‘আফগানিস্তানে তালেবান সরকার: চ্যালেঞ্জ ও এর আঞ্চলিক প্রভাব প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক আলোচনায় বিশ্লেষকরা বলেছেন- আফগানিস্তান ও তালেবান ইস্যুতে বাংলাদেশকে সতর্কতা এবং ধৈর্যের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সম্ভব হলে তালেবানের দোহা অফিসের সঙ্গে ব্যাক-চ্যানেল ওপেন করে প্রাথমিক আলোচনা করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই সেই আলোচনায় নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগগুলো তুলে ধরতে হবে। একই সঙ্গে তাদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের বিষয়ে সম্মুখ ধারণা লাভের চেষ্টা করতে হবে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টাডি গ্রুপ অন রিজিওনাল অ্যাফেয়ার্স বুধবার সকালে ওই ভার্চ্যুয়াল আলোচনার আয়োজন করে। ঘণ্টাব্যাপী ওই আলোচনায় বক্তারা বেশকিছু বিষয়ে প্রায় অভিন্ন মতামত দেন। তারা বলেন, আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক বা যোগাযোগে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ওই দেশ নিয়ে প্রতিবেশী ভারত এবং চীনের পরস্পরবিরোধী অবস্থান রয়েছে।
যেহেতু উভয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক ফলে আমাদের কোনো সিদ্ধান্তকে যেন তারা প্রভাবিত করতে না পারে সে ব্যাপারে সরকারকে সদা সজাগ থাকতে হবে। স্টাডি গ্রুপের চিফ এক্সিকিউটিভ সাংবাদিক আমির খসরুর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী (বীর বিক্রম), গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্ট্যাডিজ (বিপস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন এবং ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব ও লালবাগ মাদ্রাসার শিক্ষক মুফতি ফাইজুল্লাহ বক্তব্য রাখেন। সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন, যৌক্তিক জবাব, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠা স্টাডি গ্রুপের ওই আলোচনার মূল ফোকাস ছিল পরিবর্তনের অঙ্গীকারকারী তালেবান নেতৃত্ব আদতে কী পারবে সমন্বিত কোনো সরকার উপহার দিতে, যা বহুজাতিক আফগানিস্তানে শান্তি ফিরাবে? বিশ্লেষকরা তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। ড. হোসেন জিল্লুর মনে করেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠাই তালেবান সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তালেবান সরকারকে স্বীকৃতির প্রশ্নে তিনি ভূ- রাজনীতি, রি-এলাইনমেন্ট এবং জাতীয় স্বার্থ- এই ৩টি বিষয় বিবেচনার পরামর্শ দেন। দুনিয়াতে ধর্ম নিয়ে অনেক উদ্দেশ্যমূলক আলোচনা আছে মন্তব্য করে তিনি ধর্মীয় ইস্যুতে সৎ আলোচনার তাগিদ দেন। একইসঙ্গে তিনি মহানবী (সা.) শিক্ষা গ্রহণ এবং এর প্রসারের তাগিদের বিষয়টি স্মরণ করেন। ড. হোসেন জিল্লুর বলেন, উগ্রবাদ নিয়ে ম্যানুপুলেটেড এবং আইডোলজিক্যাল- দু’ধরনের আলোচনা রয়েছে। সবাই নীতির কথা বলে, কিন্তু আদতে ক্ষমতার খেলা। আফগানিস্তান ইস্যুতে বাংলাদেশকে আরও পরিপক্বতার সঙ্গে বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মুনিরুজ্জামান বলেন, মনে রাখতে হবে এটি এক নতুন আফগানিস্তান। যেখানে নতুন করে সুশীল সমাজ গড়ে উঠেছে। বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী। তারা পূর্বের তালেবান শাসন দেখেনি। নতুন প্রজন্মের আফগানিস্তানে তাদের চাওয়া-পাওয়া এবং আকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনায় নিতে। তাদের কণ্ঠ শুনতে হবে। বাংলাদেশকে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সম্ভব হলে ওই তরুণদের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি ব্যাক-চ্যানেলে তালেবানের দোহা অফিসের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ চেষ্টা সংক্রান্ত প্রস্তাবের বিষয়ে বলেন, যোগাযোগ করা যেতে পারে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির আগে আমাদের উদ্বেগগুলো তাদের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে। তিনি চীনের উদাহরণ টেনে বলেন, তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে প্রথম বৈঠকেই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিনজিয়ান প্রদেশের বিদ্রোহী ইটিআইএনকে কোনোভাবে মদত না দেয়ার অঙ্গীকার আদায় করে নিয়েছেন। বাংলাদেশকেও নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয়গুলো স্পষ্ট করতে হবে সবার আগে। তালেবান সরকার নিয়ে ইরান, রাশিয়ার মতো অন্য রাষ্ট্রগুলোর অবজারভেশনও বিবেচনায় রাখার তাগিদ দেন জ্যেষ্ঠ ওই গবেষক কাম বিশ্লেষক। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী, বীরবিক্রম বলেন, তালেবানের আচরণ নতুন বোতলে পুরনো মদ কিনা- সেটা এখন দেখার বিষয়। বাংলাদেশের মানুষ তালেবানের মতাদর্শকে কখনোই সমর্থন করে না। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনেক ঘাটতি থাকলেও তালেবানের কোনো গোষ্ঠীকে এদেশের মানুষ স্থান দেবে না- দৃঢ়তার সঙ্গে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আফগানিস্তান তালেবানের হাতে। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো না- এমনটা আমি সমর্থন করি না। হ্যাঁ, আমাদের অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে এগুতে হবে। জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। আফগানিস্তান সার্কের সদস্য। দেশটির সঙ্গে আমাদের বহুমুখী যোগাযোগ রয়েছে। আমি ২০১২ সালে আফগানিস্তান সফর করেছি জাতিসংঘের একটি টিমের সদস্য হয়ে। আমি দেখেছি ব্র্যাক সেখানে চমৎকার কাজ করছে। আফগানিস্তানের মানুষ ব্র্যাকের কার্যক্রমকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে। তালেবানের নতুন সরকারের আমলে আমরা সেই কার্যক্রম চালাতে পারবো কিনা সেটা বুঝতে হবে। একইসঙ্গে গণতন্ত্র, স্কুল-কলেজের পড়াশোনা বিশেষত নারী শিক্ষার বিষয়ে তালেবানের মনোভাব আমাদের বুঝতে হবে। এই বোঝাপড়ার জন্যই দরকার ব্যাক চ্যানেলে দোহা অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ। মনে রাখতে হবে অস্থিতিশীল আফগানিস্তান কারও জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া অপর সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, এটা মানতে হবে যে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় ঘটেছে। কিন্তু এটা বৈশ্বিক রাজনীতিতে খুব পরিবর্তন আসবে বলে আমি মনে করি না। সেখানে তালেবানের উত্থানের অন্যত্র উগ্রপন্থা মাথা চাড়া দিতে পারে। এ ব্যাপারে প্রত্যেক রাষ্ট্রকে সজাগ থাকতে হবে। বাংলাদেশে করণীয় বিষয়ে তিনি বলেন, প্রত্যেক দেশ তার নিজস্ব স্বার্থ বিবেচনায় তালেবান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করবে অথবা করবে না। যদি দেখা যায়, তারা এমন একটি অবস্থানে চলে গেছে যে ডিল করতে হচ্ছে, তখন তা করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে লিড নেয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না তিনি। অবসরপ্রাপ্ত ওই কূটনীতিকের মতে, তালেবানের জয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়েছে তা বাংলাদেশকে খুব একটা প্রভাবিত করবে না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ সাধারণভাবে উগ্রবাদকে গ্রহণ করে না। কিছু সংখ্যক মানুষ এর দ্বারা প্রভাবিত হলেও এটা নিয়ন্ত্রণের সরকারি ম্যাকানিজম যথেষ্ট বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, কাতার তালেবান আর মাঠের তালেবানের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দু’একটি ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়। ঘটনা দুর্ঘটনা যাই হোক, তালেবান অন্য জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে দেশটাতে সরকার চালাতে পারবে কিনা- সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। এতে সফল হতে হলে তাদের আচরণে বড় ধরনের পরিবর্তন হবে। তা না হলে তারা দুনিয়ার সঙ্গে চলতে পারবে না।
মুফতি ফয়জুল্লাহর মতে, মুসলিম হিসেবে তালেবানের জয়ে হয়তো কিছুটা উচ্ছ্বাস প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমানরা কখনো তালেবান বা অন্য কোনো গোষ্ঠীকে আদর্শ মানে না। এ দু’য়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তালেবান সরকারকে স্বীকৃতির প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের ‘পর্যবেক্ষণ নীতি’র প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এতে আরও সময় নিতে হবে। আমাদের বিবেচ্য হওয়া উচিত ওআইসি এবং অন্য রাষ্ট্রগুলো কী করে তা দেখা।