× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

স্মরণীয় ও বরণীয় মাহবুব আলী খান

মত-মতান্তর

মাহবুবা জেবিন
৬ আগস্ট ২০২১, শুক্রবার

দেশপ্রেম, অসীম সাহসিকতা আর মানবিকতার এক অসাধারণ সম্মিলনে নিজেকে উদ্ভাসিত করেছিলেন রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান । পৃথিবীতে অনেক মহান ব্যক্তি স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন তাদের কাজের মাধ্যমে । তেমনি সাহসিকতা, নির্ভীক দেশপ্রেম আর জনকল্যাণমূলক কাজের জন্যই বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় আজো স্থান করে আছেন প্রয়াত রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান।

১৯৩৪ সালের ৩রা নভেম্বর সিলেটের বিরাহিমপুরের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম হয় এক নক্ষত্রের। আহমেদ আলী খান ও জুবাইদা খানমের কোল আলোকিত করা মাহবুব আলী খান আমৃত্যু তার এই আলো ছড়িয়ে গেছেন । তাঁর শৈশবের অনেকটা সময় কাটে সিলেট এবং অবিভক্ত ভারতের প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার পিতার কর্মস্থল কলিকাতায়। সেখানেই শুরু হয় তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন। পরবর্তীতে তিনি চলে আসেন ঢাকায়।
ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। সারাজীবনে শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি কখনো কোন পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি । ১৯৫২ সালে ক্যাডেট হিসাবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন । পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে যান । যুক্তরাজ্যের ডরমাউথ রয়্যাল নেভাল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। ১৯৬৩ সালে মাহবুব আলী খানকে বৃটেনের রানী এলিজাবেথ বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করেন ।

১৯৭১ সাল । মাহবুব আলী খান সপরিবারে কর্মস্থল করাচীতে। পাকিস্তানিরা তখন বাঙালি অফিসারদেরকে অবিশ্বাস ও সন্দেহ করতে থাকে। মাহবুব আলী খান যখন দেশ মাতৃকার টানে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঠিক তখনই তাকে সপরিবারে নজরবন্দী করা হয় ক্যান্টনমেন্টে । কিন্তু তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য । সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন । 'রাতের পর নতুন ভোর আসবেই। আশা এবং ধৈর্যই মানুষ কে বাচিঁয়ে রাখে'। একদিন আসে পাকিস্তানী বাহিনীর আগলমুক্ত হবার সেই মহেন্দ্রক্ষণ । সাজানো সংসারের সব কিছু ফেলে এক কাপড়ে চলে আসার সময় স্ত্রী আফসোস করলে তিনি প্রিয়তমা স্ত্রী এবং কন্যাদেরকে বলেন- ‘আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব ’। এরপর প্রথম সুযোগ পেয়েই দেশের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন । সাথে নারী ও শিশুদের নিয়ে কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো খচ্চরের পিঠে চড়ে পৌঁছান আফগানিস্তান । সেখান থেকে ভারত হয়ে অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে ফিরে আসেন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে।

দেশে ফিরেই বিধ্বস্ত দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন । প্রথম বাংলাদেশী হিসাবে চট্টগ্রামের মার্কেন্তাইল একাডেমীতে কমান্ডান্ট হিসাবে যোগ দেন মাহবুব আলী খান । ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ নেভির অ্যাসিস্ট্যান্ট চীফ অফ নেভাল স্টাফে উন্নীত হন । তিনি হন বাংলাদেশ নেভাল শিপ ‘ওমর ফারুকের’ ক্যাপ্টেন । তার নেতৃতে বিএনএস ‘ওমর ফারুক’ আলজেরিয়া , যুগোস্লাভিয়া, মিশর, শ্রীলংকা, সৌদিআরবসহ পৃথিবীর বিভিন্ন নৌবন্দরে ভ্রমন করে এবং বাংলাদেশের নৌশক্তিকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন । ১৭৭৯ সালে তিনি চীফ অফ নেভাল স্টাফ হন । ১৯৮০ সালে রিয়ার অ্যাডমিরাল পদমর্যাদা লাভ করেন মাহবুব আলী খান।
নৌবাহিনীকে নেতৃত্ব দেবার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত থেকেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করেছেন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল । সমাজের অবহেলিত শিশুদের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত ‘সুরভি’ মাহবুব আলী খান এর অনুপ্রেরণায়ই গড়ে উঠেছে । স্ত্রী সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু এবং বড় কন্যা শাহিনা খান জামান ‘সুরভি’ এর মাধ্যমে ছিন্নমূল অসহায় শিশুদের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন ।

পারিবারিক জীবনে মাহবুব আলী খান ছিলেন খুবই সাধারণ । স্বামী হিসাবে তিনি ছিলেন খুবই বন্ধুপ্রতিম। পরিবারের প্রত্যেকের মতামতকে খুবই গুরুত্ব দিতেন । এমনকি ছোটদের মতামতকেও প্রাধান্য দিতেন । বড় ভাই এবং বড় বোন-এর প্রতি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল । ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ায় শাশুড়িকে খুবই সম্মান করতেন ।

স্নেহময় পিতা মাহবুব আলী খান সন্তানদের নিয়মানূবর্তিতা শিক্ষার উপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষার পাশাপাশি নিয়ম মেনে চলা সুন্দর চরিত্র গঠনে সহায়তা করে। তাই মানব কল্যাণে তার কন্যাদের ছোটবেলা থেকেই উৎসাহিত করতেন তিনি। তিনি বলতেন–‘বড় কিছু পাওয়া মানে অহংকারী না হওয়া’। বিনয় নম্রতা ছিল মাহবুব আলী খান এর সবচেয়ে বড় গুন। সন্তানদেরকে সর্বদা বিনয়ী হবার শিক্ষাই দিয়েছেন। ছোট বড় সবার সাথে সমান ভাবে মেশার শিক্ষাও তিনি সন্তানদের দিয়েছেন।

নারী শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন মাহবুব আলী খান। স্ত্রী সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুকে বিবাহের পরেও পড়াশুনা চালিয়ে যেতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। তারই অনুপ্রেরণায় তিনি ফাইন আর্টসে পড়াশুনা শেষ করেন। শিল্প ও সঙ্গীত অনুরাগী মাহবুব আলী খানের আগ্রহে তিনি শিখেছেন পিয়ানো বাদন। সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু একজন প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী হিসাবে আজও নিরলশভাবে শিল্পচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন।

মাহবু্ব আলী খানের দাদা ছিলেন তৎকালীন ভারতের বিশিষ্ট চিকিৎসক খানবাহাদুর আজদার আলী খান। আর তার ছোট মেয়ে জুবাইদা রহমানও পেশায় একজন চিকিৎসক। তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ অফ মেডিসিন থেকে রেকর্ড মার্কস পেয়ে কর্ডিওলজিতে মাস্টার্স পাশ করেন। অন্যদিকে, মাহবুব আলী খানের পিতা আহমেদ আলী খান ১৯০১ সালে প্রথম মুসলিম হিসাবে ব্যারিস্টার হন। আর সম্প্রতি ব্যারিস্টারী পাশ করেছেন মাহবুব আলী খানের নাতনি জাইমা রহমান।

খেলাধুলার প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড আসক্তি। তরুণ বয়সে খেলেছেন ফুটবল, ব্যাডমিনটন। টেনিস আর সুইমিংয়ের প্রতি তার ছিল আলাদা টান। মাহবুব আলী খান ছিলেন হ্যান্ডবল এসোসিয়েশনের প্রধান। বাংলাদেশে এসময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সফল আয়োজন করেন তিনি।

পড়াশুনার পাশাপাশি মাহবুব আলী খান তার মেয়ে শাহিনা খান জামান ও জুবাইদা রহমানকে সবসময় খেলাধুলা, সঙ্গীত চর্চায় উৎসাহ দিয়েছেন। সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু স্বাধীনভাবে সমাজ কল্যাণ মূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন তাঁরই অনুপ্রেরণায়। সাংসারিক কাজের পাশাপাশি জাতীয় মহিলা সংস্থার প্রেসিডেন্ট , সুরভির প্রতিষ্ঠাতা ও নৌবাহিনী প্রধানের স্ত্রী হিসাবে অনেক সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন। আর নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মাহবুব আলী খান সব সময় তার স্ত্রীকে পাশে থেকে অনুপ্রাণিত করেছেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে সর্বপ্রথম নারী অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানের অবদান সবচেয়ে বেশী।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে আধুনিক করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাহবুব আলী খানের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের জলসীমা রক্ষা, তালপট্টি দ্বীপের দখল নিশ্চিত করা, বাংলাদেশের সমুদ্র উপকুল জলদস্যু মুক্ত করার নেতৃত্বে ছিলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নৌবাহিনী একটি শক্তিশালী বাহিনী হিসাবে মর্যাদা লাভ করে। এমনকি সেই সময় ভারতীয় নৌবাহিনীও বাংলাদেশের নৌসীমায় প্রবেশের সাহস পায়নি।

১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের জুন পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন মাহবুব আলী খান। এসময় শাহজালাল সেতু, লামাকারী সেতু ও শেওলা সেতুসহ অসংখ্য ব্রিজ কালভারট নির্মাণ করে যোগাযোগ ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেন। তিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ৬ আগস্ট সকালে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষন বিমান দুর্ঘটনা তদন্তে বিমানবন্দরে গেলে কর্তব্যরত অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ব্যথা অনুভব করলে তাঁকে সি এম এইচে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান এই ক্ষণজন্মা পুরুষ।

বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, বাংলাদেশের গর্ব রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান তার দেশপ্রেম, বীরত্ব, সাহসিকতা, জনকল্যাণমূলক কাজ ও মহানুভবতার জন্য বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন ।

(তথ্যসূত্রঃ মাহবুব আলী খানের পরিবারের সদস্যদের সাথে আলাপচারিতা)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর