উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় পানশির আবার চলে এসেছে অস্থির আফগান পরিস্থিতির দৃশ্যপটে। সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত মুজাহিদিন বাহিনীর মজবুত ঘাটি এবং প্রথম তালেবান শাসনের বিরুদ্ধে নর্দান অ্যালায়েন্সের প্রতিরোধ কেন্দ্র পানশির এবারও নতুন তালেবান সরকারকে প্রত্যাঘাত করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে।
পাঁচ শের বা বাঘ কিংবা পাঁচ সিংহের উপত্যকা বলা হয় পাঞ্জশির বা পানশিরকে। ফারসি ও পশতুন ভাষায় পাঞ্জশিরকে 'পাঁচ সমুন্নত মস্তক' বলেও মনে করা হয় এই জনপদের অধীনস্থ না থাকার ঐতিহাসিক গৌরবের জন্য।
হিমালয় পর্বতমালার পশ্চিম ঢালে হিন্দুকুশ পর্বতের দুর্গম অলিন্দে পানশিরের কৌশলপূর্ণ অবস্থান। রাজধানী কাবুল থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হলেও সেখানে যাওয়ার পথ খুবই বন্ধুর ও কঠিন। তদুপরি সেখানে রয়েছে বাইরের আক্রমণ ঠেকানোর বহু প্রাকৃতিক প্রতিরোধ। তাছাড়া সেখান থেকে সহজেই মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে কিংবা উপরের দিকে চীনের সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় আত্মগোপনের সুবিধাও অনেক। ফলে পানশির থেকে বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ করা যত সহজ, পানশিরকে পদানত করা ততই কঠিন।
পানশিরের পার্বত্য-জঙ্গলে আকীর্ণ জনপদে বহু জাতিগোষ্ঠীর বসবাস, যাদের মধ্যে তাজিক জাতিই প্রধান।
মধ্য এশিয়ার তাজিকিস্তানের সঙ্গে এদের যোগাযোগ রয়েছে। আরও আছে শিয়া মতাবলম্বী হাজারা গোষ্ঠী, যাদের সংযোগ ইরানের সঙ্গে।
অতীতে পানশিরের নানা প্রতিরোধ মধ্য এশীয় দেশগুলো ছাড়াও ইরানের বিশেষ সমর্থন পেয়েছিল। এবার অবশ্য ইরান কাবুলের তালেবান সরকারের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানিয়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে পানশিরে যুদ্ধ ও পাল্টাযুদ্ধে বহু মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তালেবান আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইরান প্রথমবারের মতো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
পানশিরে রক্তারক্তি পরিস্থিতির পটভূমিতে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সায়ীদ খাতিবজাদেহ এক সংবাদ সম্মেলনে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, 'পানশির থেকে আসা খবরগুলো সত্যিই উদ্বেগজনক। পানশিরের জন্য শুধু রাজনৈতিক সমাধানই খোলা আছে এবং আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার আইন অনুযায়ী পানশিরের অবরোধ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না।'
আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত থাকা ইরান এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং তালেবানদের হটাতে নর্দান অ্যালায়েন্সকে প্রচুর সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু মধ্য আগস্টে কট্টরপন্থি এই গোষ্ঠীটি ফের ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাদের সমালোচনা করা থেকে বিরত ছিল ইরান। তবে প্রবল যুদ্ধ ও হতাহতের মাধ্যমে পানশির দখল করার পর তালেবানদের প্রতি সামরিক পদক্ষেপের বদলে রাজনৈতিক সমঝোতার বার্তা দিয়েছে ইরান।
মিডিয়া ও তালেবান সূত্রগুলো জানিয়েছে, পানশির উপত্যকা এখন কাবুলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। প্রতিরোধকারী বাহিনীগুলো এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে এখনও পানশিরের দুর্গম অঞ্চলে নিরাপদে অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে। তবে ইতোমধ্যে তালেবান কিছু ভিডিও আপলোড করেছে যেগুলোতে তাদের যোদ্ধাদের পানশির প্রদেশের রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে তালেবানের পতাকা উত্তোলন করতে দেখা গেছে। এর মাধ্যমে আফগানিস্তানে ‘যুদ্ধ সমাপ্ত’ ও 'পূর্ণ বিজয়' নিশ্চিত হয়েছে বলে তালেবান মুখপাত্র জাবিহউল্লাহ মুজাহিদ দাবি করেছেন।
পানশিরের ‘ন্যাশনাল রেজিট্যান্স ফ্রন্ট’ এর নেতা আহমদ মাসুদ ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট (আফগানিস্তানের) আমরুল্লাহ সালেহর কী হয়েছে বা তারা কোথায় আছেন তা পরিষ্কার হয়নি। বিভিন্ন সূত্রের মতে, সালেহ পার্শ্ববর্তী তাজিকিস্তান পালিয়ে গেছেন। কিন্তু এক টুইটে মাসুদ ‘তিনি নিরাপদ আছে’ বলে জানালেও কোথায় আছেন তা পরিষ্কার করেননি।
তালেবান কর্তৃপক্ষ পানশিরের বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের। পানশির উপত্যকার তালেবানবিরোধী মনোভাবের বাসিন্দাদের ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেছে তারা। এই প্রদেশটি শাসন করা তালেবানের জন্য একটি বড় পরীক্ষা হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশেষত, আফগানিস্তানের জাতিগত বিভিন্নতার মধ্যে সমন্বয় রাখতে পানশিরকে আস্থায় আনতে হবে তালেবানদের। তদুপরি, ইরান ও তাজিকিস্তানের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীদের মনোভাবও বহুলাংশে নির্ভরশীল তালেবানদের পানশির বিষয়ক পদক্ষেপের উপর। প্রায় কুড়ি দিন ক্ষমতায় থাকা তালেবানদের সামনে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি পানশিরে সামরিক কর্তৃত্ব, রাজনৈতিক আস্থা এবং সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিষয়গুলোই এখন ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।