× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার , ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত- মতান্তর / দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্রনীতি

মত-মতান্তর

ডা: রফিকুর রহমান
২৮ জুলাই ২০২১, বুধবার

সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন ''গত ৪০ বছর ধরে বেইজিংয়ের সাথে আমাদের খুব স্থিতিশীল সম্পর্ক ছিল। চীন দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে গত এক বছর ধরে এই সম্পর্ক নিয়ে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে, কারণ চীন আমাদের সীমান্ত নিয়ে যে চুক্তিগুলো সই করেছিল তা পালন করেনি।'' মস্কোয় আয়োজিত ইনস্টিটিউট অব ওয়ার্ল্ড ইকোনমি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস-এর একটি আলোচনা সভায় একথা বলেন মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
 
বিষয়টি বিশ্লেষণের দাবি রাখে এই কারণে যে, গত ৪০ বছরের একটা  স্থিতিশীল সম্পর্ক কি কারণে গত এক বছর যাবত নষ্ট হতে চলল তার বিশদ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। জয়শঙ্কর অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার আরো সাতটি দেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক কেন নিম্নমুখী সে বিষয়গুলো নিয়ে মুখ খোলেনি।
ভারতের কি নিজস্ব মূল্যায়ন নেই যে, অতীতে সুসম্পর্ক থাকার পরেও কি বাস্তবিক রাজনীতির কারণে অধিকাংশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো ভারতের সাথে দুরত্ব তৈরি করছে এবং ভারত isolated হয়ে যাচ্ছে?

ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীতা, বিভাজনের রাজনীতি, সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক পররাষ্ট্র নীতিতে আধিপত্যবাদের প্রয়োগ, সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যা, নানা প্রতিবেশী দেশের সরকারের উপর পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাসহ নানাবিধ বিষয়গুলো যে অধিকাংশ  ক্ষেত্রে দায়ী সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিদেশে অর্থায়নে অনেক দেশের মেগা প্রকল্পগুলো শুধু ভারত রাজি হয়নি বলে পরিত্যক্ত হয়েছে। অতি সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা ভাইরাসের টিকার রাজনীতিতে ভারতের টিকা সরবরাহের ব্যর্থতা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে। একই সাথে ভারতের বাইরে দ্বিতীয় কোন উৎস থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে টিকা আমদানির বিরুদ্ধে  ভারতের চাপের বিষয়টিও এখন আলোচনায় আসছে।

বিজেপি একটি কট্টর দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল।
ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিজেপির হাত ধরে ক্ষমতায় আসেন ২০১২ সালে। ক্ষমতায় আসার পরপরই তিনি চমক সৃষ্টি করেন। তিনি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে অধিকতর সম্পর্ক উন্নয়নের আগ্রহ দেখান। তার অংশ হিসেবে প্রতিবেশী দেশের সরকার প্রধানদের মোদি শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেন। হানিমুন পিরিয়ড শেষ হওয়ার পর বোঝা যায়, বাস্তবতায় তার প্রতিফলন হয়নি; অধিকাংশ প্রতিবেশীর সাথেই সম্পর্ক বৈরিতার রূপ ধারণ করেছে। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক তলানীতে গিয়ে পৌঁছায়। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগী সংস্থা - SAARC কে অচল করে ফেলে। বাংলাদেশের সাথে সরকারী পর্যায়ে আন্তরিকতা বিহীন একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক থাকলেও সাধারণ মানুষের মাঝে তার প্রতিফলন নেই।

২০১৯ সালের জুন মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের অল্প সময়ের পরে এস জয়শঙ্কর মন্তব্য করেছিলেন যে, সার্কের অনেক  "সমস্যা" রয়েছে এবং তাই ভারত আগামী পাঁচ বছর বিমসটেকের (BIMSTEC-The Bay of Bengal Initiative for Multi-Sectoral Technical and Economic Cooperation ) দিকে অগ্রাধিকার দেখাবে। সেই বছরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় মেয়াদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে SAARC কে অকার্যকর করার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। উক্ত অনুষ্ঠানে বিমসটেক নেতারা উপস্থিত ছিলেন তবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদে মদদ এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ভারতের চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না।  SAARC কে অকার্যকর করে  বিমিসটেককে অগ্রাধিকার দেয়ার মধ্যেও তার প্রতিফলন পাওয়া যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ভারতের আঞ্চলিক পররাষ্ট্রনীতি ভুল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং বর্তমানে তা ভারতের জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত দিন দিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এই ধ্রুব সত্য এখন আফগানিস্তান প্রসঙ্গেও সমানভাবে প্রযোজ্য । যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোট এখন আফগানিস্তান থেকে প্রস্থানের প্রায় শেষ পর্যায়ে। তালেবানদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রকাশ্য একটা মধ্যস্থতার মাধ্যমে তাদের প্রস্থান ত্বরান্বিত হয়। বাস্তবতার নিরিখে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে আফগানিস্তানে শান্তি স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নে পাকিস্তানের সরাসরি সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। আফগানিস্তানের ভূ-রাজনীতিতে পরাজিত হওয়ার পর ভূ-অর্থনীতিতে সংশ্লিষ্ট থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্র নতুন  এক মহাপরিকল্পনায় একটি নতুন কোয়াড্রিল্যাটারাল কাঠামো তৈরি করেছে যার অংশীদার পাকিস্তান, আফগানিস্তান, উজবেকিস্থান এবং যুক্তরাষ্ট্র নিজে।

এদিকে পাকিস্তান এবং রাশিয়ার সম্পর্কে নতুন মেরুকরণ হয়েছে। গত মার্চ মাসে ইসলামাবাদে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে স্ট্র্যাটেজিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। রাশিয়ার সমসাময়িক বৈদেশিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো Greater Eurasian Partnership ( GEP)। এর মূল ভিত্তি হলো রাশিয়ার নেতৃত্বে গঠিত Eurasian Economic Union ( EAEU)। রাশিয়া গ্রেটার ইউরেশিয়ান পার্টনারশিপের মাধ্যমে পাকিস্তানকে যুক্ত করে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোডের প্রকল্প চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের কানেক্টিভিটি ব্যবহার করে গোয়াদার বন্দরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগর এর সাথে যুক্ত হবে। বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে চীন এবং রাশিয়ার যে বোঝাপড়ার সম্পর্ক তাতে এই কানেক্টিভিটি ব্যবহার করা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। চীনের বাইরে দুটি পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এই অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং কানেক্টিভিটির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবার জন্য পাকিস্তানের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়েছে।
ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন বিরোধী কোয়াড মেকানিজমে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার হলেও আফগানিস্তান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে  সম্পূর্ণ ভাবে এড়িয়ে গিয়েছে। কোয়াড মেকানিজমের  সম্পর্ক এখানে কাজ করেনি।

আফগানিস্তানে রাজনীতি এবং পরবর্তী শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের প্রশ্নে এখন তালেবানদের সাথে সরাসরি সংলাপ হচ্ছে রাশিয়া, ইরান, পাকিস্তান এবং চীনের সাথে। ভারত এই  প্রক্রিয়া হতে একদম বিচ্ছিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান দখল করার পর থেকে সুদীর্ঘ ২০ বছর ভারত তালেবানবিহীন আফগান সরকারের সাথে সম্পৃক্ত। ভারতের প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার সেখানে বিনিয়োগ আছে। অনেক মেগা প্রজেক্টের অঞ্চল তালেবান কর্তৃক দখল এবং নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় ভারতের লোকবল সেখান থেকে পিছু হটেছে। সেসব প্রকল্প গুলো এখন মৃতপ্রায়। ভারতের অনেক সংবাদমাধ্যম এবং অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আফগানিস্তান প্রশ্নে সরাসরি পাকিস্তান এবং তালেবানদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের আহ্বান জানিয়েছে।
পত্রিকান্তরে দেখা যায় ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বেশ কয়েক দফা অপ্রকাশ্য বৈঠক হয় ইউনাইটেড আরব আমিরাতে। বিস্তারিত প্রকাশিত না হলেও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে বলতে শোনা যায় কাশ্মীর প্রশ্নে ৩৭০ ধারা পূনর্বহাল না করলে ভারতের সাথে কোনো আলোচনা নয়।

কাকতালীয়ভাবে দেখা যায় সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদি কাশ্মীর নেতাদের নিয়ে এক অনির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হয়ে রাজ্যে নির্বাচনের আশ্বাস দেন এবং সেই সাথে বলেন উপযুক্ত সময় 370 ধারা পূনর্বহাল করে রাজ্যের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হবে। যদিও তিনি এ বিষয় নিয়ে নির্দিষ্ট কোন সময় উল্লেখ করেননি।

নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে সহিংসতা এবং নির্বাচনের প্রাক্কালে সকাল-সন্ধ্যা পাকিস্তান, চীন এবং বাংলাদেশকে নিয়ে বিষোদগার তাঁকে এই বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদকে উস্কে দেয়ার কারণে আরেক মৌলবাদী সংগঠন তালেবানদের কাছেও সে  বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।
ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরাপত্তার নামে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ভারতের চীন বিরোধী বলয়ে অবস্থানের কারণে যে সাম্প্রতিক সীমান্ত বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে আফগানিস্তানেও ভারতের ফিরে আসা জটিল হয়ে পড়েছে।

এর বাইরেও ভারতের বিরুদ্ধে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী মিলিট্যান্ট গ্রুপকে সহযোগিতার অভিযোগ আছে। ভারতের সাথে বেলুচিস্তানের সরাসরি সীমান্ত নেই। আফগানিস্তানের সাথে বেলুচিস্তানের সীমান্ত থাকায় ভারত আফগানিস্তানে অবস্থান করে বেলুচিস্তান মিলিট্যান্ট গ্রুপকে সহযোগিতা করে বলে পাকিস্তানের সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বাস করে। পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রশ্ন এবং চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের বিশাল অংশ এই অঞ্চলে হওয়ায় সংগত কারণেই আফগানিস্তানে ভারতের উপস্থিতি সীমিত হয়ে যেতে পারে।

আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক প্রভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অতিসম্প্রতি উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ -আরএসএসের প্রধান মোহন ভাগবত দি ইকোনমিক পোস্টের সাথে এক ভিডিও বার্তায় বলেন হিন্দু-মুসলিম আলাদা নয়, তারা এক। তিনি আরো বলেন “যে হিন্দু বলে এখানে কোনও মুসলমানের বাস করা উচিত নয় সেই ব্যক্তি হিন্দু নন”। মুসলমানদের প্রতি আরএসএসের নমনীয় মনোভাব হয়তো তালেবানদের কাছে মোদি সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর একটা কৌশল।

সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ভারত সরকারের পররাষ্ট্রনীতির নমনীয় অবস্থান দৃশ্যমান। পেশীবহুল পররাষ্ট্রনীতিকে এ অঞ্চলে ইউটার্ন  নিতে দেখা যাচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্র নীতির এমন নাজুক অবস্থা নিকট অতীতে আর দেখা যায়নি।

লেখক: চিকিৎসক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষক
[email protected]
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর