× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

কম্পিউটার অপারেটর থেকে ৪৬০ কোটি টাকার মালিক

প্রথম পাতা

শুভ্র দেব
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, বুধবার

টেকনাফ বন্দরের সাবেক কম্পিউটার অপারেটর নুরুল ইসলাম (৪১)। কর্মজীবন শুরু হয়েছিল দৈনিক ১৩০ টাকা মজুরিতে। ওই পদে চাকরির সময় পরিচয় হয় বড় বড় ব্যবসায়ী, বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে। তখন থেকেই তাদের সঙ্গে গড়ে তোলে সুসম্পর্ক। এই সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে শুরু হয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কাজ আদায়। কিছুদিন চাকরির পর বুঝে ওঠে বন্দরের সকল মারপ্যাঁচ। আয়ত্ত করে নেয় কীভাবে ফাঁকি দিয়ে পণ্য খালাস করা যায়। এজন্য গড়ে তোলে একটি সিন্ডিকেট।
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দিনের পর দিন শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ব্যবসায়ীদের পণ্য খালাস করে দিতেন। বিনিময়ে নিতেন মোটা অংকের টাকা। এভাবে অল্প কিছুদিনের মধ্যে তার কয়েক কোটি টাকা আয় হয়ে যায়। অবৈধভাবে আয় করা এসব টাকা দিয়ে শুরু করে জমি, বাড়ি, গাড়ি কেনা। শুধু জমি কিনতেন না জমি কেনা-বেচার ব্যবসাও করতেন। এভাবে অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই দৈনিক ১৩০ টাকা মজুরির কম্পিউটার অপারেটর হয়ে যান শত শত কোটি টাকার মালিক। এখন তার কি নাই। প্রাথমিকভাবেই তার শুধুমাত্র ৪৬০ কোটি টাকার জমি ও বাড়ি কেনার তথ্য মিলেছে। এছাড়া ব্যাংক ভর্তি টাকা, ফিক্সড ডিপোজিট, দামি গাড়ি, বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে। বন্দরের দালালির পাশাপাশি জালনোট, বিদেশি মুদ্রা ও ইয়াবার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। সুনির্দিষ্ট বেশকিছু অভিযোগে তাকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে।

র‌্যাব জানিয়েছে, সোমবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে নুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তার কাছ থেকে ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ টাকার জাল নোট, ৩ লাখ ৮০ হাজার মিয়ানমার মুদ্রা, ৪ হাজার ৪০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট এবং নগদ ২ লাখ ১ হাজার ১৬০ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।

র‌্যাব’র মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নুরুল ইসলাম ২০০১ সালে টেকনাফ স্থলবন্দরে চুক্তিভিত্তিক দৈনিক ১৩০ টাকায় কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি নেন। বন্দরে কর্মরত থাকাকালীন তার অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে চোরাকারবারি, শুল্ক ফাঁকি, অবৈধ পণ্য খালাস, দালালি ইত্যাদির কৌশল রপ্ত করেন। পরে বিভিন্ন রকম দালালির সিন্ডিকেটে যুক্ত হন। এক পর্যায়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে। ২০০৯ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দেয়। পরে তারই আস্থাভাজন একজনকে উক্ত কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করে। কিন্তু দালালি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ তার নিজের কাছে রেখে দেন। এভাবে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

তিনি বলেন, নুরুল টেকনাফ বন্দরকেন্দ্রিক দালালি সিন্ডিকেটের অন্যতম মূলহোতা। তার সিন্ডিকেটের ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছেন। যারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে দালালি করেন। এই সিন্ডিকেটটি পণ্য খালাস, পরিবহন সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পথিমধ্যে অবৈধ মালামাল খালাসে সক্রিয় ছিল। সিন্ডিকেটের সহায়তায় পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কাঠ, শুঁটকী মাছ, বরই আচার, মাছ ইত্যাদির আড়ালে অবৈধ পণ্য আনতো। চক্রটির সদস্যরা টেকনাফ বন্দর, ট্রাকস্ট্যান্ড, বন্দর লেবার ও জাহাজের আগমন-বহির্গমন নিয়ন্ত্রণ করতো। তার সঙ্গে চিহ্নিত মাদক কারবারিদের যোগসাজশ ছিল। এছাড়া তিনি অন্যান্য অবৈধ পণ্যের কারবারের জন্য হুন্ডি সিন্ডিকেটের সঙ্গে সমন্বয় এবং চতুরতার সঙ্গে আন্ডার ও ওভার ইনভয়েস কারসাজি করতেন।

মঈন বলেন, অবৈধ আয় দিয়ে নুরুল ঢাকায় ৭৩ কোটি টাকা দিয়ে মূল ৬টি বাড়ি কিনেছে। ঢাকার ১৩টি স্থানে ১৬৫ কোটি টাকার জমি রয়েছে। জমিসহ আরও ৪টি রিকশার গ্যারেজ রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ৩১ কোটি টাকা। সাভারের পৃথক ৭টি স্থানে ১১৮ কোটি টাকা মূল্যের জমি রয়েছে। টেকনাফের বিভিন্ন স্থানে ২০ কোটি টাকা মূল্যের চারটি জমি ও বাগান বাড়ি রয়েছে। ভোলা জেলায় ১২ কোটি টাকা মূল্যের দু’টি জমি রয়েছে। কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনে ১২ কোটি টাকার ১টি জমি রয়েছে। এছাড়াও নামে-বেনামে বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য জমি। ব্যাংক হিসাবে রয়েছে অসংখ্য টাকা। গাড়ি রয়েছে বেশ কয়েকটি। জাহাজ শিল্প ও ঢাকার পাশে বিনোদন পার্কে তিনি বিনিয়োগ করেছেন।

র‌্যাব জানায়, নুরুল ইসলাম অবৈধ সম্পদকে বৈধ হিসেবে দেখানোর জন্য ২০০৯ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি পাঁচটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় জড়িত। গত বছর তিনি নাম লেখান রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- এমএস আল নাহিয়ান এন্টারপ্রাইজ, এমএস মিফতাউল এন্টারপ্রাইজ, এমএস আলকা এন্টারপ্রাইজ, আলকা রিয়েল স্টেট লিমিটেড এবং এমএস কানিজ এন্টারপ্রাইজ অন্যতম।

র‌্যাবসূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, নুরুল ইসলামের সাভারের আমিনবাজারে বড় বরদেশি মৌজার পৃথক ৭টি স্থানে ১১৮ কোটি টাকা মূল্যের ২৩০ শতাংশ জমি আছে। কক্সবাজারের টেকনাফ সদরের লেঙ্গুর বিলে কোটি টাকা মূল্যের ১১০ দশমিক ৪২ শতাংশ জমি। টেকনাফের সাবরাং এ পৃথক দু’টি স্থানে ৮ কোটি টাকা মূল্যের শূন্য দশমিক ৪৫ একর জমি। এছাড়া সাবরাং এর আরেকটি স্থানে ৫ কোটি টাকার আরও ৩৩.১৩ শতাংশ জমি। সেন্টমার্টিনের জিঞ্জিরা দ্বীপে ১২ কোটি টাকার ২০ শতাংশ জমি। ভোলা সদরের পৃথক দু’টি স্থানে ৩২ ও ২৬ শতাংশ জমি রয়েছে। যার মূল্য ১২ কোটি টাকা।

নুরুলের ঢাকার ১৩টি পৃথক স্থানে ১৬৫ কোটি টাকার জমির মধ্যে মোহাম্মপুরের ঢাকা উদ্যানের একতা হাউজিংয়ের ৬ নম্বর রোডের ১৪৪ নম্বর বাড়িতে ৩ কোটি টাকা মূল্যের সাড়ে চার কাঠা জমি, ঢাকা উদ্যানের ২ নম্বর রোডের ডি-ব্লকে ৩ কোটি টাকা মূল্যের পৌনে চার কাঠা জমি। চন্দ্রিমা মডেল টাউনের এ ব্লকের ৭ নম্বর রোডের ১ নম্বর প্লটে ৪ কোটি টাকা মূল্যের তিন কাঠা জমি। একই মডেল টাউনের ৭ নম্বর প্লটের ৭ নম্বর ব্লকে তিন কোটি টাকা মূল্যের আড়াই কাঠা জমি। মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর মৌজায় ৮ কোটি টাকা মূল্যের ১৫ শতাংশ জমি। সিলিকন রিয়েল সিটিতে ৯ কোটি টাকা মূল্যের ১৫.৭৫ কাঠা জমি। রাম চন্দ্রপুর মৌজায় স্ত্রীর নামে ৪ কোটি টাকা মূল্যের তিন কাঠা, একই মৌজায় স্ত্রীর নামে ১৮ কোটি টাকা মূল্যের শূন্য দশমিক ৫৭ একর, একই মৌজায় স্ত্রীর নামে ৭৫ কোটি টাকা মূল্যের ২ দশমিক ১০ একর, একই মৌজায় স্ত্রীর নামে ১৮ কোটি টাকা মূল্যের আরও শূন্য দশমিক ৫৬ একর, সিলিকন রিয়েল সিটির পৃথক জায়গায় ১১ কোটি টাকা মূল্যের ২০ দশমিক ৬১ কাঠা, রাম চন্দ্রপুর মৌজায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের ৪৭ দশমিক ২৫ শতাংশ, একতা হাউজিংয়ের দ্বিতীয় প্রকল্পে ৪ কোটি টাকা মূল্যের ৪ কাঠা জমি রয়েছে।
র‌্যাব জানিয়েছে, নুরুল ইসলামের ঢাকায় বাড়ি রয়েছে ৬টি। এরমধ্যে আদাবরের নবোদয় হাউজিংয়ের ডি-ব্লকের তিন নম্বর রোডে ৮ নম্বর বাড়িটি নুরুলের। ৭ কাঠা জমিতে ৭তলা বাড়িটির বর্তমান মূল্য ১৫ কোটি টাকা। মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের হাজী দীন মোহাম্মদ সড়কের ৫৫ নম্বরের সাত তলা বাড়িটি ৪ কাঠা জমির ওপর। এই বাড়ির বর্তমান মূল্য ১৪ কোটি টাকা। হাজী দীন মোহাম্মদ সড়কের ২৬ নম্বর প্লটে ১১ কাঠা জমিতে দুই তলা ভবন রয়েছে। নিচ তলায় দোকান রয়েছে ৭টি। এই বাড়ির বর্তমান মূল্য ১৮ কোটি টাকা। ঢাকা উদ্যানের একতা হাউজিংয়ের ৪ নম্বর রোডের ৬৬টি নম্বর বাড়িও নুরুলের। ৩ কাঠা জমিতে ৩ তলা এই বাড়ির মূল্য ৪ কোটি টাকা। চন্দ্রিমা মডেল টাউনের বি-ব্লকের ৭ নম্বর রোডের ১০ প্লটে রয়েছে ১টি বাড়ি। সাড়ে ৪ কাঠা জমির ওই বাড়ির মূল্য ৫ কোটি টাকা। নুরুলের ঢাকা উদ্যানের ডি-ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ৩৫ নম্বর বাড়িতে জমির পরিমাণ ৯ কাঠা। বাড়ির নিচে দোকান আছে ১৭টি। বাড়ির বর্তমান মূল্য ১৫ কোটি টাকা।

র‌্যাব’র সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, ঢাকায় জায়গাসহ নুরুলের চারটি রিকশার গ্যারেজ রয়েছে। এই চারটি জমির বতর্মান দাম প্রায় ৩১ কোটি টাকা। এরমধ্যে ঢাকা উদ্যানের বি-ব্লকের ২ নম্বর রোডের ৮ নম্বর প্লটে রয়েছে ৮ কাঠা জমি। ৮ কোটি টাকা দামের এই জমিতে রয়েছে ১টি রিকশা গ্যারেজ ও দু’টি দোকান ঘর। একতা হাউজিংয়ের দ্বিতীয় প্রকল্পের ৮ কাঠা জমিতে রয়েছে আরেকটি রিকশা গ্যারেজ ও ২টি দোকান ঘর। জমির দাম ৭ কোটি টাকা। একই প্রকল্পে ডি-ব্লকের তিন নম্বর রোডের ৪৪ নম্বর প্লটে রয়েছে ৫ কোটি টাকা দামের সাড়ে চার কাঠা জমি। এখানে ১টি রিকশা গ্যারেজ, ১টি ঘর ও দোকান রয়েছে। আদাবরের নবীনগর হাউজিংয়ে ৮ নম্বর রোডে ৯ কাঠা জমিতে রিকশা গ্যারেজ ও ৭টি দোকান রয়েছে। যার বর্তমান দাম ১১ কোটি টাকা।

র‌্যাব’র তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নুরুলের স্ত্রী ২৮ লাখ টাকা দামের ১টি প্রাইভেট কার ব্যবহার করেন। তিনটি প্রতিষ্ঠানে তার নিজের ও স্ত্রীর নামে দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। ব্যাংক হিসাবে জমা আছে ১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বরের পরে ১১টি ব্যাংক হিসাব থেকে তোলা হয়েছে ৬ কোটি ৮৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

র‌্যাব জানিয়েছে, নুরুল ইসলাম অবৈধভাবে যে সম্পদ অর্জন করেছে তার মধ্যে খুব কম সম্পদ রেখেছে তার নিজের নামে। বেশির ভাগ সম্পদ রেখেছে তাঁর স্ত্রী ও ভাইয়ের নামে। নুরুল বন্দরের যে পদে চাকরি করতো, এখন সেই পদে চাকরি করেন তাঁর সৎভাই রনি। এখনো নুরুল টেকনাফ বন্দরের দালালি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। সম্প্রতি নুরুল ঢাকার সাভারে তিন একর জমির ওপর একটি পার্ক বানানোর কাজে হাত দেন। একটি জাহাজও কেনার চেষ্টা করেছিলেন।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর