× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

বিভাজনের 'ভায়োলেন্ট ট্র্যাজেডি'

মত-মতান্তর

ড. মাহফুজ পারভেজ
১৫ আগস্ট ২০২১, রবিবার

৭৪ বছর আগে, ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে (১৪-১৫) উপমহাদেশ রাজনৈতিকভাবে দুইটি দেশ আর ভৌগোলিকভাবে ত্রিখন্ডিত হয়ে গেল। পূর্ব এবং পশ্চিমের খন্ডদুটি পাকিস্তান আর বাকি ভারতবর্ষ বা হিন্দুস্তান। সেসময় মূল সিলেটের অঙ্গহানি করে অনেকটুকুই আসামের ভাগে দেওয়া হয়।

১৯৪৭ সালে ঘটনাটি নানা পক্ষের কাছে নানা অর্থ বহন করে। ১. বৃটিশদের কাছে ট্রান্সফার অব পাওয়ার পাওয়ার বা ক্ষমতা হস্তান্তর; ২. ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের কাছে স্বাধীনতা; ৩. কোটি কোটি দেশান্তরী উদ্বাস্তু মানুষের কাছে দেশভাগ; ৪. উপমহাদের জন্য বিভাজন।

ভারত উপমহাদেশ ভাগের মতোই ভাগ হয়েছিল পাঞ্জাব আর বাংলা। তবে, গবেষণা ও সাহিত্য পশ্চিমাংশ তথা পাঞ্জাব ভাগ নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে, পূর্বাঞ্চলের বাংলা ও সিলেট নিয়ে ততটুকু হয়নি। অথচ বাংলাভাগ ও দেশভাগ আলাদা। যেমন চল্লিশের দশকে মুসলিম লিগ নেতারা দেশভাগ চেয়েছিলেন; কিন্তু বঙ্গবিভাজন চাননি।
তাঁদের দাবি ছিল, অখন্ড বাংলাই পাকিস্তানে সংযুক্ত হোক। আবার কংগ্রেস নেতারা প্রাথমিকভাবে ভারতভাগেরই বিরোধিতা করেছিলেন; কিন্তু পরে তাঁরা বলতে শুরু করেন, যে-দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম নেতারা দেশভাগ চাইছেন সেই যুক্তিতে বাংলা ও পাঞ্জাবকেও বিভাজিত করতে হবে। ব্রিটিশ ভারতের শেষ বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন এই যুক্তি মেনে নেন।

আবার চল্লিশের দশকে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ নেতারা যে-দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়ে এত মাতামাতি করেছিলেন তার ওপর তাঁদের বিশ্বাস যে অটল ও নির্ভেজাল ছিল এমন নয়। তার প্রমাণ হলো, সাতচল্লিশের গোড়ায় যখন বঙ্গবিভাজন অনিবার্য হয়ে উঠেছে, তখন এই দুপক্ষের নেতারাই আবেগতাড়িত হয়ে স্বাধীন বঙ্গ গঠনের জন্য তৎপরতা শুরু করেন। স্বাধীন বঙ্গ মানে তৃতীয় একটি রাষ্ট্র, যেখানে হিন্দু ও মুসলিমরা থাকবে দ্বিপক্ষ চুক্তি ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে এবং তা হবে ভারত ও পাকিস্তান থেকে আলাদা। এই যুক্তি স্পষ্টতই দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধী ছিল। স্বাধীন বঙ্গের দাবিদারদের উপলব্ধি কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় লিগ নেতাদের যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে শেষ পর্যন্ত খারিজ হয়ে যায়। হতাশ ও মনঃক্ষুণ্ণ কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায়, অখিল দত্ত প্রমুখ এবং মুসলিম লিগ নেতাদের মধ্যে প্রাদেশিক লিগ সম্পাদক আবুল হাসিম ও সোহরাওয়ার্দী স্বয়ং, যারা বাংলা ভাগ চাননি।
বাস্তবিক অর্থে, দেশভাগ তো শুধু সিরিল র্যাডক্লিফের তৈরি সীমারেখা নয়, ছিন্নমূল মানুষের মনেরও দ্বিধাদীর্ণ বিভাজন। তবু, কিছুকাল আগে পর্যন্তও তথ্যনিষ্ঠ, লেখ্যাগার-নির্ভর/ আর্কাইভনির্ভর, তথাকথিত উচ্চমার্গীয় ইতিহাস দেশভাগজনিত ব্যথা, বেদনাবোধ এবং সর্বোপরি মানসিকতার ইতিহাস রচনার কলাকৌশল ঠিক আয়ত্ত করতে সমর্থ ছিল না। সুখের কথা, মহাফেজখানার দলিল-দস্তাবেজের বাইরে অন্য ধরনের তথ্যসূত্রের সাহায্যে এই মানবিক ট্র্যাজেডিকে ধরার প্রয়াসও শুরু হয়েছে। দেশভাগের গল্প বলতে গিয়ে কান্তি পাকড়াশির দ্য আপরুটেড (১৯৭১) উদ্বাস্তু মানুষের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেয়। ভারত ও পাকিস্তানে দুই পাঞ্জাবের উদ্বাস্তু মহিলাদের অভিজ্ঞতাকে উলটেপালটে দেখে সেই প্রয়াসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন উর্বশী বুটালিয়া, রিতু মেনন, কমলা ভাসিনরা, আর প্রায় একই সময়ে জ্ঞানেন্দ্র পান্ডেও বলেন যে, দেশভাগের আগুনে দগ্ধ হয়েছেন এমন মানুষদের দৃষ্টিকোণ থেকেই খুঁজে পেতে হবে দেশভাগের অন্যতর মানবিক ইতিহাস।
নব্বইয়ের দশকে মূলত স্মৃতিকথাকে ভিত্তি করে উদ্বাস্তুদের ইতিহাস লিখলেন নীলাঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, যশোধরা বাগচি, শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত, প্রফুল্ল চক্রবর্তী, দীপেশ চক্রবর্তী প্রমুখ। জয়া চ্যাটার্জি রচনা করলেন দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িকতার রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত। এভাবেই তৈরি হওয়া দেশভাগের বিভিন্ন প্রান্ত ও পর্বের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে স্মৃতিকথনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কসূত্রের ধারায় আনাম জাকারিয়া নামের সাতাশ বছরের এক তরুণী হারপার-কলিন্স থেকে প্রকাশ করেছেন একটি গবেষণাগ্রন্থ, যার নাম দ্য ফুটপ্রিন্ট অব পার্টিশান, যাতে ১৯৪৭ সালের ৬৮ বছর পরে চার প্রজন্মের স্মৃতি-সত্তা-অভিজ্ঞতায় বিভাজনের নানা দাগ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আন্তরিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
আনাম জাকারিয়া পাকিস্তানের লাহোরে জন্ম নেওয়া ও ইসলামাবাদে বসবাসকারী একজন উন্নয়নকর্মী ও সংঘাতজনিত আঘাতে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক সেবাদানকারী একজন বিশেষজ্ঞ। কানাডার ম্যাকগ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর এই তরুণী ‘এক্সচেঞ্জ ফর চেঞ্জ’ প্রজেক্টের প্রধানরূপে ‘ওরাল হিস্টরি’ বা ‘কথ্য ইতিহাস’ চর্চা বেছে নিয়েছেন দেশভাগের ক্ষত ও যন্ত্রণাগুলোর প্রজন্ম-প্রজন্মব্যাপ্ত অভিজ্ঞতা বয়ান করার জন্য। আমার সঙ্গে ই-মেইলে আলাপকালে আনাম স্পষ্টত জানিয়েছেন, ‘সরকারি ইতিহাস ও পাঠ্যপুস্তকের ভাষ্যে সত্যের মূল বিন্দুটি অস্পষ্ট। ঘটনার মানবিক ছাপ কাগজের পাতায় আসেনি, যা এখনো অঙ্কিত রয়েছে রক্তাপ্লুত হৃদয়সমূহে।’
আনামের বইটির কথা আমাকে প্রথম জানান আমাদের কমন-গুজরাতি-ফ্রেন্ড, বারোদার ড. নিধি সুন্দরনেকার তেরে এবং তারপর একাধিকবার আমার সঙ্গে আনামের আলাপের সূত্রে এটা স্পষ্ট যে, তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার হিংসা-বিদ্বেষের বীজটিকে শনাক্ত করতে চান এবং সেটিকে মানবমনের পাটাতন থেকে উপড়ে ফেলতে ইচ্ছুক। নিজের বইটিকে নিয়ে তিনি পাকিস্তানের প্রধান প্রধান শহরে পাঠকের মুখোমুখি হয়েছেন এবং দেশভাগের নানা স্তরে পৌঁছে বিভাজনসৃষ্ট বিদ্বেষের জায়গাটিকে উত্তরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন।
দ্য ফুটপ্রিন্ট অব পার্টিশান গ্রন্থের কাঠামোটি দেশভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিঘাতপ্রাপ্ত ১৪ জনের নিবিড় জবানবন্দিতে রচিত। নোবেল সাহিত্যবিজয়ী বেলারুশীয় সভেতলানার মতো তিনিও ঘটনার সাক্ষী ও সংশ্লিষ্টদের প্রাধান্য দিয়েছেন। দ্বিতীয় স্তরের সূত্রের কাছে না গিয়ে বরং প্রাথমিক সূত্রের প্রতি বিশ্বস্ততা তাঁর গ্রন্থের মূল শক্তি। নিজের পরিবার ও আত্মীয়-পরিমন্ডলে দেশভাগে আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে তিনি এমন আরো অনেকের কাছ থেকে বিষয়টি জেনেছেন, যাঁরা ছেড়ে-আসা-দেশে আর কখনো যেতে পারেননি। পরদেশকে নিজের দেশ ভেবে মৃত্তিকাচ্যুতির বেদনাবাহী মানুষজনের উপাখ্যান তাঁর বইটির প্রধান উপজীব্য। নিজে যে-ভাষায় বইটিতে উপসংহার টেনেছেন, তা হলো, ‘দেশভাগ আসলে একটি ‘ভায়োলেন্ট ট্র্যাজেডি’।’
লক্ষ করলে দেখা যাবে, এ-যাবৎ ১৯৪৭ সালের দেশভাগ নিয়ে যত ঐতিহাসিক এবং সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা হয়েছে, তার অধিকাংশই পাঞ্জাবকেন্দ্রিক। পুবের উদ্বাস্তুদের সংখ্যা ও যাত্রাপথের ভয়াবহতা তুলনামূলকভাবে কম ছিল বলেই হয়তো বঙ্গ-বিভাজন এই ইতিহাসচর্চায় কম জায়গা পেয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। বরং সাতচল্লিশের সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে পূর্বাঞ্চলের বাংলা ছিল প্রান্তিক ও অনেকাংশেই অনালোচিত। আনাম জাকারিয়া আমার এক প্রশ্নের জবাবে সোজাসাপ্টাভাবেই জানিয়েছেন, ‘বঙ্গ-বিভাজনের বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় জায়গা না দিলে দেশভাগ বা পার্টিশানের ইতিহাস কখনোই স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না।’ তাঁর ইচ্ছা আছে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের দিক থেকেও দেশভাগের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে গবেষণা করার। ‘তা হলেই দক্ষিণ এশিয়ায় সাতচল্লিশের দেশভাগের সামগ্রিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারা যাবে,’ এটাই তাঁর মত। আনামের গ্রন্থসূত্রে প্রাসঙ্গিক রাহুল রায়-সম্পাদিত ও কলকাতার গাঙচিল-প্রকাশিত পশ্চিম থেকে পূর্ববঙ্গ : দেশবদলের স্মৃতি বইটির কথাও উল্লেখ্যযোগ্য, যেখানে বিস্মৃতির ঐতিহাসিক দায় মোচনের চেষ্টা গভীরতর।
দেশভাগের রক্তাক্ত, নৃশংস ও বেদনার সঙ্গে রয়েছে সম্প্রীতির অনেক গল্পও। এমন এক সম্প্রীতি, যেখানে দুটি লড়াইরত ধর্মীয় সম্প্রদায় একে অপরের জীবনে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে, রাজনীতির দ্বৈরথে বিদীর্ণ হয় না, তখন আশাবাদের একটি সুবাতাস প্রবাহিত হওয়ার প্রত্যাশা জাগে। কিন্তু অতীতের বাস্তবতায় আশাবাদের আড়ালেই দেখা যায় রুক্ষ প্রান্তর, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, দাঙ্গার কালো ছায়া, বিভাজনতত্ত্ব, চকিতে ছড়িয়ে পড়া গুজব, রাস্তার পাশে পড়ে-থাকা লাশ দেখে ভয়ে চমকে ওঠা, অদ্ভুত আঁধারের মতো মনে বিছিয়ে-থাকা আতঙ্কের এই ইতিহাস দক্ষিণ এশিয়ায় খুবই চেনা, কয়েক দশক ধরে পড়তে পড়তে ক্রমশ গা-সওয়া হয়ে গেছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ নিয়ে যত আকুলতা তার ছিটেফোঁটাও পূর্ববঙ্গীয় সাহিত্যে নেই। কেন নেই? এখানে কি শরণার্থীদের পুনর্বাসন সমস্যা ছিল না? রিফিউজি ক্যাম্প বানানোর দরকার পড়েনি? অচেনা জীবনে মানুষের নতুন জীবন সংগ্রামের প্রয়োজনও পড়েনি? ১৯৬১ সালের জনগণনা সম্পর্কে জয়া চট্টোপাধ্যায় রচিত বাঙলা ভাগ হল গ্রন্থে দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের চারটি জেলায় জনস্ফীতি যখন ক্রমবর্ধমান, ঠিক সেই সময়েই পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশে) সেই সংখ্যা নিম্নমুখী। অতএব, উদ্বাস্তু সংকটই না থাকলে আর তার অভিঘাত পুবের সাহিত্যে ঘটবে কী করে? তা ছাড়া বাল্য বা শৈশবের বাস্তুচ্যুতির পর যথাসময়ে সবাই সুস্থিত হয়েছেন নতুন জীবনে, তাই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে স্মৃতিচারণ করলেও হৃদয়ের একদা-রক্তক্ষরণের সত্যনিষ্ঠ, আকুল বিবরণ দেওয়ার দায় কি থাকে? অনেকেই কবি জীবনানন্দ দাশের কথা (‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?’) মেনে চললেও সবাই তা মানবে কেন?
প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘দেশভাগ কি জরুরি ছিল? দেশভাগের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াকে মানুষ এখন কীভাবে দেখছে?’ এই প্রশ্নের উত্তর রাজনীতির মধ্য থেকে পেতে হবে। মানবিক দুঃখ-বেদনার মাঝে উত্তরটি নেই। কারণ আবেগ বেদনাবিধুর অবিরল রক্তক্ষরণ বা হাহাকারের রাজনৈতিক দিকগুলো স্ট্যানলি উলপার্টের বিবরণ লক্ষ করলে অজানা থাকার কথা নয়। তিনি জানাচ্ছেন, ‘সরকারি দায়-দায়িত্ব এবং ভূখন্ড ভারতের জন্য শতকরা ৮২.৫ ভাগ এবং পাকিস্তানের জন্য ১৭.৫ ভাগ হারে বণ্টন হচ্ছিল। রাতারাতি রেলওয়ে, কলম, পেন্সিল, টাকা, পাউন্ড, দ্রব্য, সামগ্রীর ন্যায় সিভিল সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, রাজস্ব বিভাগ ইত্যাদি ভেঙ্গে দিতে হয়। এক মাসের মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী পুঞ্জীভূত সয়সম্পত্তি, দালানকোঠা দুটি পৃথক জাতির অভ্যুদয়ের জন্য ‘সিজারিয়ান অপারেশন’ করতে হয়। এমতাবস্থায় লক্ষ-লক্ষ শিখ, হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, পাঞ্জাবি তাদের জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ছেড়ে যৎসামান্য হাতে নিয়ে দারাপুত্রপরিবারসহ অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটতে বাধ্য হয়। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে প্রায় এক কোটি লোক বাড়ি-ঘর পরিবর্তন করে এবং তন্মধ্যে প্রায় দশ লক্ষ লোক তাদের কাঙ্ক্ষিত দেশে জীবিত পৌঁছাতে পারে নি।
পূর্বাঞ্চলে দেশভাগের সাহিত্য বা ঐতিহাসিক গবেষণায় অনেক ক্ষেত্রে তালাশ করে বহুমাত্রিক বিবরণ কমই পাওয়া যাচ্ছে। ট্রেন টু পাকিস্তানের মতো ‘ট্রেন টু কলকাতা’ বা ‘মার্চ টু ঢাকা’ নামে কিছুই রচিত হয়নি এখানে। ব্যক্তিগত দুঃখবোধ আর পাওয়া-না-পাওয়ার হিসাব দেশভাগের কিয়দংশ হলেও হতে পারে, সবকিছু নয়। স্মৃতিকথনের মধ্য দিয়ে জাতিরাষ্ট্রের হয়ে-ওঠার প্রক্রিয়াটির সমান্তরাল, বিকল্প এক ইতিহাসের সন্ধান চালানোও জরুরি ঐতিহাসিক কাজ। এ-কাজ কিছুটা করেছেন বদরুদ্দীন উমর। তাঁর ভাষ্যে নির্মোহভাবে বিবৃত হয়েছে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, উদারমনস্ক পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায় লালিত লেখকের বাল্য এবং কৈশোর, যেখানে সদাশান্ত বর্ধমান শহরের ওপর তিরিশ-চল্লিশের দশক জুড়ে নেমে আসতে থাকে রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত আর দাঙ্গার ছায়া, পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁদের বাড়ি, পিতৃব্যসম পুরনো পারিবারিক হিন্দু বন্ধু অবলীলায় খুলে ফেলেন বন্ধুত্বের মুখোশ, গান্ধী হত্যার সংবাদ পেয়ে বিষাদাক্রান্ত হলেও একটু পরেই হত্যাকারীর নাম ও ধর্মপরিচয় শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তরুণ বদরুদ্দীন, ‘যাক, প্রতিশোধমূলক নিধনযজ্ঞের খাঁড়া অন্তত এ যাত্রা নেমে আসবে না মুসলমানদের উপর।’ (তিনি সঠিক ছিলেন। পরে যখন ইন্দিরা গান্ধী শিখ প্রহরী কর্তৃক নিহত হন, তখন ভারত ভেসে গিয়েছিল প্রতিশোধের তান্ডবে।) বদরুদ্দীনের সত্যনিষ্ঠ স্বীকৃতিটিও প্রণিধানযোগ্য: ‘এই বাঁচার তাগিদেই পারিবারিক সিদ্ধান্ত হল বর্ধমানের পাট গুটিয়ে ঢাকায় পাড়ি দেওয়ার। আসলে নিরাপত্তার অভাব ও সেইসঙ্গে অপমানবোধ স্বাভাবিক চিন্তাশক্তিকে খুব দুর্বল করল’ অকপটে লিখেছেন বদরুদ্দীন।
এটা খুবই সত্য যে, অত্যল্প সময়ের মধ্যেই প্রদেশগুলোকে ভাগ করা হলো; অসামরিক ও সামরিক বিভাগকেও দ্বিধাবিভক্ত করা হলো; সম্পদ বখরা করারও কথা ছিল। এই সময়সীমা পাকিস্তানের জন্য নিদারুণ সমস্যা সৃষ্টি করে। ভারতের মতো উত্তরাধিকারসূত্রে পাকিস্তান কোনো রাজধানী ও সরকার পায়নি। পায়নি এমন আর্থিক সম্পদ, যা দিয়ে দ্রুত প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ফেলা যায়। উপরন্তু কোটি কোটি উচ্ছিন্ন (মুসলমান) শরণার্থীর সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানে প্রবেশ এই শিশুরাষ্ট্রের ওপর ত্রাণ ও পুনর্বাসনের সমূহ বোঝা চাপিয়ে দেয়। যশোবন্ত সিংহ তাঁর জিন্নাহ পাকিস্তান গ্রন্থে স্বীকার করেছেন, ‘এখন, পিছনে তাকিয়ে মনে হয়, সে সময়েই ভারত কিছু ছাড়তে পারতো। গোটা উপমহাদেশে রক্ত ও নৃশংসতা মানবিক সংবেদনশীলতাকে এমন অসাড় করে দিয়েছিল যে, উদারতা দেখানোর দরকার ছিল। কিন্তু পাকিস্তান তার রাষ্ট্রীয় পথে যাত্রা শুরু করার সময় আগের একান্নবর্তী পরিবারের শরীকদের (ভারতের) কোনও শুভেচ্ছা বা সম্পদ বণ্টনজনিত সাহায্যও পায় নি। বরং তিক্ততা ও শত্রুতা সম্বল করেই তাকে এগুতে হয়েছে। পাকিস্তানের সামনে তখন বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানো।’
উপমহাদেশের দুই প্রান্তে দেশভাগের ক্ষত যে রক্তাক্ত চিহ্ন এঁকেছে, আনাম জাকারিয়া তাঁর ফুটপ্রিন্ট অব পার্টিশান গ্রন্থে তার একটি দিকের চিত্র দেখিয়েছেন। অন্য কাউকে বাকিটুকু দেখাতে হবে। কারণ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান হয়ে যে ক্ষতের উত্তরাধিকার পশ্চিম প্রান্তের মতোই বহন করছে পূর্ব প্রান্তর, সে ক্ষতি ও ক্ষতের প্রভাব ভূগোল, ইতিহাস, মানুষের মন, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রবহমানতা থেকে মুছে যায়নি!

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মতামত লেখকের নিজস্ব
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর