× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

'শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ'

মত-মতান্তর

ড. মাহফুজ পারভেজ
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, শুক্রবার

১.
প্রাচীন পণ্ডিত সক্রেটিস যেমন বলেছেন, 'শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ', তেমনিভাবে না বললেও বা ভাবলেও শিক্ষা, শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে চিন্তা, স্মৃতি ও উদ্যোগের অন্ত নেই। ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এসব বিষয় সর্বদা চর্চিত হয়। বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকার নানা প্রজেক্ট ও পরিকল্পনা চলে শিক্ষা সংক্রান্ত ক্ষেত্রে। এ সংক্রান্ত নানা দিবসও আছে। ৫ই সেপ্টেম্বর ছিল 'শিক্ষক দিবস' আর শুক্রবার ১৭ সেপ্টেম্বর 'শিক্ষা আন্দোলন দিবস'।

২.
সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হল সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন।

বাংলা 'শিক্ষা' শব্দটি এসেছে ‍’শাস’ ধাতু থেকে।
যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা। অন্যদিকে শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ 'এডুকেশন' এসেছে ল্যাটিন শব্দ এডুকেয়ার বা এডুকাতুম থেকে। যার অর্থ বের করে আনা অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা।

শিক্ষা সংক্রান্ত সংজ্ঞা আরও ব্যাপকভাবে উপলব্ধি করা যায় মনীষীদের বক্তব্যে। সক্রেটিসের মতোই আরেক প্রাজ্ঞ পণ্ডিত এরিস্টটল বলেছেন, 'সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা'। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় 'শিক্ষা হল তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে'। দার্শনিক বাট্রাণ্ড রাসেল মনে করেন, 'মানুষের সুখী হওয়ার জন্যে সবচেয়ে বেশি দরকার বুদ্ধির এবং শিক্ষার মাধ্যমে এর বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব'।

খুঁজলে শিক্ষা বিষয়ক শত শত উক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষার তাৎপর্য নাগরিক ও শিক্ষার্থীদের জীবনে কতটুকু প্রকাশিত, সেটাই এক বড় প্রশ্ন। যদি সত্যিই তা হতো, তবে কিশোর সন্ত্রাসী গ্রুপ, মাদকাসক্তি, পর্নো ও বিকৃতি, দুর্নীতি, অনিয়ম, অনৈতিকতা সর্বত্র স্রোতের মতো প্রবাহিত হওয়ার কথা নয়। একদল শিক্ষিত মানুষের অমানবিকতায় সমাজ জর্জরিত হতো না এবং মিথ্যার অপনোদন হতো আর সত্যের বিকাশ ঘটতো। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না।

৩.
রিচার্ড ফাইনম্যান নোবেল পুরস্কারজয়ী বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি নিজেকে শিক্ষক ভাবতেই পছন্দ করতেন। 'ইফ ইউ ওয়ান্ট টু মাস্টার সামথিং, টিচ ইট'— এ শুধুমাত্র তাঁর বিখ্যাত উক্তিই নয়, মনেপ্রাণে কথাটা নিজের জীবনেও বিশ্বাস করতেন তিনি। তাঁর মত ছিল, 'ছাত্রদের সঙ্গে অনবরত জ্ঞান আদানপ্রদানের মধ্য দিয়েই বিজ্ঞানী/শিক্ষক বেঁচে থাকেন'।

ভাল শিক্ষক হতে গেলে যে আগে ভাল ছাত্র হতে হবে, অর্থাৎ বিষয়টা নিখুঁত ভাবে বুঝতে হবে— এ ব্যাপারে ফাইনম্যানের নির্দেশ অত্যন্ত পরিষ্কার। তাঁর মতে, 'কোনও বিষয়ের নাম জানাটা আদৌ জ্ঞান নয়, স্রেফ একটা তথ্য মাত্র। সেই তথ্য ব্যবহার করে যখন ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে কোনও ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যায়, তখনই তা জ্ঞানে উন্নীত হয় এবং বিষয়টাও ঠিকঠাক শেখা হয়ে ওঠে। কোনও বিষয় শেখানো মানেও শুধু কিছু তথ্য সরবরাহ করা নয়। বরং যাবতীয় কী, কেন, কীভাবে-র উত্তর খুঁজে পেতে সাহায্য করা।'

ফাইনম্যানের মতে, 'কোনও বিষয় একজন ঠিকঠাক শিখেছেন কি না, সেটা বুঝে নেওয়ার উপায় হল বিষয়টা একেবারে সহজ করে কাউকে বোঝাতে পারা। বোঝানোর সময় কোনও প্রতিশব্দ ব্যবহার করা চলবে না। সমীকরণও নয়। কারণ প্রতিশব্দ হল স্রেফ নাম, জ্ঞান নয়। বিশেষ প্রতিশব্দ ছাড়া যদি বিষয়টার কোনও অংশ ব্যাখ্যা করতে অসুবিধা হয়, তা হলে বুঝতে হবে নিজের বোঝায় কমতি আছে।'

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। উনুনে বসানো হাঁড়ির পানি কী ভাবে গরম হয়, সেটা বোঝাতে গিয়ে আমরা যদি বলি তাপের পরিচলন বা ‘কনভেকশন’ পদ্ধতি দায়ী, তা হলে শুধু পদ্ধতিটার নাম জানা হবে। প্রক্রিয়াটা কী? একটি ধাতব দণ্ড গরম হওয়ার পদ্ধতি (পরিবহণ বা ‘কন্ডাকশন’) থেকে তা আলাদা কেন? এগুলো বোঝা প্রয়োজন। তা না হলে কেউ প্রশ্ন করলেও আমরা বার বার ওই পরিচলন-পরিবহণই বলে যাব।

কিন্তু প্রক্রিয়াটা বোঝা থাকলে বিভিন্ন ‘সাধারণ শব্দ’ ও উদাহরণের সাহায্যেই বিষয়টা সহজ করে বোঝানো যায়। ব্যাপারটা শুধু বিজ্ঞান নয়, যে কোনও বিষয়ের ক্ষেত্রেই সত্যি। যেমন, একটা ছবির বা গল্পের বা কবিতার বৈশিষ্ট্য বোঝাতে গিয়ে বিমূর্ত বা ‘অ্যাবস্ট্র্যাক্ট’ কিংবা 'মর্ডান' বা পোস্টমর্ডান' বললে চলবে না, কারণ সেটা শুধুমাত্র একটা বৈশিষ্ট্যের নাম। যে লক্ষণগুলো তাকে বিমূর্ত, মূর্ত, আধুনিক কিংবা উত্তরাধুনিক করে তুলছে, সেগুলো বুঝিয়ে বলতে হবে।

৪.
শিক্ষা, বিজ্ঞান, জ্ঞানের সঙ্গে সংস্কৃতি ও জীবনবোধের সম্পর্ক রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক বৈশ্বিক মহামারি করোনার কথা। গত এক-দেড় বছরে তথাকথিত বহু শিক্ষিত মানুষের মুখে 'করোনা এসে দেখিয়ে দিল বিজ্ঞান আসলে কিছুই পারে না' ধরনের কথা শোনা গেছে। এই কথা থেকেই বোঝা যায় বিজ্ঞান আদৌ আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে ওঠেনি, শুধুমাত্র আমাদের কিছু পারা-না-পারার হাতিয়ার হয়ে রয়ে গেছে।

কেন পারে নি? কারণ, আমরা কোনও জ্ঞানকেই আমাদের জীবনের ও সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলতে পারিনি। আমাদের শেখা এবং পরবর্তী কালে শেখানো জুড়ে শুধুই একগুচ্ছ তথ্য। ফলে প্রথাগত লেখাপড়া শিখেও আমরা অনেক ক্ষেত্রেই কিছু তথ্য জানলেও বিষয়টি জানতে-বুঝতে এবং জীবনে বা জগৎ-সংসারে কাজে লাগাতে মোটেও পারছি না। এই ধারাবাহিক 'না-পারা' আমাদের এমন এক 'শিক্ষা', যার অপর নাম 'অজ্ঞতা', যা গভীরভাবে আমাদের ললাটে লেপ্টে আছে এবং এই দুর্বহ 'শিক্ষা' থেকে 'শিক্ষা' নিয়ে 'প্রকৃত শিক্ষিত' হওয়ার বিষয়টি সুদূরপরাহত হয়েই রয়েছে।

৫.
অথচ শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞানমনস্ক চর্চার ইতিহাস বেশ পুরনো। বৃটিশ বাংলা তৈরি করেছিল বিশ্ববরেণ্য শিক্ষিত, আলোকিত ও বিজ্ঞানীদের। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহেন্দ্রলাল সরকার প্রমুখের উদ্যোগে ১৮৭৬ সালে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। অত্যাধুনিক লেকচার থিয়েটার হল এবং বিশ্বমানের ল্যাবরেটরি গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। সেই ছাদের নীচেই একদা পদার্থবিদ্যায় জগদীশচন্দ্র বসু, রসায়নে কানাইলাল দে, গণিতে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ভূতত্ত্বে প্রমথনাথ বসু, জীববিজ্ঞানে নীলরতন সরকার-এর মতো পণ্ডিতরা ক্লাস নিতেন।

বরেণ্য ব্যক্তিদের স্বপ্ন ছিল, গ্রামের স্কুলগুলো থেকেই দেশের আগামীর বিজ্ঞানীরা উঠে আসবে। অথচ, বছরের পর বছর বিজ্ঞান-শিক্ষকের অভাবে, জাতীয় পরিকল্পনায় সামগ্রিক বিজ্ঞান-চৈতন্যের অভাবে, গ্রামবাংলা জুড়ে, স্কুলের পর স্কুলে ব্যাহত বিজ্ঞান শাখা। বিজ্ঞানী তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কমই দেখা যায়।

বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান-শিক্ষাকে আকর্ষক না করে তোলার দায় কার? এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দেন না। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের বাইরেও মহাবিশ্বের যে অপূর্ব রহস্য ছড়িয়ে রয়েছে, তার অনুসন্ধানে শিশু-কিশোর মনকে প্রণোদিত করার চেষ্টাও অধিকাংশ স্কুল-কলেজের শ্রেণিকক্ষে করা হয় না। নোটবই, পাঠ্যপুস্তকে বিজ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা চলে। কোন অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এখন বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছেন, বিগত দশকে কোন আবিষ্কারগুলো চমকে দিচ্ছে পৃথিবীকে, তার আলোচনা অধিকাংশ বিদ্যালয়ের ক্লাসঘরে ঢুকতেই পারে না! এমন বদ্ধতার স্তব্ধ পরিস্থিতিতে বিজ্ঞান চর্চা ও সত্য-মিথ্যার বিবেচনাপ্রসূত খোলা মন তৈরি হওয়া অসম্ভব।

৬.
সাধারণ পরিস্থিতিতে শিক্ষার এহেন নাজুক হাল চলমান বৈশ্বিক করোনা মহামারিকালে আরও বিপদাপন্ন। শিক্ষার্থীদের জ্ঞান হ্রাস পেয়েছে। জানা বিষয় ভুলে যাচ্ছে। সাইবার জগতের নানা চমক ও বিপজ্জনক গেমস তাদেরকে গ্রাস করেছে।

তদুপরি, করোনাভাইরাস মহামারিকালে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এক বেসরকারি গবেষণায় উঠে এসেছে যে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণে অংশই নিতে পারেনি। স্কুল বন্ধ থাকায় ক্লাস পরীক্ষা আর মূল্যায়নের যে বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেটি নিয়েও নানা রকম বিরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী আর অভিভাবকরাও চান ভবিষ্যতের প্রস্তুতি হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থা তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে আরও আকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক আর সবার সাধ্যের আনা হোক। কিন্তু তা নিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ খুব কমই দৃশ্যমান। চলমান মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যতে শিক্ষায় ব্যাপক সংস্কারের পক্ষে যে বহুমাত্রিক মতামত আসছে এবং সরকারের পক্ষ থেকেও জাতীয় পাঠ্যক্রম সংস্কারের উদ্যোগের যেসব কথা জানা যাচ্ছে, তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও গতি নিয়ে জানা যাচ্ছে খুব কমই।

৭.
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরেই সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেকদিন বন্ধ থাকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষায় যারা অংশ নিয়েছে, তারাও বহুরকম সমস্যায় পড়েছে। অনেকে এমনও আছে, যারা প্রযুক্তি সম্পর্কে আদৌ কিছুই জানে না কিংবা প্রযুক্তির সুযোগ নেওয়ার মতো সামর্থ্য তাদের নেই।

প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছিল ২০২০ সালের ৮ মার্চ আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল ১৭ মার্চ। তারপর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, পৃথিবীতে ১৪ টি দেশ করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এই তালিকায় আছে বাংলাদেশের নাম। পানামা, এল সালভাদর, বলিভিয়া এবং বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দিন স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে অবশ্য এ পর্যন্ত ১৭ বার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে।

৮.
বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থী আছে বাংলাদেশে। যাদের বয়স ৫ থেকে ২৫ বছর। গড় আয়ু বিবেচনায় যারা আরও ৫০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকবে, দেশটাকে গড়ে তুলবে। তাই ভালো শিক্ষার মাধ্যমে তাদের জীবনটা সুন্দরভাবে গড়ে তোলা রাষ্ট্রের ও সমাজের প্রধান কর্তব্য হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শিক্ষার আঙিনা থেকে ছিটকে পড়ে শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ। যেমন পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করত গড়ে ২৯ লাখ শিশু। জেএসসিতে অংশ নিত ২২ লাখ কিশোর, এসএসসিতে ১৮ থেকে ২০ লাখ তরুণ, এইচএসসিতে ১৪ লাখ সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে সরকারি-বেসরকারি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ সব মিলে ৬ থেকে ৭ লাখ তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষার আঙিনায় প্রবেশ করত। ২৯ লাখ থেকে ৭ লাখ, ২২ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষার আঙিনা থেকে ছিটকে পড়ত বিভিন্ন পর্যায়ে। বিভিন্ন প্রতিকূলতা পেরিয়েও যারা শিক্ষার আঙিনায় আছে বা ছিল করোনা তাদের সবার শিক্ষাজীবনকে বিরাট বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

৯.
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও শিক্ষা নিয়ে কাজ করার লোকের অভাব নেই। সরকারি, বেসরকারি, দাতা সংস্থা এসব নিয়ে আকছার কথাবার্তা বলছে। করোনার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সঙ্কট মোকাবেলা, নতুন প্রযুক্তিতে শিক্ষা দেওয়ার চ্যালেঞ্জ অতিক্রম, ড্রপ আউট কমানো, শিক্ষার গুণ ও মান বিকশিত করা, শিক্ষাব্যবস্থা-শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মানবিক পতন রোধ করা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু প্রতিদিনই সামনে চলে আসছে।

বিশেষত, বাংলাদেশের মতো সমাজে 'শিক্ষাকে মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশে' হাতিয়ার রূপে উপস্থাপিত করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা ও গণতান্ত্রিক অসংখ্য আন্দোলনের গৌরবময় অতীত ঐতিহ্যময় পীঠস্থান বাংলাদেশে এসব কাজ কবে, কখন সম্পন্ন হবে?

১০.
আজ শুক্রবার সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের মহান শিক্ষা দিবস ১৭ সেপ্টেম্বর। ১৯৬২ সালের এই দিনে পাকিস্তানি শাসন, শোষণ ও শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ নাম না-জানা অনেকেই। তাদের স্মরণে এই দিনকে শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের মাত্র ২ মাস পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। 'শরীফ কমিশন' নামে খ্যাত এসএম শরীফের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। এতে শিক্ষা বিষয়ে যেসব প্রস্তাবনা ছিল তা প্রকারান্তরে শিক্ষা সংকোচনের পক্ষে গিয়েছিল।

প্রস্তাবিত প্রতিবেদনে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে ছাত্র বেতন বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিল। ২৭ অধ্যায়ে বিভক্ত শরীফ কমিশনের ওই প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত সাধারণ, পেশামূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রসঙ্গ, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, হরফ সমস্যা, প্রশাসন, অর্থবরাদ্দ, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়।

আইয়ুব সরকার এই রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ এবং তা ১৯৬২ সাল থেকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে। শরীফ কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতি কাঠামোতে শিক্ষাকে তিন স্তরে ভাগ করা হয়- প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর। ৫ বছরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও ৩ বছরে উচ্চতর ডিগ্রি কোর্স এবং ২ বছরের স্নাতকোত্তর কোর্সের ব্যবস্থা থাকবে বলে প্রস্তাব করা হয়। উচ্চশিক্ষা ধনিকশ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এজন্য পাস নম্বর ধরা হয় শতকরা ৫০, দ্বিতীয় বিভাগ শতকরা ৬০ এবং প্রথম বিভাগ শতকরা ৭০ নম্বর।

এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার প্রস্তাব করে। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করাতে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছিল।

রিপোর্টের শেষ পর্যায়ে বর্ণমালা সংস্কারেরও প্রস্তাব থাকায় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আইয়ুবের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্ব স্ব দাবির ভিত্তিতে জুলাই-আগস্ট মাস জুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে। এ আন্দোলন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ওই দিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হন। সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয়। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে- এমন খবর শুনে মিছিল দ্রুত নবাবপুরের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু হাইকোর্টের সামনে পুলিশ এতে বাধা দেয়। তবে মিছিলকারীরা সংঘাতে না গিয়ে আবদুল গনি রোডে অগ্রসর হয়। তখন পুলিশ মিছিলের পেছন থেকে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে। এতে তিনজন নিহত হয়। ওই দিন সারাদেশে মিছিলে পুলিশ গুলি করে। টঙ্গীতে ছাত্র-শ্রমিক মিছিলে পুলিশের গুলিতে সুন্দর আলী নামে এক শ্রমিকেরও হত্যার খবর পাওয়া যায়।

সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের মহান 'শিক্ষা দিবস' স্মৃতিতর্পনের পাশাপাশি অর্জনের মূল্যায়ন ও প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির তুলনামূলক বিশ্লেষণের তাগিদ দেয়। এবং 'শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ', এই কথার প্রতিধ্বনি তুলতে প্রেরণা জাগায়।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর