× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার , ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮৪) /কারাজীবন দুঃসহ এবং তা কেবলমাত্র নিজের জন্য নয়, পরিবারের জন্যও

বই থেকে নেয়া

স্টাফ রিপোর্টার
২৪ জুন ২০২১, বৃহস্পতিবার

শনিবার ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫৩৪
আজ মেডিক্যাল বোর্ড আমাকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করেছে। বিশিষ্ট সব অধ্যাপকই উপস্থিত ছিলেন। আমার সব রিপোর্ট এবং টেস্ট রেজাল্ট তারা পরীক্ষা করেছেন এবং আমাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি এর ওপর একটি রিপোর্ট তৈরি করা হবে। তাদের সবার কাছে আমি অশেষ কৃতজ্ঞ।
আজ ছিল দর্শনার্থীদের সাক্ষাতের দিন। আসমা, নাফিসা, খুবী, শহীদ, ফরিদ এবং রুশো এসেছিল আমাকে দেখতে।

রবিবার ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫৩৫
আজ ছিল লায়লাতুল কদর। এদিন মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ দান পবিত্র আল-কোরআন নাজেল হয়। এ রাতের এবাদত হাজার মাস অর্থাৎ ৮৩ বছর ৪ মাসের এবাদতের সমান। জিবরাইল (আঃ) এদিন মানবজাতির আত্মার শান্তির পরশ নিয়ে ধরামাঝে নেমে আসেন।
একই উদ্দেশ্যে নেমে আসেন অন্যসব ফেরেশতারা। আমার বাবা তার লেখা কোরআন পরিচয় বইয়ে লিখেছেন যে, সূরা ইয়াসিন হলো কোরআনের হৃদয় ও আত্মা। এই রাতে কেউ সূরা ইয়াসিন পাঠ করলে আল্লাহ তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। আমি আজ এবাদতের সময় সূরা ইয়াসিন পড়েছি।

সোমবার ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫৩৬
মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশক্রমে আমাকে আরও ৮ থেকে ৯টি বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করাতে হয়েছে। আরও দু’টি এখনো বাকি, করা হবে ঈদের পরে।
ওবায়দুল কাদেরকে শেষ পর্যন্ত ভারতে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে দেয়া হয়েছে। সে যেতে পারায় আমি খুব খুশি হয়েছি। এতে শুধু সরকারের অসহযোগিতামূলক মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছে। তাহলে প্রথমে তাকে বাধা দেয়া হলো কেন? এর জবাব কেউ দিতে পারবে না।
হাসপাতালে থাকাকালে তরুণ চিকিৎসক ডা. জিয়া, ডা. জামিল ও ডা. হেলালের মতো লোকদের সেবা-পরিচর্যার কথা আমি ভুলতে পারবো না।
মাঝে-মধ্যে আমি নিজেকে দারুণভাবে দুর্বল অনুভব করি। সবসময় আমি এই ভেবে খারাপ বোধ করি যে, এবার আমি পুরো রমজান মাস রোজা রাখতে পারলাম না।

মঙ্গলবার ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ দিন ৫৩৭
গত ১৪ দিন ধরে আমার দুই নাতনি আলো ও সুমী আমার জন্য নাস্তা ও ৫-৬টি খবরের কাগজ নিয়ে আসছে এবং এরপর আবার দুপুরের খাবার নিয়ে আসছে বেলা একটায়। আমি মনে করি এতে করে তারা শুধু শারীরিকভাবে কষ্টই পাচ্ছে না এবং তদুপরি তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপরও এটা একটা বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই আমি তাদের আর নাস্তা ও পত্রিকা আনতে বারনই করে দিয়েছি। যত খারাপ মানেরই হোক, আমি হাসপাতালের দেয়া খাবারই খেয়ে নেবো। কেবল রাতের খাবার আসবে আমাদের গুলশানের বাসা থেকে। এতে করে প্রতিদিন পুলিশের নাজেহাল থেকেও আলো ও সুমী রেহাই পাবে। এমনকি আজো আলো ও সুমীকে বাইরে প্রায় ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছে এবং খাবার ভেতরে আনার জন্য তাদের পুলিশকে টাকা দিতে হয়েছে। এবার কাল থেকে এই পালা শেষ হবে।
গতকাল অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রবল প্রতিবাদের মুখে হাসিনার জন্য একটি জামিনের আবেদন হাইকোর্ট ডিভিশন খারিজ করে দিয়েছে। আজ দুর্নীতি দমন কমিশন খালেদা জিয়া এবং অন্যান্য মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনীত বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি প্রকল্পের মামলায় চার্জশিট দাখিলের অনুমতি দিয়েছে। এখন এদের সকলকে জামিনের জন্য আবেদন করতে হবে।
এই সকল মনোভাব কেবল নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পর্কে সরকারের সদিচ্ছার ব্যাপারে জনমনে সন্দেহকেই গাঢ়তর করে তোলে। এ সমস্ত আচরণ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সুষ্ঠু পরিবেশকেও বাধাগ্রস্ত করে।

বুধবার ১ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৩৮
আজ রমজানের শেষদিন। গতবছর এ সময় আমি ছিলাম কারাভ্যন্তরে। জানি না আগামী বছর এ সময় কোথায় থাকবো। এ বছর প্রথমবারের মতো অপারেশনের জন্য হাসপাতালে থাকায় আমি বাকি রোজা রাখতে পারিনি।
ছোটকাল থেকে আমরা জানি যে, সুদিনে অনেক বন্ধুর দেখা পাওয়া যায়, কিন্তু দুর্দিনে তাদের কারো দেখা পাওয়া যায় না। যারা সত্যিকারের বন্ধু, কেবল তারাই আশপাশে থাকে। এ এক মহাসত্য। ‘সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়, অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়।’
পুলিশ প্রহরীরা সবসময় টাকাপয়সা দাবি করে। আমাদের মধ্যে অনেকে উদার হস্তে টাকাপয়সা বিলাতে পারে, কিন্তু আমার মতো মানুষের জন্য তা একটু অসুবিধা সৃষ্টি করে। গার্ডরা বিশ্বাস করতে চায় না যে, ওদের মতো টাকাপয়সা আমার নেই।

বৃহস্পতিবার ২ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৩৯
রমজানের সারা মাস রোজার শেষে আজ সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। আমি আজ যারা গরীব, অবহেলিত, বঞ্চিত, অসহায় এবং ক্ষুধায় জর্জরিত তাদের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে আশীর্বাদ কামনা করি।
দর্শনার্থীদের জন্য আজকের দিনটি উন্মুক্ত। পরীবাগ মসজিদের ইমাম ছিলেন আমার প্রথম অতিথি। তার সুদৃশ্য সাদা পাগড়ি, কালো দাড়ি, গাঢ় চোখ ও গায়ে সোনালী বর্ডারের লম্বা কালো হিজাব পরিহিত আরবি যুবরাজের মতো জাঁকজমকপূর্ণ পোষাকে তিনি হাজির হয়েছিলেন। পরীবাগ মসজিদে ঈদের নামাজ পড়িয়েই তিনি ছুটে এসেছেন আমার কাছে। আমার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রতি শুক্রবার সেখানে আমি জুমআর নামাজ পড়তে যাই। পবিত্র এই দিনে তার আগমনকে আমি এক স্বর্গীয় আশীর্বাদ বলে মনে করি। আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও এলাকার লোকজনসহ শুভাকাক্সক্ষীরা দলবেঁধে আজ আমাকে দেখতে আসায় আমি মহা উৎফুল্ল।

শুক্রবার ৩ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৪০
রোজার ঈদের জন্য আজও ছিল দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। গতকাল যারা আসতে পারেনি, তাদের অনেকেই আজ এসেছে। তবে জোরাহ ও তার বোন আজও এসেছিল। অনেক খাবার নিয়ে এসেছে তারা সবাই। তা না হলে আজ খেতে হতো সাধারণ একটি দিনের মতোই।
আমার লেখার কাজ এগিয়ে চলেছে।

শনিবার ৪ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৪১
গত দু’দিন যারা আমাকে দেখতে এসেছে তাদের অধিকাংশই জানে না দেশে আদৌ কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি না। তাদের সন্দেহ, নির্বাচন হলেও তা হবে নিয়ন্ত্রিত ও সাজানো। তারা মনে করে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি একটি ধোঁকামাত্র। আজ ঈদের ছুটিজনিত কারণে তৃতীয় দিনের জন্য খবরের কাগজের প্রকাশনা বন্ধ। আজ বাটাইয়া ইউনিয়ন থেকে শাহাবুদ্দিন ও বাবুলের নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক কর্মী এসেছিল আমাকে দেখতে। খুব সকালে নোয়াখালী থেকে রওনা হয়েছিল ওরা, ফিরে যাবে আজই। প্রতিদিন সনি ও রিয়াদ এখানে এসে আমার বিছানায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত কেবিনের আশপাশে থাকে। আমার কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্য তাদের উদ্বেগের সীমা নেই। আমি চলে যেতে বললেও যেতে চায় না ওরা।

রবিবার ৫ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৪২
মেডিক্যাল বোর্ডের সকল সদস্যের সহযোগিতা ও সহানুভূতি এবং হাসপাতাল প্রশাসনের সুপারিনটেনডেন্ট ব্রিগেডিয়ার জহির উদ্দিনের একান্ত উদ্যোগে মেডিক্যাল বোর্ডের সবরকম আনুষ্ঠানিকতা শেষে এত অল্প সময়ে আমার জন্য রিপোর্ট প্রণয়ন করা সম্ভব হয়েছে। তাদের সবার কাছে আমি একান্তভাবে কৃতজ্ঞ। এ ব্যাপারে সুমন, হেলাল ও জিয়াউর রহমানের মতো তরুণ ডাক্তারদের অবদান ভোলার মতো নয়।
আজ পত্রিকা বের হয়েছে। সনি ও রিয়াদ সারাদিন ছিল আমার কেবিনের আশপাশে। আমাকে নানাভাবে সাহায্য করে ওরা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে বার্তাবাহক হিসেবে। অনেক খবরও নিয়ে আসে তারা বাইরে থেকে।
কেবিনের জন্য বরাদ্দকৃত খাবারও জঘন্য ধরনের, জেলখানার চাইতেও খারাপ। কিন্তু এখন আমার কোনো গত্যন্তর নেই। ফলে আমার ওজন হ্রাস অব্যাহত রয়েছে।

সোমবার ৬ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৪৩
প্রতিদিন আমার স্বাস্থ্য দুর্বলতর হয়ে চলেছে। গত এক মাসে আমার ওজন কমে প্রায় তিন পাউন্ড, যা সমূহ দুশ্চিন্তার কারণ। রক্ত, পেসাব ও আল্ট্রা সাউন্ড পরীক্ষার জন্য আজ আমাকে দুপুর অবধি অভুক্ত থাকতে হয়েছে। শরীর-স্বাস্থ্য ভালো না। থাকলে মনও ভালো থাকে না।
এবারের কারাজীবন দুঃসহ এবং তা কেবলমাত্র আমার নিজের জন্য নয়, আমার পরিবারের জন্যও। ড. হেলালের মাধ্যমে হাসনার কাছ থেকে একটি ই- মেইল পেয়েছি। আমাদের মধ্যে কন্যা আনা সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমার এই অবস্থার কারণে মেধাবী হলেও তার পড়াশোনার ফলাফলে অনেক অবনতি ঘটেছে।

মঙ্গলবার ৭ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৪৪
কেবিনে যে খাবার সরবরাহ করা হয় জেলখানার সেলে দেওয়া খাবারের চাইতেও পরিমাণগত ও গুণগত দিক দিয়ে খারাপ। জেলে ছিল আমাদের নিজস্ব চৌকি এবং বাবুর্চি। আমরা গরম খাবার ও টাটকা সবজির ব্যবস্থা করতে পারতাম। হাসপাতালে ব্যবস্থা অন্যরকমের। বেশির ভাগ সময়েই আসে ঠাণ্ডা ও বাসি খাবার। রান্না করা হয় এখান থেকে অনেক দূরে। অবশ্য দিনে দিনে আমি এখন তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি ।
আমার ব্লাড প্রেসার সবসময়ই ছিল স্থিতিশীল। এখন তা ওঠানামা করছে। এখন আমার প্রেসার ১৪০/১০০। সচরাচর আমার থাকে ১৩০/৮০।
ব্যারিস্টার খোকন এসেছিল আমাকে দেখতে। লন্ডনে থাকতে তারেক রহমান ও বেগম জিয়ার সাথে আলোচনার বিশদ বিবরণ সে আমাকে জানিয়েছে।
ইউরোপিয়ান ল’ ছাড়া অন্যসব পরীক্ষায় আনা খারাপ করেছে। এজন্য আমি তাকে দোষ দেই না।

বুধবার ৮ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৪৫
ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীর ছাড়া এখন আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাই জেলখানার বাইরে। ড. আলমগীরও খুব জলদি মুক্তি পাবেন। অথচ বিরাট সংখ্যা বিএনপির নেতারা এখনো জেলে। সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত পরিষ্কার। মূল আক্রমণ হলো বিএনপির ওপর।
হাইকোর্ট ডিভিশনে বেঞ্চ পুনর্গঠনের সময় মনে হচ্ছে সবকিছু করা হচ্ছে। সরকার তথা এটর্নি জেনারেলের ইচ্ছামাফিক। কোনো সিনিয়র বিচারপতিকে রিটের এখতিয়ার দেওয়া হয়নি। আগের ঐতিহ্য অনুযায়ী তাদের হাতে জামিন দেওয়ার ক্ষমতাও রাখা হয়নি। প্রথমে নতুন প্রধান বিচারপতিকে সজ্জন বলেই মনে হয়েছিল কিন্তু আসলে তিনি তা নন। পূর্বসূরির মতো তিনিও পদলেহন শুরু করেছেন। তবে বিচারপতি চাকলাদার যে দরজা খুলে দিয়েছিলেন, তা এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি একজন সৎ ব্যক্তি এবং এর জন্যই তার রয়েছে সৎসাহস। বুটম্যানদের ভয় করার তার কিছু নেই। কেবলমাত্র অসৎ বিচারকদের সাহস ও আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে।
ড. কামাল হোসেনের মতো লোকেরা এখন আর সুবিচার এবং আইনের শাসন নিয়ে কিছু বলছেন না। ২০০৬ সালে যারা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে প্রধান বিচারপতির আদালত বর্জন করেছিলেন এবং হাইকোর্ট বেঞ্চসমূহ পুনর্গঠনের প্রতিবাদে সুপ্রিম কোর্ট ভবন তছনছ করেছিলেন অনিয়মতান্ত্রিকভাবে, আজ তারা কিছু বলছেন না। কিন্তু কেন?

চলবে...
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর