× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মধ্যবিত্ত দরিদ্র হয়েছে, দরিদ্রের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, কিন্তু পোশাক শিল্প মালিকদের চাইবার শেষ হয়নি

মত-মতান্তর

আলী রীয়াজ
১ আগস্ট ২০২১, রবিবার

কথিত লকডাউন থেকে রপ্তানিমুখী শিল্পকে ছাড় দেবার নামে যে লক্ষ লক্ষ গার্মেন্ট শ্রমিককে অবর্ণনীয় কষ্টের শিকার করে ঢাকা এবং আশেপাশের শিল্প এলাকায় আনা হল তার কারণ বোঝার জন্যে খুব বেশি বুদ্ধি বিবেচনার দরকার হয় না। এই নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, সামাজিক ও গণমাধ্যমে ঝড় উঠেছে। এই রকম ঘটনা আগেও ঘটেছে সেটাও কেউ বিস্মৃত হননি। কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ রেখে, যখন ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে, টিকা দেবার ক্ষেত্রে অগ্রগতি এতটাই ধীর যে, তার হার দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম সেই সময় কেন এই ব্যবস্থা নেয়া হলো? হাসপাতালগুলোতে জায়গা নেই, অক্সিজেন নেই - সে কথা সরকার জানেন না এমন নয়।

তা সত্ত্বেও এই শ্রমিকদের কারখানায় আনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কারখানা চালু করে রপ্তানি অব্যাহত রেখে জিডিপি’র হার বাড়ানো। এই শিল্পখাতের মালিকদের প্রণোদনার নামে অর্থ দেয়ার ক্ষেত্রে গত দেড় বছরে কোনও রকম কার্পণ্য করা হয়নি। বাংলাদেশের নাগরিকদের করের অর্থ এবং বিদেশ থেকে ধার করে আনা টাকা দেয়া হয়েছে। সেই টাকা পাওয়া স্বত্বেও পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়নি, দেয়া হলেও তা যথাযথ সময়ে দেয়া হয়নি। এই খাতের মালিকরা চাইলেই অর্থ দেয়া হয়েছে, কিন্তু ছোট-মাঝারি শিল্পখাত সুবিধা বঞ্চিত থেকেছে, সাধারণ মানুষদের কথা বাদই দিলাম।
মধ্যবিত্ত দরিদ্র হয়েছে, দরিদ্রের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কিন্তু পোশাক শিল্প মালিকদের চাইবার শেষ হয়নি। তাঁরা চাইলে পান, না চাইলেও পান। কেন একটি শিল্প দুই দশক ধরে লাভ করার পরেও শ্রমিকদের এক সপ্তাহ বেতন দিতে পারেনা, ঐ শিল্পের মালিকরা শ্রমিকদের জীবন রক্ষার জন্য টিকা বিদেশ থেকে কিনে আনার জন্য সরকারকে সাহায্য করার বদলে যে টাকায় টিকা আনা যেতো তাতে ভাগ বসান সেই সব প্রশ্ন আমরা করতেই পারি। কিন্তুু তারচেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, শ্রমিকদের এই অবর্ণনীয় কষ্ট, তাঁদের জীবন বিপদাপন্ন করা এবং সারা দেশের জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলার পেছনে যে নীতি সেটা বোঝার চেষ্টা করা। এই ঘটনা অমানবিক, তার প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে; কিন্তু এটি কেবল মানবিকভাবে দেখবার বিষয় নয়।

গত এক দশকের বেশি সময় ধরে উন্নয়নের যে ধারণা ও নীতি গ্রহণ করা হয়েছে সেখানে কিভাবে জিডিপি বাড়লো সেটা বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে জিডিপি বাড়লো কিনা। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এখানে ধর্তব্যের বিষয় নয়, কেননা অর্জিত অর্থের যারা ভাগীদার হবেন তাদের এই কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছেনা। তাঁরা ভাল আছেন, ভালো থাকবেন। গার্মেন্ট শিল্পের মালিকরা যেভাবেই পারেন শ্রমিকদের কারখানায় হাজির করছেন কিন্তু সরকার তাঁদেরকে বন্ধ করছেন না কেন। এর কারণ একাধিক, প্রথমত ক্ষমতাসীনদের এক বড় অংশের নির্ভরশীলতা – প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে – এই খাতের ওপরে, ব্যবসায়ী শ্রেণির ওপরে। দ্বিতীয়ত সরকারের ‘উন্নয়ন’-এর আদর্শ। এই যে উন্নয়নের আদর্শ সেটা দেখিয়ে গণতন্ত্র থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

যতক্ষণ না পর্যন্ত ‘গণতন্ত্রের আগে উন্নয়ন’ তত্ত্বকে আপনি মোকাবেলা করতে পারছেন ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধরনের পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে। যতক্ষণ এটা আপনার-আমার মনে হচ্ছে ‘ভোটের অধিকার না থাক, উন্নয়ন তো হচ্ছে’ ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রমিকদের এই অবর্ণনীয় কষ্ট নিয়ে কথা বলা এক ধরণের মায়াকান্নাই। খুব সহজ করে বলি, ধরা যাক, বাংলাদেশে যদি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকতো তা হলে কী ক্ষমতাসীন কোন দল কেবল একটি খাতের মালিকদের সুবিধার জন্যে এই লক্ষ লক্ষ ভোটারকে এই রকমভাবে লাঞ্ছিত করার ঝুঁকি নিতো? আমার ধারণা কোনও রাজনৈতিক দলই সেটা করতো না। বিশেষ করে বাংলাদেশের ১৯৯১ সালে থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফল তাই বলে – ক্ষমতাসীনরা বিজয়ী হননি।

নির্বাচন কেবল ভোটের বিষয় নয়; এটি হচ্ছে জবাবদিহির প্রথম ধাপ, অনিবার্য দিক। ফলে যখন তা থাকেনা তখন ক্ষমতাসীনদের আর কোন জবাবদিহিতা থাকেনা। জবাবদিহির ব্যবস্থা নিয়ে কথা না বলে, অধিকারের কথা না বলে, যে আদর্শের কারণে এই সব ঘটছে তাকে প্রশ্ন না করে প্রতিবাদ করে ফলোদয় হবে না। যে কারণে ২০২০ সালে যা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি গত দুই দিনে দেখা গেছে।

[লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। লেখাটি ফেসবুক থেকে নেয়া]
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর