। এই ঘটনা যে শুধু শিশুদের হতাশার দিকেই ঠেলে দিচ্ছে তা নয়; বরং তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে আত্মহত্যা কিংবা মৃত্যুর সম্ভাবনাও। ইতিমধ্যেই এমন একাধিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে মার্কিন দেশ। মাস কয়েক আগেই কোভিডে পিতৃবিয়োগের পর আত্মহত্যা করে এক মার্কিন কিশোর। তা নিয়ে রীতিমতো সাড়া পড়ে গিয়েছিল দেশজুড়ে।
সেইসঙ্গে একাডেমিক সমস্যাও গুরুতর চেহারা নিতে চলেছে আগামীদিনে, এমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকের পরিবার উপার্জনহীন হয়ে পড়ায়, পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াই দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে কোভিড পরিস্থিতিতে। ৯/১১ হামলার পর যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল মার্কিন সরকার বর্তমানে ঠিক সেভাবেই জরুরি তৎপরতায় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁরা। পাশাপাশি বাবা-মা হারানো শিশুদের শনাক্ত করে, তাদের মানসিক কাউন্সিলিং-এর জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করাও বিশেষ জরুরি বলে অভিমত তাঁদের।
সাম্প্রতিক এই রিপোর্ট ও বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবসের আগে আগে প্রকাশিত রিপোর্ট প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে গোটা বিশ্বকে। শুধুই কি আমেরিকার? প্রতিটা দেশেরই বাস্তব ছবি হয়তো এমনটাই। কিংবা আরও ভয়াবহ। এসব ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা কতটুকু? সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। পাশাপাশি শ্রমবাজারের কঠোর নিগড় থেকে শিশুদের বাঁচাতে রাষ্ট্র ও সমাজের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে।
শিশুদের বিপদ বৃদ্ধি ও অধিক হারে শ্রমে যুক্ত হওয়ার করোনাকালীন সঙ্কটজনক পটভূমিতে মানব পাচার চক্রের হাতে আরও বেশি সংখ্যক শিশুর ভাগ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। শিশুদের শ্রমদাস ও যৌনদাস হিসেবে বিক্রির ঘটনাও চলমান শিশু-অবান্ধব ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। বিশ্বের দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সচেতন ও উদ্যোগী না হলে করোনাকাল বিপন্ন মানুষ, সমাজ ও অর্থনীতির মতোই বিশ্বের শিশুদের ললাটেও লেপন করতে পারে ঘোরতর বিপদের অন্ধকারাচ্ছন্ন অমানিশার অধ্যায়।