জ্ঞান স্থির কোন বিষয় নয়, জ্ঞানের বিকাশ ঘটে, রুপান্তর ঘটে। আদিম সমাজ বিকশিত হওয়ার প্রারাম্ভকালে সকলের স্বার্থে যখন সমিতি নির্মিত হয়, তখন থেকেই সেই সমিতির বিকাশ বিকশিত হতে হতে আজ এই পর্যায়ে রাষ্ট্র নামে আবির্ভূত হয়েছে। সেই সমিতি আর এই রাষ্ট্র একটি জ্ঞান। যে কোন রাষ্ট্রের একটি বড় ব্যর্থতা এর নাগরিকগণ যখন রাষ্ট্রের উদ্ভবের উদ্দেশ্য জানতে অপারগ হয়। রাষ্ট্রকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, দেখা যায় না, কিন্তু নিয়তই এটা জানান দিয়ে থাকে। বস্তুত: রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য প্রকাশে এর শাসকগণ কখনও তেমন উদ্যোগী হয় না, যার পরিণামে এর অধিভুক্ত জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থায় ভোগে রাষ্ট্রকে প্রতিপক্ষ জ্ঞান করে।
এটা একটি গবেষণা অনুমান- ১৯৭১ সালে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র উদ্ভবের মৌল উদ্দেশ্যসমূহ সমষ্টি সাম্যকভাবে উপলব্দিতে অপারগ হয়ে আসছে। একজন ব্যক্তি যে কাজ করে সেই কাজের উদ্দেশ্য যদি তার কাছে অজ্ঞাত থাকে তাহলে সেই কাজের সার্থকতা কোথায়।
তেমনি রাষ্ট্র তার অধিভুক্ত জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনে যেসব কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে, শাসনে যে সব সিন্ধান্ত গ্রহণ করে সেগুলোর উদ্দেশ্য যদি জনগোষ্ঠী স্পষ্টভাবে উপলব্দি করতে ব্যর্থ হয় তাহলে এর স্বার্থকতা অসাড়। কার্যত: এর জন্য রাষ্ট্রে কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে গৃহীত হওয়ার দাবি রাখে। রাষ্ট্র তার প্রতিটি অনুসূচি আর কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট নির্দেশক দিয়ে প্রকাশ করে দিবে এইসব অনুসূচি-কর্মসূচি কিভাবে এবং কেন রাষ্ট্র উদ্ভেেবর উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের আচরণ, জনগণের সাথে এর সংযোগ, উন্নয়ন কর্মসূচি, সরকারের বিভাগসমূহের সমন্বয়, বিচার ব্যবস্থার ধরণ, শাসক নির্বাচিত হওয়ার পদ্ধতি ইত্যাদির মাধ্যমে রাষ্ট্রের উদ্ভবের নজির প্রকাশ করার রীতিধারা গড়ে তোলা। বাংলাদেশের চলমান শাসনের রীতিধারায় এর উদ্ভবের উদ্দেশ্য প্রকাশ পায় না। সাম্প্রতিক মডেলকন্যা কাহিনীগুলোর মূলে এই কারণটি অনু-উপাদান হিসাবে ভূমিকা নেয়। মডেলকন্যা কাহিনীগুলো মূলকাহিনীর উপজাত। সেই মূল কাহিনীর ব্যবচ্ছেদ করাই এই নিবন্ধের মূখ্য উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিয়েছে এবং এর উদ্ভবের বুনিয়াদ আধুনিক সূত্রের সম্মিলনে গড়া। এর রাষ্ট্রীয় নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। অভ্যুদয় অব্যবহিতকালেই সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে এর উদ্ভবের উদ্দেশ্য এবং সে লক্ষ্যে স্থির করা হয়েছে এর মৌলনীতিসমূহ- জাতীয়তাবাদ, সমাজতস্ত্র, গণতস্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সিন্ধান্ত, রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে তার নির্মিত সংবিধানের প্রভূতধারায় নানামুখী পরিবর্তন-পরিবর্ধন বা সংযোজন ঘটাতে পারে এবং এটি একটি আধুনিক শর্তও বটে। রাষ্ট্র তার অধিভুক্ত জনগোষ্টীর প্রয়োজনের নিরিখে শাসনপদ্ধতির বিভিন্ন ধারা-উপধারায় পরিবর্তন বয়ে আনে। কিন্তু একটি রাষ্ট্র কখনোই তার মৌলধারায় পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না। যেমন, সংসদে ৩০০ টি আসনের ৩০০ জন সদস্যও যদি রায় দেয় তথাপি বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করা যাবে না। এদেশের নামকরণের সাথে জড়িত রয়েছে হাজার হাজার বছরের ভাষা ইতিহাস সংস্কৃতি প্রথা রীতিধারা তথা সামগ্রিক জীবনপ্রণালী, ঠিক তেমনি পরিবর্তন করা যাবে না এর সাথে সংযোজিত (পূর্বল্লিখিত) সেইসব মৌলনীতিসমূহ। সংবিধানে আনীত সেই সব নীতি যা মৌলনীতি নামে সংবিধানে স্থান পেয়েছে সেগুলোর পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়নই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের উদ্ভবের বুনিয়াদী উদ্দেশ্য। কিন্তু স্বাধীনতা অব্যবহিতকালেই সেইসব মৌলউদ্দেশ্যসমূহ উল্টানো হয়েছে, পাল্টানো হয়েছে এবং ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে।
১৯৭৯ সালের ৫ই এপ্রিল সংসদে পঞ্চম সংশোধনী বিল পাস হয়। এটি মূলত সামরিক ফরমান বা প্রজ্ঞাপনের সংকলন। ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ হতে ৯ই এপ্রিল ১৯৭৯ সময় পর্যন্ত সামরিক শাসন যেসব ফরমান জারি করে তার প্রতিটি সংযুক্ত করে পঞ্চম সংশোধনী বিল পাস হয় । এর উদ্দ্শ্যে ছিল ১৯৭৫ খেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত সময়ে সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধানের পরিবর্তন সংযোজন ও সংশোধনকে বৈধতা দেয়া। সামরিক ফরমান দ্বারা বাতিল হয়ে যাওয়া অনুচ্ছেদগুলো হলো- ৬, ৮, ৯ , ১০, ১২, ২৫, ৩৮ ও ১৪২। উল্লেখ্য, এই সকল অনুচ্ছেদসমূহ কোন সংবিধানের মেীল চরিত্র বহন করে এবং এসব চরিত্রের মাধ্যমে সংবিধানটি কতটুকু সময় বাস্তবতাকে ধারণ করেছে এবং দার্শনিকভাবে কতটুকু শাস্ত্রীয় চরিত্র ধারণ করেছে তার প্রকাশ পাওয়া যায়। যেমন- এই আটটি অনূচ্ছেদের মধ্যে অনুচ্ছেদ ৮ (ধর্ম নিরপেক্ষতা), অনুচ্ছেদ ১২ (ধর্মীয় রাজনীতি রহিতকরণ) ও অনুচ্ছেদ ৬ (বাঙালি জাতীয়তাবাদ)। দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতাকালের কিছুদিন পরই উদ্ভবের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথ তার গতি হারায় এর ফলে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা, সামগ্রিক জনগোষ্টী ভুল পথে চালিত হতে শুরু করে। একটি রাষ্ট্রের সকল জনগোষ্টি রাজনীতি শাস্ত্রের অধ্যায়নকারী হয় না, জনগোষ্টি কী করে উপলব্দিতে আনবে তার রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যসমূহ কী কী। সাংবিধানিক শাসনের ধারাবাহিকতা, শাসকের সিন্ধান্ত, আইন পরিষদের সদস্যদের গণ-জবাবদিহির ব্যবস্থা, সম্পদের সুষম বন্টন, ধর্মবিযুক্ত রাজনীতির ধারা, জনমত প্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি, অবাধ সংবাদ মাধ্যম, নির্ভুুল নির্বাচন ব্যবস্থা, ধর্ম ও রাজনীতির সুস্পষ্ট তফাৎ তুলে ধরা ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগোষ্টী তার রাষ্ট্রের উদ্ভবের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের অধিকারী হয়। ১৯৭১ সালে অভ্যুদয়ের অল্পকাল পরেই ১৯৭৫ সাল হতে বাংলাদেশ তার মূল উদ্দেশ্য হতে সরে পড়েছে। সংকটের শুরু সেই সময় থেকেই। সেই সংকটের অসংখ্য উৎপাদনের মধ্যে একটি উৎপাদন আমাদের সাম্প্রতিকমডেলকন্যা সংকট। ১৯৭৫ পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশে মূলত পূর্বতন পাকিস্তানী শাসনের আদলটি ফিরে আসে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ রহিত করা, যুদ্ধ অপরাধীদের ক্যাবিনেটে নিয়ে আসা, সংবিধানে বিসমিল্লাহ লেখা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাতিল করা, ৮ম সংবিধানের মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা- ইত্যাদি পরিক্রমায় বাংলাদেশকে মূলত পাকিস্তানী শাসনের চৌহদ্দী অতিক্রম করে মধ্যযুগের ইউরোপে নিয়ে গিয়েছে, মধ্যযুগের ইউরোপকে বলা হয় অন্ধকারের যুগ। সেই যুগে কোন যুক্তি প্রতিষ্ঠা পায়নি, প্রতিষ্ঠা পায়নি নীতি ও পদ্ধতি, শাসন ও তার প্রক্রিয়া। অযুক্তি-ধর্মান্ধতা, যাদু-টোনা, মন্ত্র-তন্ত্র ইত্যাদি ছিল মধ্যযুগের জীবনব্যবস্থার ধারাপাত। সেই ধারাপাতের ধারাবাহিকতায় পড়ে যায় বাংলাদেশ। শাসন আর অপশাসনের তফাৎ বুঝতে অপরাগ হয় এর জনগোষ্ঠী। শাসন চলে যায় দুর্বৃত্তদের হাতে, স্বাধীনতার বিরোধীরা হয় শাসক, তারা কোন শাসনতান্ত্রিক রীতিধারা অনুসরণ না করে ধর্ম-রাজনীতি দিয়ে আবারো মানুষকে বশ করে ফেলে, গড়ে ওঠে ধনিক-বণিক শ্রেণি। বণিক শাসনের উৎসটি সেখান থেকেই জন্ম লাভ করে। চোরাকারবারি, মজুতদারি, দুর্নীতি সমাজে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে। ১৯৯০ পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসনের রুপরেখাটি বণিকশাসনের প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। বণিকরাই সমাজপতি, বণিকরাই শাসক বনে যায়,তারা ভোগবাদী শাসনের সূত্রপাত ঘটায়। ভোগের নিরিখে সুইস ব্যাংকে সঞ্চয়, বিদেশে দ্বিতীয় বাড়ি, দেশে সামন্তশাসনের আদলে গড়ে তোলে নারী শোভিত ঝলসাঘর। আমাদের মডেলকন্যাগণ সেই জলসাঘরের সেই শোভিত নারী - এই হলো মডেলকন্যা সংস্কৃতি উদ্ভবের উৎস।
যে কোন দেশেরই কিছু কিছু জাতীয় শক্তি থাকে। যেমন, বাংলাদেশের জাতীয় শক্তিসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো এর উর্বরভূমি, নাতিশীতোঞ্চ আবহাওয়া, জনগোষ্ঠীর মেধা, নদী ও জলাশয়, ইতিহাস ও তার সংস্কৃতি, স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস; তেমনি অন্যতম একটি জাতীয় শক্তি হলো জাতীয় মর্যাদাবোধ। মানুষ যেমন শুধু খেয়ে বেঁচে থাকে না, আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকে, তেমনি একটি রাষ্ট্রও তার অর্থনৈতিক প্রাবল্যতার সাথে সাথে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকে। সাম্প্রতিক মডেলকন্যা কাহিনীগুলো বাংলাদেশের জাতীয় মর্যাদাকে ভুলন্ঠিত করেছে, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রশ্ন হলো যে সব অপরাধে তারা ধৃত হয়েছে এবং হচ্ছে যারা এইসব মডেলকন্যাদের নির্মাতা সেইসব পুরুষদের কেন ধরা হচ্ছে না। মডেলকন্যাগণ আকাশ থেকে পড়ে সরাসরি এই পর্যায়ে চলে আসেনি, তাদের এই পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আর যারা এনেছে তারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে শাসকের অংশীদার। যে অংশীদারগণ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অসচেতন। সৌন্দর্যবোধের গড় হিসাবে আমাদের দেশের মেয়েদের একটি সুন্দর রুচিবোধ রয়েছে। এখনও গ্রাম ও শহরের মেয়েরা বাবা মায়ের কাছ থেকে বিশ-পঞ্চাশ টাকা চেয়ে রিকশা করে বিদ্যাশিক্ষায় যায়। এখনও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মেয়েরা মুঠোফোনে কোন ছেলে বন্ধুর প্রেরিত বার্তা সন্তোর্পণে দেখে তা নিমিষেই মুঠোফোন থেকে ডিলিট করে দেয়। গ্রামীণ মেয়েরা বাড়ির আঙিনায় এবং শহরের মেয়েরা ঘরের বারান্দায় কিংবা বাড়ির ছাদে ফুলের বাগান করে নান্দনিক রুচিবোধ এর প্রকাশ ঘটায়। পরিবারের গন্ডির মধ্যে ঘর সাজানো, অতিথি আপ্যায়ন, নিজের পাঠ তৈরি এবং পরিবারের গন্ডির বাইরে সমাজে পরিবেশে এবং কর্মস্থলে সৃজনশীল ভূমিকায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে বাঙালির যাপিত জীবনের উৎসজাত সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। সম্প্রতি ধৃত মডেলকন্যাগণের যাপিতজীবন, তাদের মন ও মগজ আমাদের মূলধারার মেয়েদের মতো জীবন উৎসজাত মৌলসংস্কৃতরি প্রতিনিধিত্ব করে না। সমাজে তাদের ভূমিকাটি আমাদের সমাজের উপাদান সমূহের বিপরীত পরিক্রমা।
লেখক: কথাশিল্পী ও উন্নয়নকর্মী