× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

বজ্রপাত, আধুনিক প্রযুক্তি এবং তালগাছের সংস্কৃতি

মত-মতান্তর

খালিদ ফেরদৌস
২৫ জুন ২০২১, শুক্রবার

প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, পল্লীসাহিত্য, রসগুড়ের রসনাবিলাস ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় খুব ঘনিষ্ঠ উপাদান তালগাছ। গ্রাম-গঞ্জে মেঠোপথের সারি সারি তালগাছ, বাতাসে দোলখাওয়া বাবুই পাখির বাসা আমাদের হৃদয়কে সদা-আন্দোলিত করে। শুধু তাই না, এই তালগাছ আমাদের সুশীতল ছায়া দেয়, রস ও ফল দিয়ে ভোজনবিলাসীদের অসামান্য তৃপ্তি দেয়। আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তালগাছ প্রসঙ্গ টেনে আনাতে অনেকে এটাকে- ‘কার সাথে কী পান্তাভাতে ঘি’ হিসেবে ধরে নিতে পারেন। তবে চলমান সময়ে অধিক পরিমাণে বজ্রপাত তালগাছের সাথে আধুনিক প্রযুক্তির একটা যোগসূত্র স্থাপনের প্রয়াস পেয়েছে। কারণ গ্রামবাংলা ও সাহিত্যে স্বমহিমায় স্থান পাওয়া এই গাছটি যেন বজ্রপাত থেকে মানুষকে রক্ষায় ইসরাইলের তৈরি মিসাইল প্রটেকশন সিস্টেম ‘আয়রন ডোম’। এটা সিটিজেন সাইন্স। এই গাছটি মার্চ-এপ্রিলসহ বর্ষা মৌসুমে মানুষকে বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে।
এখন কথা হলো- এটার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কতটুকু? অথবা এটা দিয়ে কতটুকুইবা বজ্রপাত রোধ করা সম্ভব? অবশ্যই এটার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে এবং এটা দিয়ে বজ্রপাত রোধ করাও সম্ভব। তবে বর্তমানের বজ্রপাতের আধিক্যে এই গাছ বজ্রপাতরোধে পর্যাপ্ত নয়।

সাধারণত মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া, গরম বাতাস ও শীতল বাতাস পরস্পরের সংস্পর্শে এসে জলীয় বাষ্পের উপস্থিতিতে চার্জযুক্ত হয়ে বিদ্যুৎ চমকায় এবং কোনো কোনো সময় বজ্রপাতের কারণ হয়। যা উঁচুস্থানে আছড়ে পড়ে। এক্ষেত্রে গ্রাম-গঞ্জে তালগাছ সবচেয়ে বড় হওয়াতে সেখানেই বজ্রপাত হয়। এতে করে মানুষের প্রাণ বেঁচে যায়। কিন্তু বর্তমান যুগে এসে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থাকতে এই মান্ধাতার আমলের পদ্ধতির উপর নির্ভর করা কতোটা যৌক্তিক? অবশ্যই এটা অযৌক্তিক নয়। তবে একমাত্র এই পদ্ধতির উপর নির্ভর করা অনেকটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বজ্রপাত থেকে মানুষকে রক্ষায় প্রচুর তালগাছ রোপণ করা হোক- এটাতে কারও কোনো দ্বিমত নেই। তবে তালগাছ যেহেতু প্রাণহানি ব্যাপকমাত্রায় কমাতে পারছে না; এজন্য আমাদের অবশ্যই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। তথ্য নিশ্চিত করেছে, চলতি জুন (২০২১) মাসের প্রথম ৬ দিনে ৭২ জনের প্রাণ গেছে বজ্রপাতে। বিগত বছরগুলোতে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। গত এক দশকে বজ্রপাতে মারা গেছে দুই সহস্রাধিক মানুষ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, বজ্রপাতের দেশ ভুটানকে হটিয়ে বাংলাদেশ হয়ে যাচ্ছে বজ্রপাতে প্রাণহানির দিক থেকে প্রথমসারির দেশ। ইদানীংকালে অত্যধিক বজ্রপাত ও প্রাণহানির কারণ হিসেবে অনেকে মনে করছেন, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও মোবাইল নেটওয়ার্ক, ব্রিটিশ সরকারের স্থাপন করা বজ্রপাত প্রতিরোধক খাম্বা বা খুঁটি অপসারণ এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও দূষণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে প্রকৃতির খামখেয়ালি আচরণ।

আসলে বজ্রপাত জলীয়বাষ্প ও মেঘসৃষ্টির মধ্যবর্তী একটা প্রক্রিয়ার নাম। চলমান বজ্রপাতের আধিক্যকে ‘শর্ট লিফট লাইটেনিং ফেনোমেনা’ বলা হয়। মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে, পরিবেশ দূষণে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বজ্রগর্ভ মেঘমালা সৃষ্টির উপযুক্ত অবস্থা তৈরি হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় কিউমুলোনিম্বাস ক্লাইড সৃষ্টির পর বজ্রঝড় হয়। এটি খাড়াভাবে সৃষ্টি হয়ে বিশাল আকারের পরিচালন মেঘ জমে; যা শুধু বিদ্যুৎ চমকাতে সাহায্য করে না। এটির দ্বারা মুহুর্মুহু বাজপড়া, প্রবলবর্ষণ, শিলাবৃষ্টি, এলোমেলো বাতাস প্রবাহিত হয়। ক্ষেত্রবিশেষে ঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডোও তৈরি করতে পারে। আমরা ছোটবেলায় শুনেছি মেঘে মেঘে ঘর্ষণে বিদ্যুৎ চমকায় এবং মেঘ ডাকে। বিষয়টা আসলে এমন না। তবে এটা একেবারে মিথ্যা তাও বলা যাবে না। কারণ এটা আসলে ঠাণ্ডা বায়ু ও উষ্ণ বা গরম বায়ুর বিরূপ সম্পর্কের প্রতিফল; যে প্রক্রিয়া জলীয়বাষ্প ত্বরান্বিত করে। অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলে বাতাসের তাপমাত্রা ভূ-পৃষ্ঠের তুলনায় উপরিভাগে কম থাকে। যখন গরম হাওয়া হালকা হয়ে তড়িৎগতিতে উপরে উঠে যায়; তখন ঠাণ্ডা বা আর্দ্র বায়ুর সংস্পর্শ পায়। এমন সময় গরম বাতাস দ্রুত শীতল হবার প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে বজ্রমেঘ তৈরি করে বিদ্যুৎ চমকায় এবং বজ্রপাত হয়। যেমন কাঁচের গ্লাসে প্রচুর গরম পানি ঢাললে অনেক সময় প্রচণ্ড শব্দ করে গ্লাস ভেঙে পর্যন্ত যায়।

বজ্রপাতে আর একটা খুব সাধারণ ঘটনা হলো- কৃষিকাজে নিয়োজিতদের বজ্রপাতে বেশি মরতে দেখা যায়। এর পেছনের কারণ- এখন কৃষিকাজে উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। এসব যন্ত্রে বিদ্যুৎ আকর্ষিত হয়। ক্ষেতখামারে উঁচু স্থান না পেয়ে যন্ত্রপাতি লাগুয়া কৃষিকাজে নিয়োজিতদের উপর বজ্রপাত হয়। এইজন্য বজ্রপাতে অনেক কৃষকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। দুঃখের বিষয়- প্রতিবছর বজ্রপাতে অনেক মানুষের প্রাণহানি হলেও দেশের বজ্রপাত সুরক্ষা ব্যবস্থা অনেকটা তালগাছ নির্ভর। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে ‘জাতীয় দুর্যোগ’ ঘোষণা করে বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে ‘তালগাছ প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এই প্রকল্প ফলপ্রসূ হয়নি। একুশ শতকে এসে বজ্রপাত ঠেকাতে তালগাছ নির্ভরতা সত্যিই হাস্যকর। এরপর আবহাওয়া অধিদপ্তর বজ্রপাতের আগাম সংকেত দেবার জন্য ‘লাইটেনিং ডিটেকটিভ সেন্সর’ বসানোর উদ্যোগও আশানুরূপ ফল দেয়নি।

উল্লেখ্য, দেশবিভাগের আগে যেখানে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার এদেশের মানুষকে বাঁচাতে বজ্রনিরোধক খাম্বা বা খুঁটি বসিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় কতিপয় মানুষ ব্যক্তিস্বার্থে তা চুরি করে এই ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। যা হোক, এগুলো অতীত। নতুন করে জনগণকে বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচাতে তালগাছ নিয়ে টানাটানি বাদ দিতে হবে। পাশাপাশি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে মনোনিবেশ করতে হবে। চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়ার কথা বাদ দিলাম; আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা প্রযুক্তিবিদ্যায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়ে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে। মাইক্রোসফট কর্পোরেশন, ইন্টেল, গুগল, ইউনিলিভারসহ বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানে তাদের আধিপত্য। আর আমরা তালগাছ নিয়ে পড়ে আছি। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মান্ধাতার আমলের ব্যবস্থা বাদ দিতে হবে। সাথে সাথে ‘বিচার মানি কিন্তু তালগাছটি আমার’ এই সংস্কৃতি থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। এই তালগাছের মোহ শেষ না করতে পারলে বজ্রপাত প্রতি বর্ষা মৌসুমে আমাদের অনেকের প্রাণ কেড়ে নেবে। একইভাবে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহারে যদি উপযুক্ত মনোযোগ না দিই তবে আমাদের উন্নত দেশে পরিণত হবার প্রক্রিয়া শুধু দীর্ঘায়িতই হবে না; একটা পর্যায়ে আমরা পিছিয়ে পড়বো। তবে আশার কথা, বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন হতে চলেছে। দেশে হাইটেক পার্ক হচ্ছে, সেবা সহজ ও সুরক্ষিত করতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ডিজিটালাইজড করা হচ্ছে। দেশের নানাপ্রান্তে প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে। দেশ তৈরি পোশাক (আরএমজি) ও রেমিট্যান্স নির্ভরতা কমিয়ে প্রাইভেট কারসহ ভারী যান ও পণ্যসামগ্রী তৈরির পথে হাঁটছে।

যেহেতু প্রতি বর্ষা মৌসুমে বজ্রপাতে অনেক মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে; তাই সরকারের উচিৎ বজ্রপাত থেকে জনপদকে রক্ষায় তালগাছ নির্ভরতা কমিয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা। বজ্রপাতরোধে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা হলো, মোবাইল টাওয়ারের মতো স্থাপনায় লাইটেনিং ডিটেক্টর ব্যবহার করে ‘আর্লি এলার্মিং সিস্টেম’ চালু করা। এর মাধ্যমে আগে থেকেই যদি মানুষকে সতর্ক করা যায় তবে বজ্রপাতে প্রাণহানি অনেক কমে যাবে। এছাড়া আমাদের দেশের আবহাওয়ার উপযোগী করে বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যেমন- সবচেয়ে শক্তিশালী ও আধুনিক বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয় আকাশযানে। বজ্রনিরোধক খুঁটি ও পোল স্থাপন করে উন্নত বিশ্ব বজ্রপাতের ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে এনেছে। আমাদেরও একই পথ অবলম্বন করতে হবে। এছাড়া সম্ভাব্য বজ্রপাতের সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, গাছতলা, জানালার ধার থেকে সচেতনভাবে দূরে থেকে বজ্রপাত ও দুর্যোগে প্রাণহানি তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমিয়ে আনা যায়। সরকার ও জনগণের যৌথ উদ্যোগে পথের দু’ধারে ও পতিত জায়গায় তালগাছসহ অন্যান্য বনজ ও ফলজ বৃক্ষরোপণ করে ফল-ফসলের সবুজ শ্যামলিমাময় বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।

[লেখক: এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষক, গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ]
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর