শরণার্থী সংক্রান্ত বৈশ্বিক ঋণ-সহায়তা বিষয়ক নীতিমালায় ব্যাপক পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে বিশ্বব্যাংক। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে মিলে এবং তাদের সুপারিশের আলোকে সংশোধিত ওই প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে উদ্বাস্তুরা যে সব দেশে রয়েছে সেসব দেশে অন্তর্ভুক্তিকরণ অর্থাৎ তাদের স্ব স্ব দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সহায়ক পরিবেশ তৈরি সংক্রান্ত প্রকল্পে অর্থ ছাড়ের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে মানবিক আশ্রয়ে রয়েছেন ১০ লাখের অধিক মিয়ানমারের নাগরিক। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্ত লাগোয়া রাখাইন রাজ্য থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত তারা। তাদের বিষয়ে খোলাসা করে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবনায় কিছু বলা না হলেও ঢাকা মনে করছে ওই সংশোধনী মেনে নিলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ রুদ্ধ হবে। বন্ধ হবে এ খাতে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা। কারণ সংশোধনী প্রস্তাবটি বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন ও উদ্বাস্তু বিষয়ক অবস্থানের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক! কূটনৈতিক সূত্র বলছে, সম্প্রতি প্রস্তাবিত ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’ টেকনিক্যাল নোটটি ঢাকার বিবেচনায় পাঠায় বিশ্বব্যাংক।
৩১শে জুলাইয়ের মধ্যে তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশের মতামত চেয়েছে। এ সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মতামত না পেলে সংশোধনীসহ প্রস্তাবটি বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে বলে বিবেচ্য হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ প্রস্তাবটির বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অভিমত নিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে এ বিষয়ে ‘স্ট্রং-অবজারভেশন’ বা প্রবল আপত্তি দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো অবস্থাতেই এটি গ্রহণ করা যাবে না। সেগুনবাগিচা বলছে, সংশোধিত প্রস্তাব মেনে বিশ্বব্যাংকের অর্থে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা এবং হোস্ট্র কমিউনিটির উন্নয়নে সমন্বিত কিংবা একক কোনো প্রকল্প গৃহীত হলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আবশ্যিকভাবে প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ তাদের ফেরত পাঠানোর বদলে বাংলাদেশেই রেখে দেয়া হতে পারে। এজন্য সংশোধনীটি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে উদ্বাস্তু বিষয়ক কোনো ঋণ গ্রহণ না করার বিষয়ে স্পষ্টভাবে লিখিত মতামত পাঠাতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে অনুরোধ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবিত ফ্রেমওয়ার্কে তিনটি উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। এক. উদ্বাস্তু এবং হোস্ট কমিউনিটির জন্য সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি। দুই. উদ্বাস্তুরা যে দেশে অবস্থান করছে সেই দেশে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে একীভূতকরণের কিংবা আদিনিবাসে ফেরত পাঠানো সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। তিন. হোস্ট কান্ট্রির সক্ষমতাকে এমন পর্যায়ে বাড়ানো যাতে উদার ওই রাষ্ট্রগুলো নতুন করে শরণার্থী ঢেউ এলে পরিস্থিতি সামলাতে পারে অর্থাৎ আরও বেশি উদ্বাস্তু গ্রহণ করতে পারে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, আগে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও পশ্চিমা বিশ্ব তিনটি উদ্দেশ্য আকারে-ইঙ্গিতে বা মুখে বলতো। কিন্তু এই প্রথমবারের মতো তারা বিষয়টি লিখিত আকারে উপস্থাপন করলো। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবনা মেনে নিলে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাচল, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার সুযোগ দিতে হবে। তাছাড়া তাদের লিগ্যাল ডকুমেন্ট তথা নিবন্ধনের আওতায় এনে সামাজিক পরিচয়পত্রও দিতে হবে। তাদের শরণার্থী হিসেবে গ্রহণেও চাপ বাড়বে। আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং নিজস্ব তহবিল ব্যয়ে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জীবনমান নিশ্চিতে কাজ করছে বাংলাদেশ। চার বছর ধরে প্রত্যাবাসন না হওয়া এবং বিদ্যমান করোনা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে বিদেশি সহায়তা দিন দিন কমছে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাইছে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও দক্ষতা বাড়ানোর মধ্যদিয়ে কর্মের সংস্থান তথা স্বাবলম্বী করে তুলতে। এ জন্য অবাধ চলাচলসহ তাদের আইনগত সুরক্ষায় জোর দিচ্ছে বিশ্ব সম্প্রদায়। যদিও বাংলাদেশের অবস্থান এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলাদেশ রিফিউজি কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেনি বিধায় রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’র মর্যাদা প্রদানে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাছাড়া তাদের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্তির পর্যায়েও নেই জনবহুল বাংলাদেশ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়ে জাতিসংঘ বা বিশ্বব্যাংক চিন্তা করতে পারে কিন্তু আমরা তা পারি না। অতীতে যখন যে ফোরাম থেকে রোহিঙ্গাদের রেখে দেয়া বা মূলধারায় অন্তর্ভুক্তির কনসেপ্ট বা ধারণা প্রবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছে বাংলাদেশ আপত্তি করেছে জানিয়ে সচিব বলেন, যখনই এ ধরনের ভাষা বা পয়েন্ট এসেছে তখন তাদেরকে আমরা বলেছি যে, বাস্তব কারণেই এটি আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বিশ্বব্যাংকের নোটের বিষয়টি আমরা পয়েন্ট আউট করছি এবং সংশ্লিষ্টদের বলছি এ ধরনের শর্ত গ্রহণ না করতে। সচিব বলেন, রোহিঙ্গাদের শিক্ষা বা দক্ষতা বৃদ্ধিতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তা অবশ্যই মিয়ানমারের কারিকুলাম অনুযায়ী হতে হবে। আমরা এখানে এমন কোনো ধরনের শিক্ষা দিতে চাই না যাতে অন্তর্ভুক্তিকরণের ন্যূনতম ঝুঁকি তৈরি হয়। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট, বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণের জন্য যদি আমরা এসব মেনে নেই তবে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি যে লক্ষ্য তা হোঁচট খাবে। উদ্বাস্তু সমস্যার ব্যাখ্যায় সচিব বলেন, প্রত্যাবাসনই এর একমাত্র পথ। তৃতীয় দেশে সেটেলমেন্টের কিছু কিছু প্রস্তাব আসে, কিন্তু তার পরিমাণ অনুল্লেখযোগ্য, ৪-৫টি পরিবারকে নিতে চায় কেউ কেউ। আমাদের জন্য তৃতীয় দেশে সেটেলমেন্ট ফিজিবল না থাকার কারণ সংখ্যাটি অনেক বড়, ১০ লাখের উপরে। এখন পৃথিবীর কোনো দেশ এই পরিমাণ মানুষ নেবে না- এটাই বাস্তবতা। আর অন্তর্ভুক্তিকরণের প্রস্তাব এটা কীভাবে সম্ভব? বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। ফলে জনবহুল বাংলাদেশের পক্ষে বাড়তি বোঝা বহন সম্ভব নয়- এটা আমরা বহুভাবে বিশ্বকে জানিয়েছি। সচিব বলেন, সুতরাং রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে একমাত্র অপশন হচ্ছে তাদের নিজ ভূমিতে টেকসই ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন।