শনিবার ২৫ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৬২ব্যারিস্টার খোকন জানিয়েছে, আমার স্ত্রী হাসনার শরীর ভালো যাচ্ছে না। গত ১৮ মাস ধরে তার চলছে নিদারুণ অর্থকষ্ট। আশ্রয়ের জন্য ঘুরছে একস্থান থেকে অন্যস্থানে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে। মানসিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাই তার স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। গত ১৮ মাসে আমান ওজন হারিয়েছে প্রায় ১০ পাউন্ড অথচ তার ক্ষুধা ও রুচি বরাবরই ভালো। যদিও সে তার মনের ভাব সবসময় প্রকাশ করতে পারে না, আমি নিশ্চিত যে, আমার বন্দিত্ব ও দুরবস্থা তার মনের ওপর দারুণ চাপ সৃষ্টি করেছে। আনার ক্ষেত্রেও হয়েছে একই অবস্থা। বাবার ওপর এ ধরনের নির্যাতন সন্তানদের ওপর নিদারুণ মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে যা আমাদের কল্পনার চাইতেও বেশি।
হাসনা, আমান ও আনা প্রতিনিয়ত যে মানসিক ক্ষত বহন করে চলেছে, অন্য কারো পক্ষে তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়।
রবিবার ২৬ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৬৩আমার বন্ধু ও বিশিষ্ট হাড় পরামর্শক ডা. জুনায়েদ সফিক জানিয়েছেন আমার অ্যাপেনডিসাইটিসের অবস্থা এতো খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, আর দু’ঘণ্টা দেরি হলে আমার বেঁচে থাকাই সম্ভব হতো না- অর্থাৎ মৃত্যুর এত কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম আমি। আমার জীবন বাঁচানোর জন্যই আল্লাহ্র করুণা বর্ষিত হয়েছে। এসব কাজে জেলে থাকা একজন ব্যক্তির জন্য প্রয়োজনীয় নানা রকম আনুষ্ঠানিকতা সারতে যেখানে সাধারণত এক সপ্তাহ সময় লাগার কথা, সেখানে ৭ ঘণ্টায় সব আনুষ্ঠানিকতা। সারার কারণেই জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।
ডা. দোলন জানিয়েছেন, পাঁচজন উপদেষ্টা বেগম জিয়ার সাথে দেখা করার সময় তিনি আমার মুক্তি দাবি করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে, একজন ক্যাপ্টেনের ক্ষমতা এখন পাঁচজন উপদেষ্টার সম্মিলিত ক্ষমতার চাইতে বেশি। কাজেই উপদেষ্টাদের কাছ থেকে কোনো আশ্বাস পেলেও তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা ঠিক হবে না। প্রফেসর সিরাজুল করিম ও ফিজিক্যাল মেডিসিনের প্রফেসর মাইনুজ্জামান এসেছিলেন আমাকে দেখতে। আজ সারাদিন বৃষ্টি চলছে।
সোমবার ২৭ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৬৪প্রতিনিয়ত যারা নারী অধিকারের কথা বলেন তারা নিজেদের বাড়িতে নারী। গৃহকর্মীদের কতটা সম্মান করেন তা আমার জানতে ইচ্ছা করে। গৃহকর্মীদের সঙ্গে তারা কেমন আচরণ করেন তা পর্যবেক্ষণ করা একটি চিত্তাকর্ষক বিষয় হতে পারে। দ্বিতীয়ত- মহিলা নেত্রীরা তাদের ছেলের বৌদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেন? অনেক সূত্র থেকে আমি জেনেছি যে, দেশের নেত্রীরা তাদের পরিবারের এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অন্য ঘরের মহিলাদের সঙ্গে তেমন সদ্ভাব দেখান না। তারা ভোগেন হিংসা ও আত্মশ্লাঘায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে তারা নিজেদের ছেলে সন্তানদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলেন।
আমানের স্ত্রী জোরাহও একজন ভুক্তভোগী। পরিবারে তার খুব একটা সম্মানজনক স্থান নেই। আমাদের অনেকে তাকে পছন্দ করে না। নিজের ছেলের স্ত্রী হলেও জোরাহ কোনোদিন মা হতে পারবে না এ কথা জানার পর থেকে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার সহসা আমাকে রেহাই দেবে না। প্রয়োজনবোধে ওরা আমার বিরুদ্ধে আরো নতুন নতুন মামলা দায়ের করবে এবং আমার মুক্তি বিলম্বিত করার জন্য আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও আমি যেমন ১৯৯১ সালে জেলখানায় থেকে নির্বাচন করে জিতেছিলাম, এবার হয়তো আমাকে আর সেভাবেও নির্বাচনে যেতে দেওয়া হবে না।
মঙ্গলবার ২৮ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৬৫আমার আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে। মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্ট থাকা সত্ত্বেও বিচারপতি আনোয়ারুল হক নাইকো মামলায় আমার জামিনের আবেদন গ্রহণ করেননি। অথচ একই বিচারক ১৫ দিন আগে একই রিপোর্টের ভিত্তিতে সম্পদের মামলায় আমাকে জামিন দিয়েছেন। এখন জামিন মঞ্জুর হলেও বেলবন্ড গ্রহণ করে জামিন সংগ্রহ করতে আমার ৫ থেকে ৭ দিন কিংবা আরো বেশি সময় লেগে যেতে পারতো। এর মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়ে গেলে আমাকে জেলের ভেতরে থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে জমা দিতে হবে। এক্ষেত্রে জেল কর্তৃপক্ষ টালবাহানা করে কাগজপত্র অনুমোদন করতে গিয়ে আরো সময় নিয়ে নিতে পারে, যাতে করে আমার মনোনয়নপত্র রিটার্নিং অফিসারের কাছে সময়মতো না পৌঁছে। ১৯৯১ সালে আমি জেলখানায় থাকাকালে এসব আনুষ্ঠানিকতা এত সহজে সম্পন্ন হয়েছিল যে, আমাকে কোনো সমস্যাই পোহাতে হয়নি। জেল কর্তৃপক্ষও ছিল অনেক সহযোগিতা মনোভাবাপন্ন। কিন্তু এখন প্রতি পদক্ষেপে হস্তক্ষেপ করছে সেনা অফিসারেরা। গত দুই বছরে সরকার দুঃশাসন ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ছাড়া জনগণকে আর কিছুই উপহার দিতে পারেনি। আমি জানি না এজন্য গোটা জাতিকে কতদিন এবং কী ধরনের মূল্য দিতে হবে।
বুধবার ২৯ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৬৬জেলখানা থেকে আমার ১০৬টি ফাইলে সংরক্ষিত তথ্যাদি হাসপাতালে এনে আমার বই লেখার কাজে ডেপুটি জেলার নাসের আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। ইতিমধ্যে আমি হাতে লিখে যে দু’টি বইয়ের পা-ুলিপি শেষ করে এনেছি সেগুলো নিজের কাছে পাওয়াটা ছিল এর মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এছাড়া ছিল এপ্রিল ২০০৭-এ জেলে আসার পর থেকে গতমাস পর্যন্ত আমার ফাইল ও পেপার ক্লিপিং। এখন আমি সব ফাইলপত্র বাছাই করে বইয়ের পা-ুলিপিসহ সবরকমের তথ্যাদি নিরাপদে রাখার স্বার্থে পাঠিয়ে দিয়েছি চেম্বারে। শুধু যেগুলো দরকার সেগুলোই হাসপাতালে রেখে দিয়েছি। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি মামলায় আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। এটা একটা শুভ লক্ষণ যে, দেশের উচ্চতম আদালত অনুধাবন করতে সক্ষম হচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। আদালতও এখন বাতাসের তালে তালে চলছে।
আমার জামিনের ব্যাপারে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
বৃহস্পতিবার ৩০ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৬৭আমি যে আশঙ্কা করেছিলাম তাই ঘটেছে। কোতোয়ালি থানায় আমার বিরুদ্ধে এফডিআর-এ আমার নিজের হাতে তৈরি করা কাগজপত্রে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ তুলে নতুন একটা মামলা দায়ের করা হয়েছে। ফলে আমার মুক্তির ব্যাপারটি এখন আরো বিলম্বিত হবে। উপরন্তু সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহা করে কেবলমাত্র বিএনপি’র সকল মামলায় জামিনপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদদের তাৎক্ষণিক মুক্তি রোধ করার জন্য নিবর্তনমূলক আটকাদেশের আইনটি ব্যবহার করে চলেছে। সভ্যতার সমস্ত আচরণবিধি লঙ্ঘন করে সরকার চালাচ্ছে যেন এক জঙ্গলের আইন।
নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত একটি পরিবেশ সৃষ্টি না করে সরকার তার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী কাজ করে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে সরকারের ভেতরে এমন একটা গ্রুপ এখনো সক্রিয় রয়েছে যারা এখনো নির্বাচনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করতে চাইছে। ফখরুদ্দীনের অধীনস্থ বেসামরিক সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নেই, নেই এসবের ওপর কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ। নির্বাচন শেষাবধি অনুষ্ঠিত হলেও তা সুষ্ঠু ও অবাধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আসলে তা হবে সামরিক কর্মকর্তাদের নিরাপদে প্রস্থান নিশ্চিত করার জন্য আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে আনার জন্য একটি নির্বাচন।
নির্বাচন কমিশন কাজ করছে কেবল সামরিক সরকারের তল্পিবাহক হিসেবে। নতুন আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। আজ ছিল রেজিস্ট্রেশন মঞ্জুরির শেষ দিন। রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করা ১১০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কেবলমাত্র একটিকে আজ পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে। অথচ রেজিস্ট্রেশন না দেওয়ায় কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতিও নিতে পারছে না। এভাবে নির্বাচন কমিশন নিজের প্রণীত নির্বাচনী আইনই ভঙ্গ করে চলেছে প্রতিনিয়ত।
শুক্রবার ৩১ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৬৮রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে তাদের মনোনয়ন, প্রার্থী তালিকা ও ইশতেহার প্রণয়নের জন্য কাজ শুরু করবে? নির্বাচন কমিশনের সকল কাজেই বোঝা যাচ্ছে যে, তারা অর্থবহ একটি প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিরুৎসাহিত করতে চায়। নির্বাচন কমিশনের হাবভাবে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দেশ এখন চরম অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তির সম্মুখীন।
হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগ শেখ হাসিনাকে জামিন মঞ্জুর করেনি। এ বড়ই আশ্চর্যজনক। আরো চমকপ্রদ খবর হলো- হাসিনার আর এক জামিনের ব্যাপারে হাইকোর্ট ডিভিশন বিভক্ত রায় দিয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন ২ নভেম্বরে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কি অসম্ভব অবস্থা চলছে।
(চলবে..)