× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

র‍য়েল বেঙ্গল টাইগার

মত-মতান্তর

গাজী মিজানুর রহমান
৫ জুলাই ২০২১, সোমবার

কয়েক শত বছরের ইতিহাস সহজে  মানুষ ভুলতে পারে না। তাই বহির্বিশ্বে এখনো ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশের লোককে অনেকে বলেন ‘ ইন্ডিয়ান ’। তবু যৌথ মালিকানা-সত্ত্বের  জীব-জগত আর জড়-জগতের মধ্যে  ‘বে অব বেঙ্গল’  ছাড়া আর একটা স্থানে ‘বেঙ্গল’  নামটা বেশ ভালোভাবে আছে। তা হচ্ছে  বেঙ্গল টাইগার। ‘বেঙ্গল টাইগার’  নামটা আমাদের জন্য একটু সুবিধের হয়েছে। আমরা তাকে জাতীয় পশু বানিয়েছি । জার্সিতে বাঘের ছবি নিয়ে আমাদের ক্রিকেটাররা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়ায়। এর ফলে  বাঘটার প্রতি বাংলাদেশের  মেধাসত্ত্ব নিয়ে আর কোথাও কোনো  প্রশ্ন ওঠে না।
অন্যদিকে  সুন্দরবন  জঙ্গলটা আমাদের ভাগে বেশি। সুন্দরবনের আয়তন  ১০০০০ বর্গ কিমি। তার মধ্যে ৬০০০ বর্গ কিলো মিটার  বাংলাদেশের অধীন । এই সুন্দরবনের গহীন অরণ্য রায়াল বেংগল টাইগারের সর্বাধিক প্রিয় মাতৃভূমি । তাই বাংলার সাথে নামটা মিলিয়ে উচ্চারিত হলে বাঘেদের কোনো আপত্তিও  থাকে না । তবে দিন দিন বাংলাদেশ অংশে যে ভাবে বাঘ কমে যাচ্ছে তাতে কবে না আবার বাঘের নাম পরিবর্তনের দাবি ওঠে ,  তা নিয়ে চিন্তিত হওয়া বিচিত্র কিছু নয় ।

বাংলাদেশের সুন্দরবনকে ৪ টি রেঞ্জে ভাগ করা হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার  বুড়িগোয়ালিনি, খুলনা জেলার চাঁদপাই এবং নলিয়ান, এবং বাগেরহাট জেলার  শরণখোলা রেঞ্জ । এই বনবিভাগ ১৮৬০ সালে বৃটিশ আমলের সৃষ্টি  । তার আগে ১৭৭২ সাল থেকে যশোর  জেলার  ও  ১৮৮২ সাল থেকে  খুলনা জেলার সাধারণ প্রশাসন  এই বনাঞ্চল দেখভাল করতো।  বন বিভাগ বাঘের বাপ-মা। স্বাধীন বাংলাদেশে  বাঘের বাপ-ময়েরা  সন্তান বাড়ানোর জন্য  দুটো  পরিকল্পনা করেছে একটা  ২০০৯-২০১৭ একশান   প্লান, আর একটা  ২০০১৮-২০২৭ একশান প্লান। কিন্তু বাঘ তো ক্রমেই কমে যাচ্ছে ! শেষ একশন প্লানের তথ্য  অনুযায়ী  ১৯৮২ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ-অংশে  ৪৫০ টি বাঘ  ছিল , আর  ২০১৫ এর গণনায়  মাত্র ১০৬ টি বাঘের অস্তিত্ব মিলেছে  ।  অন্যদিকে ভারতে বাঘের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে ।  

পৃথিবীতে বর্তমানে ছয় প্রজাতির  বাঘ   আছে। সাইবেরিয়ান বাঘ,  বেঙ্গল বাঘ, সুমাত্রা বাঘ,  মালয় বাঘ,  ইন্দোচীন বাঘ, এবং দক্ষিণ  চীন বাঘ। দক্ষিণ  চীন বাঘ বিলুপ্তির পথে । চীনের কবিরাজি ওষুধ বাঘের মৃত্যুর কারণ বলে অনেকের ধারণা ।  বাঘের হাড় , দাঁত, রক্ত-- এসব দিয়ে চীনারা   প্রথাগত চৈনিক  ওষুধ তৈরি  করে। তাই  দক্ষিণ-চীন  প্রজাতির বাঘ  প্রায় শেষ ।  এখন ভারতে ৩০০০ বাঘ,  রাশিয়ায় ৪০০,  ইন্দোনেশিয়ায় ৪০০ ,  মালয়েশিয়ায়  ২৫০ , থাইল্যান্ডে ২০০ , নেপালে ২০০ , ভুটানে ১০০ , এবং চীনে ৩০ টি  বাঘ আছে ।  সব মিলিয়ে পৃথিবীতে মোট  বাঘের সংখ্যা ৪০০০ এর মত । ১৯০০ সালে এই সংখ্যা ছিল এক লাখ।  যে তিনটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে তারা হচ্ছে – বালি বাঘ , জাভা বাঘ এবং কাস্পিয়ান বাঘ ।

বেঙ্গল  টাইগার যে শুধু বেঙ্গলে আছে , তা কিন্তু নয় । বাংলাদেশ,  ভারত, নেপাল, ভুটান এসব দেশে আমাদের মামারা  থাকে । সুন্দরবনে যারা কাঠ, মধু আর মাছ ধরতে যায় , তারা প্রাণটা  হাতের মুঠোয়  নিয়ে জঙ্গলে ঢোকে । বাঘকে তারা ভয় করে বলে সরাসরি বাঘের  নাম ধরে ডাকতে ভয় পায় ,   সম্মান করে   ‘মামা’  ব’লে ডাকে , যাতে রক্তসম্পর্কের  আত্মীয় ভাগ্নের উপর ওরা  হালুম  করতে  না আসে । কিন্তু মামাদের দয়ামায়া কম ।   আবার  ভাগ্নেদেরও  দয়ামায়া যে  খুব বেশি তাও বলা যায় না ।  সুযোগ পেলে একজন-আরেকজনকে ঘায়েল করে দেয় ।  প্রতিবছর কেউ না কেউ মামাদের থাবায় ধরাশায়ী হয় , কেউ নিহত হয় , কেউ হয় আহত । আহতরা মামার থাবার স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে । অন্যদিকে পাচারকারী চক্রের হাতে প্রতিবছর নিহত হচ্ছে অনেক বাঘ ।

বাঘ বাঙালির কাছে এক অতি প্রিয় জন্তু । সমগ্র ভারতবাসী একে ভালোবাসে । রূপকথার গল্প , শিশুতোষ গল্প , আর রোমাঞ্চকর কাহিনীর অনেকখানি রয়াল বেঙ্গল টাইগারের দখলে । সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে কেটে মানুষ ক্রমে বনের দিকে এগিয়েছে আর বাঘ হয়েছে মানব-বসতির প্রতিদ্বন্দী । মানুষ জীবিকার জন্য যায় জঙ্গলে আর বাঘ লোকালয় কাছে পেয়ে হানা দেয় বসতির গ্রামগুলিতে । এই খেলা চলছে বহুকাল ধরে । বাঘের সাথে মানুষের মল্লযুদ্ধের কেচ্ছেগুলি সুন্দরবন সংলগ্ন জেলাগুলির নিজস্ব ঐতিহ্য সম্পদ । সেই রোমাঞ্ছকর গল্পের ভেতরে বাঘ মানুষের শত্রু নয় , এক সমীহ জাগানো প্রতিদ্বন্দী মাত্র । তাই তো বাঘের নামে নাম রাখতে পারলে বাঙালির খুশির সীমা থাকে না । শুধু বাঙালি কেন বলি?  মারাঠা নেতা শিবাজির তরবারির নাম ছিল বাঘনখ । শিবাজীকে শায়েস্তা করতে  বিজাপুর সুলতান  তার সেনাপতি আফজাল খানকে প্রেরণ করেছিলেন। কোলাকুলি  করার অছিলায় ৬ ফুট ৭ ইঞ্চি লম্বা  আফজাল খান যখন শিবাজীকে  বুকে জাপটে ধরেছিলেন , তখন   শিবাজি  বুঝে ফেলেছিলেন  যে ,  এটা কোনো বন্ধুত্বের আলীঙ্গন নয় । সুচতুর শিবাজীর  হাতের মুঠোয় লুকানো ছিল  তরবারি , আর বুকে পরা ছিল বর্ম । আফজাল খান তরবারি চালালে তা বিফল হয়ে যায়  , কিন্তু  শিবাজির বাঘনখ বিদীর্ণ করে আফজাল খানের পেট । ‘বাঘনখ’  একটি উপযুক্ত নামই  বটে !  

বেঙ্গল টাইগার ঘন্টায়  ৪০ মাইল দোড়াতে পারে। তবে দুনিয়ার সব প্রাণীকে সৃষ্টিকর্তা  কোনো না কোনোভাবে পুষিয়ে দিয়েছেন, আবার কোনো না কোনোভাবে খাটো করে রেখেছেন । উন্মুক্ত মাঠে হরিণের সাথে   দৌড়াতে গেলে  তাড়াতাড়ি  হঁফিয়ে যায় বাঘ । কিন্তু হরিণের শিংগুলি তাদের নিজেদের দৌড়ানোর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বলে ধরা পড়ে যায়। বাঘের লালায় একপ্রকার নিরাময় থাকে । হরিণের শিং বা সজারুর কাঁটার খোচায় আহত হলে  বাঘ যদি ক্ষতস্থান চাটতে পারে , তাহলে সহজে  ক্ষত শুকিয়ে যায় । কিন্তু এমন স্থানে যদি ক্ষত হয় যেখানে বাঘ  চাটতে পারে না, তাহলে তাদের  বিপদ ঘনিয়ে আসে  ।  আহত হলে  আর  ঘা  না  শুকালে বাঘ  পাগলের মত আচরণ করে।  তখন তারা মানুষ খেতে শুরু করে। বন বিভাগ তখন জিম করবেটের মত শিকারীদের ডাকতো আগে। জিম করবেট ছিলেন সেনাবাহিনীর কর্নেল । শিকারের অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লিখে তিনি   বিখ্যাত হয়েছেন। তার  ‘ ম্যান ইটারস অব কুমায়ুন’ নামের বই  বিশ্বে সাড়া ফেলেছিল । এই কুমায়ুন বর্তমান  উত্তরখন্ড  প্রদেশের একটি প্রশাসনিক বিভাগ। ঠিক এভাবেই সুন্দরবন বন বিভাগ  বাঘ দমন করতে পচাব্দী গাজীকে ডেকে নিত। সাহসী পচাব্দী  গাজী সাতক্ষীরা এলাকার সুন্দরবনের  জঙ্গলে এরকম বহু পাগলা বাঘ হত্যা করে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। পচাব্দি গাজী এলাকার মানুষের স্মৃতিকথায় কিংবদন্তী হয়ে আছেন ।

কথাশিল্পী   হেকটর হিউ  মানরো বৃটিশ ইন্ডিয়ান পুলিশের নন-কমিশন্ড পদে কাজ করে ইন্ডিয়া সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তিনি ‘সাকি’ ছদ্মনামে গল্প লিখতেন। ‘মিসেস প্যাকলেটাইডস টাইগার ‘ নামে লিখিত  তার একটি  গল্পে লেখক সাকি  সে সময়কার  বৃটিশ নারী-সমাজের  মধ্যে খ্যাতির প্রতি আকর্ষণ  আর  অন্তঃসারশূন্য  চাটামবাজিকে শ্লেষাত্মকভাবে  ফুটিয়ে তুলেছেন । এটা করতে গিয়ে  তিনি আমাদের শ্রদ্ধা-জাগানিয়া  বাঘকে একটু খাটো করেছেন। গল্পটা এরকম যে,  প্রতিদ্বন্দ্বী  লুনা বিম্বারটন যখন  বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করে  ফটর-ফটর করা শুরু করলেন, তখন  লণ্ডনের ললনা-সমাজে নাম করতে মিসেস প্যাকলেটাইডের একটা বাঘ শিকারের  অভিজ্ঞতা  দরকার হয়ে পড়লো।  ভুললে চলবে না যে, সেটা বিংশ শতকের প্রথম দিককার কথা, আর  তখনকার দিনে বিমান এখনকার মত এত  ডালভাত ছিল না। তাই ভারতে এসে বাঘ শিকার করতে  মনস্থির করলেন  মিসেস প্যাকলেটাইড।  তিনি  একটা বাঘ মেরে তার সাথে ছবি তুলে বিখ্যাত হয়ে গেলেন। তবে  গ্রামবাসীরা  যে বাঘটিকে শিকার হিসেবে  কায়দা করে মনোনীত   করেছিল , সে একটা অতি বৃদ্ধ এবং দুর্বল হৃৎপিণ্ডের অধিকারী বাঘ ছিল । বন্দুকের  গুলির শব্দ শুনেই   সে হার্ট ফেইল করে মারা যায়  , আর  মিসেস প্যাকলেটাইডের গুলি বাঘকে মিস করে টোপ হিসেবে বেঁধে রাখা ছাগলটাকে মেরে ফেলে। একথা কেউ না জানলেও তার ভাড়াটে সহকারী  মিস মেবিন জানতেন। আর তাই তার মুখ বন্ধ রাখতে একটা বাড়ি কিনে দিতে হয়েছিল যশ-প্রত্যাশী  মিসেস প্যাকলেটাইডকে। এই গল্পে মানরোর স্যাটায়ারের লক্ষ্যবস্তু বাঘ নয় , নারী-সমাজের উদ্ভট আচরণ।  তাই  বেঙ্গল টাইগারকে অসম্মান করার জন্য  মানরোকে ক্ষমা করা যেতে পারে।  

বাঘ আর সিংহের লড়াই প্রাচীন রোমান সম্রাটদের আমল থেকে একরকম  হৃদয়হীন খেলা হিসেবে চলে আসছিল । রেফারিদের রেকর্ড  অনুযায়ী   বাঘের জয়লাভের ঘটনা বেশি। শরীরের ওজন আর বড় বড়  নখ বাঘের দিকের পাল্লাকে ভারী করে রাখে । অন্যদিকে বড় বড় দাঁত সিংহের কৌশলগত অবস্থান পাকাপোক্ত করে। সিংহেরা দল্বদ্ধভাবে শিকার করে । বাঘের মধ্যে সেরকম দলীয় মনোবৃত্তি নেই । লন্ডনের চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ  এক রয়াল বেঙ্গল টাইগারের নাম রেখেছিল ‘ নিনা সাহিব  ’। এই বাঘটিকে  অযোধ্যার নবাব চিড়িয়াখানায় উপহার দিয়েছিলেন । এ দেশে বাঘটির  নাম ছিল ‘গঙ্গা’।  ১৮৫৯ সালে বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় খবর বের হয়েছিল যে,  চিড়িয়াখানার  ‘নিনা সাহিব’  যুদ্ধে একটা  আফ্রিকান প্রজাতির সিংহকে  মেরে ফেলেছে। এটা  রোমান সম্রাটদের সময়ের মত আয়োজিত লড়াই ছিল না , ছিল একটা দুর্ঘটনা।  তবে বাঘ এবং সিংহের যুদ্ধের কথা মানুষ যতই বলুক, তারা একে-অপরের  কাছের লোক। ক্যাট ফ্যামিলির সবচেয়ে নিকটাত্মীয় । তাই এদের মধ্যে ক্রস-ব্রিডিং হতে পারে এবং হাইব্রিড বাচ্চা হয় । সিংহ বাবা আর বাঘিনী  মায়ের সন্তানকে বলে লাইগার । অন্যদিকে বাঘ বাবা আর সিঙ্গহী মাতার সন্তানকে বলে টাইগন। লক্ষ্য করলে দেখা যায় , নাম দেয়ার মধ্যেও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কাজ করেছে । বাবার নামটা আগে বসানো হয়েছে ।

গাজী মিজানুর রহমান
(সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট এবং লেখক )
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর