× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ফিরে দেখা ৯/১১

মত-মতান্তর

ড. মাহফুজ পারভেজ
৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, বুধবার

দুই যুগ বা কুড়ি বছর আগে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল মঙ্গলবার। আমেরিকায় দিনটি এসেছিল প্রলয়ের মতো। তাবৎ বিশ্ব চমকে গিয়েছিল ঘটনার ভয়াবহতায়।
যা পাল্টে দিয়েছে পুরো পৃথিবীর রাজনৈতিক ও সামরিক নিরাপত্তার ধারণা। 
 
বিশ্ববাসী টানটান উত্তেজনাকর লাইভে দেখেছিল, আমেরিকায় চারটি যাত্রীবাহী জেট বিমান ছিনতাই করে সেগুলো দিয়ে আঘাত হানা হচ্ছে নিউইয়র্কের দুটি আকাশচুম্বী ভবনে। প্রাথমিকভাবে জানা যায়, ছিনতাইকারীরা ছোট ছোট দলে পূর্ব আমেরিকার আকাশপথ দিয়ে ওড়া চারটি বিমান একইসাথে ছিনতাই করে।
তারপর বিমানগুলো দিয়ে নিউইয়র্ক আর ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ ভবনে আঘাত হানা হয়। হামলায় অংশ নেয়া দুটি বিমান বিধ্বস্ত করা হয় নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার ভবনে।
 
প্রথম বিমানটি আঘাত হানে নর্থ টাওয়ারে আমেরিকার পূর্বাঞ্চলীয় সময় সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে। দ্বিতীয় বিমানটি সাউথ টাওয়ারে বিধ্বস্ত হয় এর অল্পক্ষণ পর, সকাল ৯টা ৩ মিনিটে। সঙ্গে সঙ্গে দুটি ভবনেই আগুন ধরে যায়। ভবন দুটির উপরতলায় মানুষজন আটকা পড়ে। শহরের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে বিশাল ধোঁয়ার কুণ্ডলী।
দুটি টাওয়ার ভবনই ছিল ১১০ তলা। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে দুটি ভবনই বিশাল ধুলার ঝড় তুলে মাটিতে ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ে আর তৃতীয় বিমানটি রাজধানী ওয়াশিংটনের উপকণ্ঠে প্রতিরক্ষা বিভাগের বিশাল সদর দপ্তর পেন্টাগনের পশ্চিম অংশে আঘাত হানে স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে।
 
সকাল ১০টা ৩ মিনিটে চতুর্থ বিমানটি আছড়ে পড়ে পেনসিলভেনিয়ার এক মাঠে। ছিনতাই হওয়া চতুর্থ বিমানের যাত্রীরা ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পর সেটি পেনসিলভেনিয়ায় বিধ্বস্ত হয়। ধারণা করা হয়, ছিনতাইকারীরা চতুর্থ বিমানটি দিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্যাপিটল ভবনের ওপর আঘাত হানতে চেয়েছিল।
 
৯/১১ হামলায় সব মিলিয়ে মারা গিয়েছিল ২,৯৭৭ জন। এই হিসাবের মধ্যে ১৯ জন ছিনতাইকারী অন্তর্ভুক্ত নেই। নিহতদের বেশিরভাগই ছিল নিউইয়র্কের লোক। সর্বকনিষ্ঠ নিহতের বয়স ছিল দু'বছর। নাম ক্রিস্টিন লি হ্যানসন। তার বাবা মায়ের সাথে সে একটি বিমানের যাত্রী ছিল। নিহত সর্ব জ্যেষ্ঠ ব্যক্তির নাম রবার্ট নর্টন। তার বয়স ছিল ৮২। তিনি ছিলেন অন্য আরেকটি বিমানে এবং তার স্ত্রী জ্যাকুলিনের সাথে তিনি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন।
 
প্রথম বিমানটি যখন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আঘাত করে, তখন ভবনের ভেতরে আনুমানিক ১৭ হাজার ৪০০ জন লোক ছিল। নর্থ টাওয়ারের যে অংশে বিমান আঘাত করে, তার উপরের কোন তলার মানুষই প্রাণে বাঁচেনি। তবে সাউথ টাওয়ারে যেখানে বিমান আঘাত করে, তার উপরের অংশ থেকে ১৮ জন প্রাণ নিয়ে বেরুতে পেরেছিল। হতাহতের মধ্যে ৭৭টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষ ছিলেন। নিউইয়র্ক শহরে যারা প্রথম ঘটনাস্থলে জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় ছুটে যান, তাদের মধ্যে ৪৪১ জনের মৃত্যু হয়।
 
৯/১১ হামলায় হাজার হাজার মানুষ আহত হন, যারা পরে নানাধরনের অসুস্থতার শিকার হন। যেমন দমকলকর্মীদের অনেকে বিষাক্ত বর্জ্যের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিউইয়র্কে হামলার স্থান, যেখানে টুইন টাওয়ার বিধ্বস্ত হয়েছিল, সেই 'গ্রাউন্ড জিরো'র ধ্বংসস্তুপ পরিষ্কার করতে সময় লেগেছিল আট মাসেরও বেশি। ওই স্থানে এখন তৈরি হয়েছে একটি যাদুঘর এবং একটি স্মৃতিসৌধ। ভবনগুলো আবার নির্মিত হয়েছে, তবে ভিন্ন নক্সায়। সেখানে মধ্যমণি হিসাবে নির্মিত হয়েছে 'ফ্রিডম টাওয়ার', যা উচ্চতায় আগের নর্থ টাওয়ারের চেয়েও বেশি। নর্থ টাওয়ারের উচ্চতা ছিল ১,৩৬৮ ফুট আর নতুন ফ্রিডম টাওয়ার ১,৭৭৬ ফুট উঁচু। পেন্টাগন পুনর্নিমাণে সময় লেগেছিল এক বছরের কিছু কম। ২০০২ সালের আগাস্টের মধ্যে পেন্টাগনের কর্মচারীরা আবার তাদের কর্মস্থলে ফিরে যান।
 
৯/১১ ঘটনার পর বিশ্বে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'র ঘোষণা দেয় আমেরিকা ও তার মিত্ররা। ওই হামলার এক মাসেরও কম সময় পর তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ আফগানিস্তান আক্রমণ করেন আল-কায়দাকে নিশ্চিহ্ন করতে এবং ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে বের করতে। আমেরিকার নেতৃত্বাধীন এই অভিযানে যোগ দেয় আন্তর্জাতিক মিত্র জোট। যুদ্ধ শুরুর কয়েক বছর পর ২০১১ সালে মার্কিন সৈন্যরা অবশেষে ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পায় প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে এবং তাকে হত্যা করা হয়। হামলার অভিযুক্ত পরিকল্পনাকারী খালিদ শেখ মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করা হয় পাকিস্তানে ২০০৩ সালে। এর পর থেকে তাকে গুয়ান্তানামো বে'র বন্দীশিবিরে আমেরিকার তত্ত্বাবধানে আটক করে রাখা হয়। এখনও তিনি বিচারের অপেক্ষায় আছেন। 
 
তদুপরি, ৯/১১-এর প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি সারা বিশ্বে বিমান ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। আমেরিকাতে বিমানবন্দর ও বিমানের ভেতর নিরাপত্তা আরও কঠোর করতে 'ট্রান্সপোর্টেশান সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশান' নামে পরিবহন নিরাপত্তা প্রশাসন গঠন করা হয়েছে। পশ্চিমা সমাজে মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব বৃদ্ধি পায় এবং এতে বহু মুসলমান নর-নারী আক্রমণের শিকার হন।
 
তবে, ৯/১১ ঘিরে সন্দেহ, সমালোচনা ও আলোচনার অন্ত নেই। অনেক রহস্যের কোনও সমাধান হয়নি এখনও। মার্কিন প্রশাসনের নিজস্ব বয়ানের বিপরীতেও অনেক বক্তব্য আলোচিত হচ্ছে বিগত কুড়ি বছর ধরে। আসলে কারা হামলা করেছিল, এর পেছনে কাদের মদদ ছিল, জেটফুয়েলচালিত বিমান দিয়ে টুইন টাওয়ারের মতো বিশাল ভবন ধসিয়ে দেওয়া যায় কি না, এসব প্রশ্ন নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রটিও বদলে গিয়েছে ৯/১১-পরবর্তী নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়।
 
৯/১১-এর পর আমেরিকা সমরশক্তিতে বিশ্ব দখলে নেমে পড়ে 'সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধযুদ্ধ' পরিকল্পনার আওতায়। জাতিসংঘ ও মিত্রদেশগুলোকে পাশে নিয়ে খুঁজতে থাকে কথিত প্রতিপক্ষকে। স্নায়ুযুদ্ধকালে আমেরিকার মূল শত্রু ছিল কমিউনিস্টরা। আর ৯/১১-এর পর মূল শত্রু মুসলিম সন্ত্রাসবাদীরা, যাদেরকে 'অদৃশ্য শত্রু'র তকমা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে 'আমরা' বনাম 'ওরা'।
 
কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির স্বচ্ছ পৃথিবীতে 'অদৃশ্য শত্রু' বলে আদৌ কিছু থাকা সম্ভব? আর এই 'অদৃশ্য শত্রু' এল কোত্থেকে? সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই তো হচ্ছে তালেবান, আল-কায়েদা বা আইএসের বিরুদ্ধে। তথাপি জ্বলেছে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, মুসলিম দুনিয়া আর অকাতরে মরছে সাধারণ মানুষ। তাহলে 'অদৃশ্য শত্রু' কারা? এখানেই সন্ত্রাসবাদবিরোধী অনন্ত লড়াইয়ের মূলমন্ত্র লুকিয়ে আছে। যদি এই 'অদৃশ্য শত্রু'কে দৃশ্যমান করা যায়, তবে সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াই থেমে যাবে। যুদ্ধের দরজায় তালা পড়বে।  যুদ্ধবাজরা ঘরে ফিরে যাবে। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের দোকানে লালবাতি জ্বলবে। ধ্বংস, রক্ত, মৃত্যুর মহোল্লাস স্তব্ধ হবে। অথচ ৯/১১-এর কুড়ি বছর পেরিয়ে গেলেও সন্ত্রাস, পাল্টা-সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি।
 
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর