× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার , ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

কেন উত্তেজনা বাড়ছে দক্ষিণ চীন সাগরে?

মত-মতান্তর

ড. মাহফুজ পারভেজ
৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, শুক্রবার

এশিয়ায় প্রথম সফরে এসেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস 'দক্ষিণ চীন সাগর' এলাকায় চীন উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। আগস্টের শেষ সপ্তাহে সফরকালে সিঙ্গাপুরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি আরও বলেন, 'এ অঞ্চলে মার্কিন জোটের সহযোগীদের যে কোনো প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় পাশে থাকবে।'

ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেসব ইস্যু নিয়ে বিরোধ চলছে তার মধ্যে দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যু অন্যতম। ওই জলসীমায় চীনের আধিপত্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও এর এশীয় মিত্ররা চিন্তিত।

এদিকে, মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে নিরাপত্তা সম্পর্ক সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে ভারত আগস্টের শুরুতে দক্ষিণ চীন সাগরে চারটি যুদ্ধজাহাজের একটি সুবিশাল ও শক্তিশালী নৌ-টাস্কফোর্স মোতায়েন করে। দক্ষিণ চীন সাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর মাধ্যমে নয়া দিল্লি বেইজিংকে মোকাবেলার আঞ্চলিক রাজনীতিতে আরও বড় ভূমিকা নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির অংশ হিসেবে এ যুদ্ধজাহাজগুলো মোতায়েন করা হয়েছে, যেগুলো গুয়াম উপকূলে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বার্ষিক এক মহড়ায় অংশ নেবে।

উল্লেখ্য, এ চার দেশই ‘কোয়াডের’ সদস্য। দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের আধিপত্য ও শক্তি রোধে এই জোটকে নিয়েই অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা আছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের।

ভারত যে যুদ্ধজাহাজগুলো পাঠাচ্ছে তার মধ্যে একটি গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার ও একটি মিসাইল ফ্রিগেট আছে। এ জাহাজগুলো দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ চীন সাগর ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় দুই মাসের জন্য মোতায়েন করা হচ্ছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী।

অন্যদিকে, গত জুনে ইউএসএস রোনাল্ড রিগানের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি বিমানবাহী রণতরী দক্ষিণ চীন সাগরে প্রবেশ করেছিল। ফিলিপিন্স সাগরে একটি মহড়ায় যুক্তরাজ্যের কয়েকটি রণতরীরও অংশ নেশ সেসময়।

প্রশ্ন হলো, কেন উত্তেজনা বাড়ছে দক্ষিণ চীন সাগরে? বিষয়টি এমন নয় যে, আফগানিস্তানে তালেবান গোষ্ঠীর উত্থানের প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে।
বরং প্রসঙ্গটি বহু আগে থেকেই স্পর্শকাতর যা হাল আমলে আরও উত্তেজক হচ্ছে।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সমুদ্র আইন অনুযায়ী, কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র তাদের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সামুদ্রিক অঞ্চল নিজেদের দাবি করতে পারে। তাছাড়া ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অঞ্চলকে বলা হয় 'এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন'। এই অঞ্চলে তারা প্রাকৃতিক সম্পদ আরোহন, জলজ প্রাণী বা মৎস্য আরোহন, কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ ইত্যাদির স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।

কিন্তু চীনের নাইন ড্যাশ লাইন অনুযায়ী, তারা মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ২,০০০ কিলোমিটার সামুদ্রিক অঞ্চল নিজেদের দাবি করছে। এই অঞ্চলে রয়েছে বেশ কিছু দ্বীপপুঞ্জ। যেমন- স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ, স্কারবরো শোল অঞ্চল, প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জসহ বেশ কিছু প্রবাল দ্বীপ। আর তাতেই তৈরি হয়েছে বিতণ্ডা ও উত্তেজনা, যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকেও জড়িত করেছে এই ইস্যুতে।

ভৌগোলিক বিবেচনায় দক্ষিণ চীন পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত বলয়ে অবস্থিত। এই সাগরের আশেপাশে অনেক দেশের অবস্থান। এগুলো হল চীন, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, ফিলিপাইন, ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পূর্ব তিমুর, কোকোস আইল্যান্ড (অষ্ট্রেলিয়া) এবং জাপান। এই অঞ্চল খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ। এখানে মৎস্য ও সামুদ্রিক খাদ্য আহরণের উপর অনেক লোক জীবন ধারণ করে। এই অঞ্চল দিয়ে বিশ্বের এক তৃতীয়াংশের বেশি জাহাজ চলাচল করে। প্রতি বছর ৪০ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি বানিজ্য এই পথে হয়ে থাকে।

শুধু বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক নিরিখেই নয়, চীনের জন্য এই জলপথ অতীব প্রয়োজনীয়। কারণ, চীনের আশি শতাংশ পরিবহন এই পথে হয়। এমনকি, ভারতের বানিজ্যের ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশও এই সমুদ্রপথের উপর নির্ভরশীল। এজন্য দক্ষিণ চীন সাগরে সবাই নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায় এবং এই সমুদ্র-সংযোগ নিয়ে বিতর্কে পৃথিবীর অনেক দেশই নিজের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে এসেছে। ভারতের মতোই আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এই নৌপথ চীনের হাতে তুলে দিতে চায় না। কারণ এই অঞ্চল পুরোপুরি চীনের কবজায় চলে গেলে বানিজ্যিক জাহাজ চলাচলের জন্য অন্য দেশকে এক্সট্রা মূল্য দিতে হবে এবং চীনের অনুমতি নিতে হবে ।

বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ হিসেবে চীনের জন্যেও দক্ষিণ চীন সাগরে কর্তৃত্ব বজায় রাখা অপরিহার্য। যোগাযোগ সুবিধার পাশাপাশি দক্ষিণ চীন সাগরের ভূগর্ভে রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদের বিপুল সমাবেশ। পশ্চিমা গবেষকদের তথ্যানুযায়ী, এই অঞ্চলে ১১ বিলিয়ন গ্যালন তেল ও ১৯০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুত রয়েছে। তবে চীন সরকারের অধীনস্থ এক কোম্পানির জরিপ তথ্যানুযায়ী সেখানে প্রকৃতপক্ষে ১২৫ বিলিয়ন গ্যালন তেল ও ৫০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস রয়েছে, যা থেকে চীন প্রতি বছর ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন গ্যালন তেল ব্যবহার করে।

ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ, সমুদ্রবাণিজ্য ও ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় এই অঞ্চলের গুরুত্ব ব্যাপক। ইন্দোনেশিয়ার মালাক্কা প্রণালি থেকে তাইওয়ান প্রণালি পর্যন্ত প্রায় ৩৫ লাখ বর্গকিলোমিটারের এক বিরাট এলাকা গঠিত দক্ষিণ চীন সাগরে অসংখ্য ছোট-বড় দ্বীপ রয়েছে, তথা স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ, স্কারবরো শোল অঞ্চল, প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জসহ বেশ কিছু প্রবাল দ্বীপ রয়েছে। এছাড়া বেইজিং ভূরাজনৈতিক কৌশলগত কারণে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে, যা প্রতিবেশী দেশের মাথাব্যথার প্রধান কারণ। দক্ষিণ চীন সাগরের তীর ঘেঁষে রয়েছে মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই, ফিলিপিন, ইন্দোনেশিয়া ও তাইওয়ান। এসব দেশ এই অঞ্চলে চীনের আধিপত্য মেনে নিতে পারছে না। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদের অধিকার আদায় ও ফ্রিডম নেভিগেশনের দাবি করে।

মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বাহিনী চীন আক্রমণ করে এই অঞ্চলের দ্বীপসমূহ দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর কায়রো ও পটসডাম চুক্তি দ্বারা দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বীপসমূহ চীনের কাছে হস্তান্তরিত করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে চীন সরকার একটি নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে। এতে দক্ষিণ চীন সাগরে ১১টি ড্যাশলাইন আঁকা হয়। একে বলা হয় ইলিভেন ড্যাশলাইন।

কিন্তু মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে নিনা কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৫৩ সালে ইলিভেনে ড্যাশলাইনকে সরলীকরণ করে ৯টি ড্যাশলাইন অঙ্কন করা হয়। একে বলা হয় 'নাইন ড্যাশলাইন'। এই নাইন ড্যাশলাইন অনুযায়ী বেইজিং দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। কিন্তু জাতিসংঘের সমুদ্র আইন অনুযায়ী কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র তাদের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সামুদ্রিক অঞ্চল নিজেদের দাবি করতে পারে। এছাড়া ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অঞ্চলকে বলা হয় এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন। কিন্তু নাইন ড্যাশলাইন ভিয়েতনাম, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন ও তাইওয়ানে ২০০ নটিক্যাল মাইল অতিক্রম করেছে।

এমনই দ্বান্দ্বিক পটভূমিতে দক্ষিণ চীন সাগরে সংকট ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৮৮ সালে সাউথ জনসন রিফ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ভিয়েতনামের পরাজয় ও বেশ কিছু দ্বীপ চীন দখল করে। বেশ কয়েক দশক ধরে এই অঞ্চলে উত্তেজনা থাকলেও বর্তমানে প্রকট আকারে রূপ নিয়েছে। কারণ, দক্ষিণ চীন সাগরে বিভিন্ন দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, পারমাণবিক বোমাসম্পন্ন যুদ্ধজাহাজ ও কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণের মধ্য দিয়ে চীন নিজেকে এই অঞ্চলে শক্তিশালীভাবে পাকাপোক্ত করার প্রচেষ্টারত।

চীনের বিরুদ্ধ যে দেশগুলো আছে, তাদের বন্ধুরাষ্ট্র হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে ফিলিপিন ও তাইওয়ানের পক্ষে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে ওয়াশিংটন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের জন্য এই জলপথ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই চীনের আঞ্চলিক প্রভাব ক্ষুণ্ন করতে প্যান্টাগন এই সাগরকে বিবেচনায় রেখে প্রশান্ত মহাসাগরীয় রণসজ্জা সাজিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত সঙ্গে নিয়ে সামরিক মহড়া ছাড়াও গঠন করেছে ‘কোয়াড’, দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের আধিপত্য ও শক্তি রোধই এই জোটের মূল লক্ষ্য। ফলে বহু শক্তির আনাগোনা ও তৎপরতায় উত্তেজনা বাড়ছে দক্ষিণ চীন সাগরে। বিশেষত, আফগানিস্তানে তালেবান বিজয়ে আমেরিকার আপাতত যে পরাজয় আর চীনের লাভ হয়েছে, তাতে পরিবর্তিত শক্তিসাম্য ও মেরুকরণকে নিজেদের দিকে আনতেও দক্ষিণ চীন সাগরে তৎপর হচ্ছে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিসমূহ, যা প্রায়শই উত্তেজন রূপ ধারণ করছে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর