স্কুল থেকে বাসায় ফিরেই ৮ বছরের ছেলে রোহানকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন জাহিদ হোসেন। বিকেলে নিয়ে যান পার্কে। রাতে ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে বাসায় ফিরেন। ঘুমানোর আগে বাবা মার সাথে সেকি গল্প তার। সারাদিন কত্ত মজা করেছে রোহান। এভাবেই হাসি- আনন্দ, হৈ-হুল্লোড়,আর কোলাহলে সুখী একটি পরিবার ছিল জাহিদ হোসেনের। বর্ণনা করা গল্পটি বছর দেড়েক আগের। জাহিদ হোসেন তখন মাস শেষে নিয়মিত বেতন পেতেন।
তবে এখন সেই জৌলুস আর আনন্দের জোয়ার নেই মধ্যবিত্ত পরিবারটিতে। গত ১৮ মাস যাবৎ বেতন নিয়ে ফেরা হয় না তার। করা হয় না ব্যাগভর্তি বাজার। যাওয়া হয় না নতুন কোন পার্কে। বর্তমানে একবেলা খেলে পরের বেলা কি খাবেন এই চিন্তাতেই দিন যাচ্ছে তার। সবকিছুই কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে, অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে আগাচ্ছেন বেসরকারি স্কুলের এই শিক্ষিক। করোনায় ছন্দহীন হয়ে যাওয়া এমন মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্পগুলো কারো জানা হয় না। কেউ শুনতে চান না।
চীনের উহানে জন্ম নেওয়া করোনা নামক ভাইরাসটির আগ্রাসনে বিপর্যস্ত পুরো পৃথিবী।থমকে গেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন। দিন যত গড়াচ্ছে আক্রান্ত আর মৃত্যুর মিছিল ততোই যেন বেড়ে চলছে। গতবছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম সনাক্ত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি প্রাণ নিয়ে গেছে অদৃশ্য এই ভাইরাসটি। আর আক্রান্ত হয়েছেন ১২ লাখেরও বেশি মানুষ। ২০২০ সালের শেষের দিকে সংক্রমণ কিছুটা কমলেও একুশের শুরু থেকে ফের দীর্ঘ হতে থাকে কোভিড আক্রান্ত আর মৃত্যুর মিছিল। এখন যেটা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
অদৃশ্য ভাইরাসটির হানায় টালমাটাল বাংলাদেশের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক রাখতে কিছুদিন পর পরই লকডাউন ঘোষণা করা হচ্ছে৷ এই পরিস্থিতিতে উচ্চবিত্তদের আরাম আয়েশে সময় কাটলেও নিম্ন ও মধ্য আয়ের দিন যাচ্ছে চরম সংকট আর আর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে।
কোভিডকালে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা,সামাজিক- সেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বিত্তবানরা শ্রমজীবী বা নিন্মআয়ের মানুষের মাঝে ত্রাণ দিলেও ঘর বন্দী হয়ে পড়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। তাদের অনেকের সংসার অচল হয়ে পড়লেও মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতেও পারছেন না। অসহায় হয়ে পড়া এসব মধ্যবিত্তদের নিয়ে কেউ ভাবছেও না। সরকার মধ্যবিত্তদের বাড়ি বাড়ি ত্রাণ দেয়ার কথা বললে প্রথমদিকে নামমাত্র কিছু মানুষকে সামান্য সহযোগিতা করলেও এখন পর্যন্ত অনেকের বাড়িতেই ত্রাণ পৌঁছায়নি। সেই সাথে প্রনোদনার নামে নয়ছয়ের কথা তো সবারই জানা। এদিকে বেসরকারিভাবে ত্রাণ দিতে গিয়ে অনেকেই আবার ছবি-সেল্ফি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্বেও এমন পরিস্থিতিতে যেতে সাঁয় দেয় না মধ্যবিত্তের মন।
ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবে গত বছর থেকে বারবার লকডাউন দেওয়ায় কর্মহীন হয়ে অভাব অনটন দেখা দিয়েছে বিশাল এই জনগোষ্ঠীর মাঝে। হাতে বা জমানো যা অর্থ ছিল সেগুলো অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ায় ধারদেনা করে চলেছেন। কিন্তু সংসারে অভাব দেখা দিলেও কাউকে বলতে পারছেন না, আবার সইতেও পারছেনা মধ্যবিত্তের বেড়াজালে আবদ্ধ এসব মানুষ। যেকারণে অসহায় হয়ে চার দেয়ালে বন্দী হয়ে পড়েছে মধ্যবিত্তদের কান্না। আর এভাবেই লোকলজ্জার ভয়ে নীরবে-নিভৃতে চাপা স্বরে কাঁদছেন দেশের কয়েককোটি মধ্যবিত্ত।
ছোটখাটো ব্যবসা, বা চাকুরী করে কোন রকমে সংসার চলে মূলত এমন শ্রেণীভূক্ত মানুষদেরই মধ্যবিত্ত বলে ধরা হয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যে সমস্ত পরিবারের আয় ৪০ থেকে ৮০ হাজারের মধ্যে, তাদের আমরা মধ্যবিত্ত বলতে পারি। স্বল্প আয়ের হলেও সামাজিকভাবে খুবই ব্যক্তিত্বশীল এসব মানুষ বরাবরই আত্মসম্মান বজায় রেখে জীবনযাপন করেন৷ মহামারির কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। ছোটখাটো ব্যবসীদের দোকানপাট বন্ধ। বেসরকারি চাকরিতে কর্মরত আছেন এমন অনেকেই আবার বেতন পাচ্ছেন না৷ সঞ্চিত অর্থ শেষের পথে। আছেন চাকুরি হারানোর শঙ্কায়৷ সরকারের কোন প্রণোদনার মধ্যেও নেই তারা৷ ফলে চলমান লকডাউনের মধ্যে মহাসংকটে পড়েছেন দেশের ‘গৃহবন্দি’ কয়েক কোটি মধ্যবিত্ত৷
মূলত দারিদ্র্য রেখার উপরে থাকারাই মধ্যবিত্ত ৷ সেই হিসেবে বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের মতো মানুষ আছেন মধ্যবিত্তের কাতারে। করোনাকালে এসব পরিবারের অনেকেই এখন নিম্নবিত্তের স্তরে নেমে আসছেন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
একদিকে আর্থিক কষ্ট, অন্যদিকে সামাজিক বাস্তবতার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণিটিকে। অনেকে সংসারের খরচ কমিয়ে দিয়ে কষ্টেশিষ্টে দিনাতিপাত করছেন। অনেকে বাসা ভাড়াসহ অন্যান্য খরচের ভার সামলাতে না পেরে চলে যাচ্ছেন গ্রামে।
অথচ সমাজ বিনির্মাণে এবং সমাজকে টিকিয়ে রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন ও দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অবদান এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই।
সমাজের এই গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণিকে সরকারের মনোযোগ থেকে দূরে রাখা হলে ভবিষ্যত রাষ্ট্রের জন্য এর ফল ভালো হবে না। বরং এভাবে চলতে থাকলে উল্টে যেতে পারে অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রের হিসাব-নিকাশ।অতএব, মধ্যবিত্তকে বাঁচাতে হবে যে কোনো উপায়ে। তাদের কষ্ট ও দুর্ভোগ লাঘবে নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। একই সাথে বেসরকারি উদ্যোগে যারাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চান, তারা যেন লোকদেখানোর সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে আসেন৷ কোন ধরনের ছবি বা প্রচারণা থেকে বিরত হয়ে নিরবে এগিয়ে আসেন বাস্তবতার জাতাকালে পিষ্ট এসব মানুষের পাশে৷
চারদেয়ালে বন্দি মধ্যবিত্তের অনুভূতিগুলো অনুধাবন করুন। বাড়িয়ে দেন মানবতার হাত। খোঁজ নিন পাশের মধ্যবিত্তটার। হয়তো বা তারা আপনার অপেক্ষারই প্রহর গুনছে। কখন বলবেন, চিন্তার কারণ নেই। মানুষই তো মানুষের জন্য, আর জীবন জীবনের।
লেখক: শিক্ষার্থী: অনার্স ৪র্থ বর্ষ দর্শন বিভাগ,
এম.সি কলেজ সিলেট।
সাধারণ -সম্পাদক, এম.সি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি।