প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এমপি বলেছেন, মহামারি করোনা মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এ কারণে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে সবচেয়ে বেশি মুনাফা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ-সুবিধার কথা বিদেশিরা জানে না। তবে বিষয়গুলো জানাতে সরকার এবং বিদেশি মিশনগুলো কাজ করছে। আশা করছি, আগামীতে এটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে। এছাড়া চতুর্থ ও পঞ্চম শিল্প খাত মাথায় রেখে সব ঢেলে সাজানো হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি’র দি রিটজ-কার্লটন হোটেলের বলরুমে বুধবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় শেয়ারবাজার বিষয়ক রোড শো’র দ্বিতীয় পর্ব উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন। রোড শোর মূল বিষয়বস্তু- ‘রেইস অব বেঙ্গল টাইগার: পটেনশিয়াল ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট’।
অনুষ্ঠানে তিনটি বিষয় তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো- বাংলাদেশের অর্জন, সম্ভাবনা এবং সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ। এর মধ্যে রয়েছে-অবকাঠামো উন্নয়ন, বিভিন্ন আইনের সংশোধন এবং বেসরকারি খাতবান্ধব পলিসি গ্রহণ। এ পর্বের রোড শোতে অংশগ্রহণ করেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
সালমান এফ রহমান বলেন, চতুর্থ ও পঞ্চম শিল্পখাত মাথায় রেখে সব ঢেলে সাজানো হচ্ছে। শিক্ষাখাতে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। এ ছাড়া স্বাস্থ্যখাতে মোট ওষুধের ৯৯.৫ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। শিল্পখাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। শিল্পখাতের সেবা গ্রাহকের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, নতুনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গত ১২ বছরে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সত্যিকারের পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশে স্থানীয় বাজারে বিনিয়োগেরও বড় ধরনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় পর্যায়ে ট্যুরিজম মার্কেটও গড়ে উঠেছে। এভাবেই বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে। এদেশের স্থানীয় বাজারে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। প্রবাসীরা দারুণভাবে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ট্রেড পলিটিক্স রয়েছে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পথকে সুদৃঢ় করেছে। বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনীতিতে একটা স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে এনেছেন। বাংলাদেশে বর্তমানে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ বিরাজ করছে।
বিদেশি বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অনেক ভালো। সরকারের ভিশন ২০৪১ আছে। এ সময়ের মধ্যে উন্নত সম্মৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়বো বলে লক্ষ্য আছে। সরকারের ডেল্টা প্ল্যানও আছে।
সালমান এফ রহমান বলেন, আমাদের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ ও দুর্বলতা রয়েছে। এর মধ্যে বড় চ্যালেঞ্জ রাজনীতির স্থিতিশীলতা। এরপর আমদের বড় চ্যালেঞ্জ বিদ্যুতের সমস্যা। এসব সমস্যা সরকার সমাধান করেছে। এখন কোনো ধরনের লোডশেডিং নেই। শুধু তাই নয়, গ্যাস, সোলার, এসএনজি, ল্যান্ড টার্মিনাল-বিভিন্ন ক্ষেত্রে সবধরনের উন্নতি হচ্ছে বাংলাদেশে, যা ব্যবসা এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে সহজ করে দেবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সরকারি, বেসরকারি ইকোনমিক জোন রয়েছে। এর মধ্যে মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী অন্যতম। ইকোনমিক জোনগুলোতে একসঙ্গে অনেক সুবিধা আছে। ইউনিলিটি থেকে নিয়ে সব ধরনের সুবিধা এক জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে। তাতে ব্যবসা আরও সহজ হয়ে গেছে। কোনো কাজের জন্য ভোগান্তি নেই। এছাড়া এখনো কৃষিতে আমাদের বড় ধরনের সাফল্য রয়েছে। এসব খাতে বিনিয়োগ করা যায়।
বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, অর্থনীতির দিক দিয়ে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আমেরিকা। এদেশে আমরা ব্যবসায়িক অংশীদার খুঁজছি। আমরা সাহায্য চাই না, ব্যবসায়ী সহযোগী চাই। আমরা ব্যবসায়ী খুঁজছি, বিনিয়োগকারী খুঁজছি। তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করলে আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনা বিশাল। কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে যে অর্জন ও সম্ভাবনা রয়েছে, উন্নত দেশগুলোর বিনিয়োগকারীদের কাছে তা তুলে ধরা হয়নি। যে কারণে আমাদের ওইভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য আমরা এ ধরনের রোড শোর উদ্যোগ নিয়েছি। বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ হলেও এখানে বিনিয়োগ করে উচ্চহারে লভ্যাংশ পাওয়া যায়। বিনিয়োগকারীরা ভালো রিটার্ন পায়। গত ১ বছর ৩ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার সবচেয়ে ভালো পারফর্মেন্স করেছে। তিনি বলেন, এখানে একঝাঁক শিক্ষিত, দক্ষ ও পরিশ্রমী জনশক্তি রয়েছে, যা আমাদের বড় সম্পদ। আমেরিকান বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা যদি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেন তাহলে আমাদের দেশের শিক্ষিত সফল ব্যবসায়ীদের অংশীদার হিসেবে পাবেন। বাংলাদেশ এখন শুধু ট্রেডিং ব্যবসা নয়, বিনিয়োগের জন্য বড় জায়গা।
মূল প্রবন্ধে আরিফ খান বলেন, এশীয় অঞ্চলে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে শীর্ষে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিদেশি সহায়তা ছাড়াই আমাদের সক্ষমতা বাড়ছে। ১৯৭১ সালে আমাদের বিদেশি সহায়তার হার ছিল ৯৮ শতাংশ। আর ২০২১ সালে তা মাত্র ২.৯৮ শতাংশ। সবজি উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম অবস্থানে বাংলাদেশ। ভৌগোলিক দিক থেকেও আমাদের অবস্থান সুবিধাজনক। তিনি বলেন, আমাদের সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা এখানে এসেছেন। ওনাদের সবার কথার মূল বিষয় হলো, অর্থনৈতিক উন্নয়নে সিরিয়াস সরকার। তিনি বলেন, আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও আমাদের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেশি। কিন্তু এসএমই খাতে খেলাপি ঋণ মাত্র ৩ শতাংশ। কিন্তু মোট কর্মসংস্থানের ৭০ শতাংশই এ খাতে। আগামী ৫ বছরে শিল্প খাতে নেতৃত্ব দেবে এসএমই। এ কারণে শেয়ারবাজারেও এসএসই’র জন্য আলাদা বোর্ড গঠন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারে ৭ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে। বর্তমান বিএসইসি’র চেয়ারম্যান বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে বন্ড এবং ট্রেজারি সিকিউরিটিজের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে ২০৫০ সালে বিশ্বের ২৩তম অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। সংস্থাটির তথ্য অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হলো বাংলাদেশ। একই পূর্বাভাস দিয়েছে আরেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন (এইচএসবিসি)।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ফাইন্যান্স ডিভিশনের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম, রপ্তানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বেপজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতেমা ইয়াসমিন, শান্তা এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান আরিফ খান, বিএসইসি’র কমিশনার ড. মিজানুর রহমান, ওয়ালটন হাইটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মুর্শেদ এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেইন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনা তুলে ধরে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগ আকর্ষণে যুক্তরাষ্ট্রের ৪টি গুরুত্বপূর্ণ শহরে ১০ দিনের রোড শোর আয়োজন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে রোড শো শেষ হয়েছে। আগামী ৩০শে জুলাই লস এঞ্জেলেস এবং ২রা আগস্ট সানফ্রানসিসকোতে অনুষ্ঠিত হবে এই কর্মসূচি। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এর আয়োজন করেছে। অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী এই দেশটিতে বাংলাদেশকে তুলে ধরে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এই আয়োজনের উদ্দেশ্য। বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে সে বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
অনুষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন পর্বে পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক বিভিন্ন বিষয়কে ফোকাস করা হয়েছে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে এসেই বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে দেশের শীর্ষ ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। লভ্যাংশ, বিশ্বমানের পণ্য, রপ্তানি এবং মানসম্পন্ন সেবা দিয়ে বাংলাদেশের টেক জায়ান্ট ওয়ালটন অতি অল্প সময়ের মধ্যে সবার আস্থা অর্জন করেছে।