× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

তালেবান ও ভারতের সমীকরণ

মত-মতান্তর

ড. মাহফুজ পারভেজ
১১ সেপ্টেম্বর ২০২১, শনিবার

আমেরিকার মতোই ভারতের সার্বক্ষণিক চেষ্টা ও প্রত্যাশা ছিল তালেবানরা কাবুলের মসনদে না বসুক। প্রায় ৪২ বছর আফগানিস্তানে তীব্র সামরিক ও রাজনৈতিক ক্রাইসিস চলাকালে নানা গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্ক গড়লেও ভারত কখনোই তালেবানদের গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি, আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করলেও তালেবানদের বিমুখ করেছে ভারত।

ভারতের এই কৌশলে লাভজনক ফল আসে নি এবং তালেবানরাই দুই দফায় আফগানিস্তানের ক্ষমতা কাঠামোতে কর্তৃত্ব করছে। কেন ভারত তালেবানকে কখনোই পছন্দ করে নি, তার কারণ স্পষ্ট। চীন ও পাকিস্তানের মতো আফগানিস্তানও ভারতের বিরূপ প্রতিবেশী হোক, দিল্লি সেটা চায় নি। আর অগ্নিগর্ভ কাশ্মীরের স্বাধীনতার ইস্যুতে তালেবানদের স্পষ্ট সমর্থনের বিষয়টিও ভারতের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে রয়েছে।

ফলে ভারত তালেবান বিরোধী মুজাহিদিনকে (নর্দান অ্যালায়েন্স বা উত্তরের জোটের একাংশ) প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে সমর্থন দিয়েছিল। কাবুলে প্রতিষ্ঠিত মদদপুষ্ট হামিদ কারজাই এবং আশরাফ গণি সরকারকে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিল।

আফগানিস্তান প্রসঙ্গে ভারতের প্রচেষ্টাগুলো গোপন ছিল না।
উউত্তরাঞ্চলীয় জোটের আহমাদ শাহ মাসুদকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান থেকে শুরু করে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো সচেতনভাবে গ্রহণ করে ভারত। দিল্লির তৎকালীন নরসিংহ রাও সরকারের কূটনীতির কারণে ধীরে ধীরে মুজাহিদিন গোষ্ঠী ভারতের কাছে আসে, যার প্রথম সাফল্য দেখা যায় ১৯৯২ সালে। মুজাহিদিন নেতা এবং তৎকালীন আফগান রাষ্ট্রপতি বুরহানউদ্দিন রব্বানি জাকার্তায় জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সভায় যোগদানের আগে দিল্লিতে নরসিংহ রাওয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন।

ভারতের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মুজাহিদিনদের নিজেদের মধ্যে কলহের কারণে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হয়। সেই অবস্থা থেকে দেশকে বাঁচানোর স্বপ্ন দেখিয়েই মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালেবানরা নিজেদের জায়গা করে নেয়। তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের সম্পর্ক ছিল। ভারতের মতো পাকিস্তানের লক্ষ্য ছিল একটাই— কাবুলে বন্ধু সরকার। যা হবে ভারত-বিরোধী। তালেবানের আক্রমণের সামনে একের পর এক মুজাহিদিন নেতা এবং যুদ্ধপতিরা আত্মসমর্পণ করে এবং অচিরেই কাবুলের দখল নেয় তালেবান। এবারের মতো তালেবানদের তৎকালীন জয়লাভ আঞ্চলিক রাজনৈতিক বিন্যাসে ভারতের পরাজয় ও পাকিস্তানের বিজয় বলে চিহ্নিত করা হয়।

গোড়া থেকে ভারত মুজাহিদিনকে নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল, যে তালেবানের উত্থানের বিষয়টিকে প্রথমে গুরুত্বই দেয়নি। ওই সময় আফগানিস্তানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার চোখ-কান-মাথা পুরোটা জুড়ে ছিলেন আহমাদ শাহ মাসুদ। কিন্তু ১৯৯৬ সালে তালেবানের কাবুল দখল এবং নাজিবুল্লার হত্যা ভারতের সামনে সঙ্কট তৈরি করে। আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে ভারতও ওই হত্যার নিন্দা করে এবং সকলের শেষে হলেও দূতবাস বন্ধ করে কাবুল থেকে চলে আসে। দিল্লি সিদ্ধান্ত নেয়, মুজাহিদিনদের নিয়ে গঠিত উত্তরের জোটকে সমর্থন করবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে তালেবানদের সঙ্গে আলোচনার দরজা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ মেয়াদে বোঝা যায়, উত্তরের জোটকে সমর্থন করে ভারত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সাফল্য পেতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়।

অথচ তালেবানরা বিরোধী উত্তরাঞ্চলীয় জোটের আহমাদ শাহ মাসুদ, বুরহানউদ্দিন রব্বানিকে সব ধরনের সমর্থন দেওয়ার পরেও ভারতের সঙ্গে আলোচনা এবং সুসম্পর্ক গড়তে চাওয়ার সঙ্কেত দিয়েছে একাধিক বার। কিন্তু ভারত সরকার সেই ডাকে সাড়া দেয়নি। সাড়া না দেওয়ার কারণ হিসেবে ভারত বলেছে, ‘তালেবান পাকিস্তানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা মানে তালেবান সরকারের কাছে নত হওয়া।’ এই ভাবভঙ্গির ফলে অচিরেই ভারত এবং কাবুলের সম্পর্ক পাকাপাকি ভাবে ঠান্ডা ঘরে চলে গিয়েছে অনেকদিন আগেই।

এহেন তালেবান অপছন্দের ফল ভারত পায় ১৯৯৯ সালে। যখন নেপাল থেকে ছিনতাই হওয়া ভারতীয় বিমান কান্দাহারে অবতরণ করানো হয়। তালেবানের সঙ্গে মধ্যস্থতার পথ খুলতেই সমস্যায় পড়তে হয় ভারতকে। কারণ, ওই সময় তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের মাটিতে ভারতের হয়ে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করার মতো কেউ ছিলেন না। আলোচনা শুরু হয় যখন দিল্লি থেকে প্রতিনিধিরা উড়ে যান। তালেবান ভাল-খারাপ দুটি চরিত্রে অবতীর্ণ হয়ে ঘটনাটিকে সামাল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে। তৎকালীন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশবন্ত সিংহ তালেবানের ভূমিকার প্রশংসা করেও জানিয়ে দেন যে, ভারত তার ঘোষিত সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়বে না। তার দু’বছর পরে আমেরিকার হস্তক্ষেপে তালেবান সরকারের পতন হয়, যাতে ভারতের পক্ষ থেকে তালেবান বিরোধিতা অব্যাহত ছিল।

তালেবানদের বিষয়ে ভারত সবসময়ই চূড়ান্ত নেতিবাচক কৌশল ও একপেশে মনোভাব নিয়ে কাজ করেছে। ভারতের কাছে আফগানিস্তান মানে হলো 'মাইনাস তালেবান'। ফলে কাবুলে তালেবান বিরোধী সরকার থাকলে ভারত 'হিরো' ও 'কিং মেকার' হয় আর তালেবান সরকার থাকলে পুরোপুরি 'জিরো' হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এমন চরমপন্থা যে মোটেও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নয়, দিল্লি সেটা এখন কঠিনভাবে টের পাচ্ছে। আমেরিকার পর সবচেয়ে বেশি বিনিযোগকারী ভারতের বহু প্রকল্প ও পরিকল্পনা আফগানিস্তানে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

ভারত তালেবানদের শক্তির পরিমাপ ও সামর্থ্যের প্রভাব নির্ধারণ করতে বার বার ভুল করেছে। ভারত ধরেই নিয়েছে 'তালেবান মানে পাকিস্তান'। এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক ভয় ভারতকে তালেবান থেকে দূরে থাকতে ও বিরোধিতা করতে সর্বদা প্ররোচিত করেছে। কিন্তু তালেবানের পিছনে পাকিস্তানের সমর্থন আছে, সে কথা কারও অজানা না থাকলেও তালেবানের উপর পাকিস্তানের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং আছে, এ কথা ভাবা ছিল ভারতের মস্ত বড় ভুল। অন্য অনেক গোষ্ঠীর মতোই তালেবানদের মধ্যেও মতপার্থক্য রয়েছে। হাক্কানিরা ঘোষিত পাকিস্তানপন্থী হলেও আবদুল গণি বরাদরের মতো নেতারাও রয়েছেন। যাঁরা পাকিস্তান বিরোধী হিসেবে পরিচিত। এমনকি, হাক্কানিদের অন্যতম শীর্ষনেতা আনাস হাক্কানি ভারতের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে সংবাদমাধ্যমের কাছে মতামত দিয়েছিলেন। তালেবানদের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা আব্বাস স্ত্যানিকজাই অতিসম্প্রতি ভারতের কাছে অনুরোধ করেছেন দূতাবাস বন্ধ না করার জন্য। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, পাকিস্তানের বহু চেষ্টা সত্ত্বেও তালেবান কখনও ‘ডুরান্ড সীমানা’ (বৃটিশ নির্ধারিত আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত) মেনে নেয়নি। তালেবানও চায়, ভারতের মতো দেশগুলো তার সরকারকে স্বীকৃতি দিক, যদিও মুখ ফিরিয়ে থাকা ভারত এতে আগ্রহী না হয়ে আফগানিস্তান প্রসঙ্গে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে।

তালেবান ইস্যুতে ভারতের একরোখা বিরোধিতার পর্যালোচনাকালে দেখা যায়, ২০১০ সালের লন্ডন বৈঠকে যখন খোদ আমেরিকা প্রথমবারের মতো তালেবানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার প্রস্তাব দেয়, তখন ভারত তার বিরোধিতা করেছিল। তবে ধীরে ধীরে দোহা আলোচনা যত এগিয়েছে এবং আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের সম্ভাবনা যত বৃদ্ধি পেয়েছে, ভারত তালেবানের সঙ্গে আলোচনার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে। কখনও রাশিয়ায়, কখনও কাতারে একাধিক বার আলোচনায় বসেছে ভারত। কিন্তু কোনও বৈঠকই ফলপ্রসূ হয়নি।

সম্ভবত এখন ভারত বুঝতে পেরেছে, বিগত ২০ বছরে আফগানিস্তান গঠনে তার যে ভূমিকা, তা রক্ষা করতে গেলে তাকে গতবারের মতো ময়দান ছেড়ে চলে এলে হবে না। পাকা খেলোয়াড়ের মতো মাটি আঁকড়ে টিকে থাকতে হবে। ইতিমধ্যে আমেরিকা, ইরান, বৃটেন, কানাডা, রাশিয়া, জার্মানি-সহ ইউরোপের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ভারত আলোচনা শুরু করেছে। কিন্তু শুধু তা করলেই হবে না। পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে আলোচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবতা হলো এই যে, আলোচনার মাধ্যমেই ভারতের কূটনৈতিক সাফল্য আসতে পারে এবং কাবুলে জায়গা করে নিয়েই পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হতে পারে।

তা না হলে ভারতকে আফগানিস্তান ইস্যুতে 'সাইন লাইন প্লেয়ার' হয়ে যেতে হবে। কারণ, তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত সমর্থিত উত্তরের জোটের আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই বললেই চলে। এটা বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে, ২০০১ সালের পর থেকে ভারতের আফগান নীতি তৈরি হয়েছে আমেরিকাকে ঘিরে। সেই আমেরিকাও প্রত্যাহার করে নিয়েছে নিজেকে। ফলে আলোচনা ও সম্পর্কোন্নয়ন ছাড়া একাকী ভারতের কাছে অন্য কোনও পথ নেই। কূটনৈতিক পদক্ষেপ বাড়িয়ে তালেবান গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার এই পথ ভারত গ্রহণ করবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। এটাও স্পষ্ট নয় যে, ভারত অন্য কোনও পথে যাবে কিনা। তবে, সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, আফগানিস্তান প্রসঙ্গে মাঠে নেমেছেন ভারত, আমেরিকান, রাশিয়ান গোয়েন্দা কর্তারা। 'টার্গেট কাবুল তৎপর তিন গোয়েন্দা বস' শীর্ষক খবরে রয়েছে নানা ইঙ্গিত (https://m.mzamin.com/article.php?mzamin=292400)। ফলে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা বলা মুস্কিল। বিশেষত, আফগানিস্তান ইস্যুতে ভারত অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে তালেবানদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে এগুবে, নাকি নতুন কোনও ভুল করবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর