’৫২, ’৬৯, ’৭১। ইতিহাসের হিরণ্ময় সময়। মানুষই তৈরি করে ইতিহাস। আবার ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণে তৈরি হয় নেতা। এ ভূমের রাজনীতির আকাশে উদিত সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম। অপরিসীম ত্যাগ ও তিতিক্ষা স্বীকার করেছেন রাজনীতির এই মহাতারকা। তারই ছায়ায় থেকে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন বহু তরুণ নেতা।
দেশকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে ছাত্র নেতাদের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। পৃথিবীতেই এ এক অসাধারণ ঘটনা। ঐতিহাসিক এসব প্রেক্ষাপটে রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন তারকা। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম রব, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখনের মতো অনেক যুব এবং ছাত্রনেতার নাম ইতিহাসে লেখা থাকবে চিরকাল।
স্বাধীন বাংলাদেশে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ছিল গৌরবজনক ভূমিকা। সে সময় বিপুল আলোচনায় ছিলেন ডাকসু ভিপি আমানউল্লাহ আমান। কিন্তু এরপর থেকেই এদেশে ছাত্র রাজনীতিতে যেন ধস নামে। রাজনীতির ময়দানে এ সময়ে খুব বড় কোনো তরুণ তারকার উত্থান হয়নি। এরশাদ আমলে ৪ বার ডাকসু নির্বাচন হয়। কিন্তু স্বৈরাচার পতনের পর ২৮ বছর আটকে ছিল ডাকসু নির্বাচন। বিশাল প্রত্যাশা নিয়ে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হলেও তা প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি।
এদেশের ছাত্র রাজনীতির সোনালী অতীত এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সাবেক, বর্তমান কয়েকজন ছাত্রনেতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা হয় মানবজমিনের। তারা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই মূলত ছাত্র রাজনীতি শুরু হয়। পাকিস্তান আমলে এ দেশের ছাত্র রাজনীতি সোচ্চার ছিল পাকিস্তানের কলোনি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। তখন ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছিল। আন্দোলন করেছিল। কিন্তু এখন সে রকম ছাত্র রাজনীতি দেখা যায় না। বিশেষ করে ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পর এদেশে ছাত্র রাজনীতি নেই বললেই চলে। এর একটাই কারণ ছাত্র রাজনীতিতে সরকার এবং রাজনৈতিক দলের প্রভাব বিস্তার। ছাত্রনেতা হতে হলে যে সকল কাজ করে নিজেকে ফুটিয়ে তোলা যায় সে ধরনের কোনো সুযোগই ছাত্ররা এখন পাচ্ছে না। যেসব ছাত্র সংগঠন রয়েছে সেগুলো প্রত্যেকটি কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠন। এ ছাড়া রাজনীতির প্রতি তরুণদের তেমন কোনো আকর্ষণ নেই। রাজনীতির প্রতি তাদের একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে।
ডাকসুর সাবেক ভিপি ও চাকসুর সাবেক জিএস মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বহু বছর ধরে এদেশে ছাত্র রাজনীতি নেই। আমাদের সময় থেকে বা এর আগে ও পরে যারাই ছাত্রনেতা হয়েছেন সবাই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে নেতা হয়েছেন। আমাদের সময়ে ছাত্র রাজনীতিতে খুব ভালোই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তার মধ্যে সহিংসতাও ছিল। আমি নিজে বেশ কয়েকবার মার খেয়েছি, আহত হয়েছি। এখনতো ভিন্নমতের ছাত্রদের হল থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে, পরীক্ষা দিতে দেয়া হচ্ছে না, ভর্তি থাকলেও তার ভর্তি বাতিল করে দেয়া হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতি আমাদের সময় কখনোই ছিল না। আমাদের সময়ের যারা রাজনীতি করতো সবার সঙ্গে দেখা হতো, কথা হতো, হাসি-তামাশা হতো। এখন তো সবাই একে অপরের চির শত্রুতে পরিণত হয়েছে।
ডাকসুর সাবেক ভিপি আমান উল্লাহ আমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে নেতা তৈরির কারখানা। আমাদের সময় ছাত্র রাজনীতিতে সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা ছিল। এখন সেটা একেবারে অনুপস্থিত। জাতীয় দুর্যোগ মুহূর্তে ছাত্ররা যখন নেতৃত্ব দেবে, আন্দোলন করবে এসব এখন দেখাই যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর সহাবস্থান একেবারেই অনুপস্থিত। সেই সময়ে ছাত্র সংগঠনের নেতারা ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতো, বিক্ষোভ করতো। এখন কিন্তু তা দেখা যায় না। এর একটাই কারণ গত ১২ বছর ধরে যে সরকার রয়েছে তারা নিজেদের প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে দলীয়করণ করে ভিন্ন মতাদর্শের ভিন্ন পক্ষের ছাত্রদের হলে অবস্থান করতে দিচ্ছে না। এতে করে ছাত্ররা রাজনীতি এবং নিজেদের দাবি-দাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ছাত্র রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে। ৯০’র দশক এবং এর আগের ছাত্রনেতা যারাই এসেছিল সবাই রাজনীতিতে পরিচিত মুখ। যখন মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, তোফায়েল আহমেদ, আসম আব্দর রবরা ডাকসুর নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের আন্তর্জাতিকভাবেও একটা পরিচিত ছিল। তখন ছাত্র রাজনীতিতে একটা গ্ল্যামার ছিল। দেশ এবং জাতির স্বার্থ নিয়ে তারা কাজ করেছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি না থাকার পেছনে আমি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করবো। দলগুলো চেয়েছিল ছাত্র সংগঠনগুলোকে তাদের লেজুড়ভিত্তিক সংগঠনে পরিণত করতে। ছাত্র সংগঠনগুলোকে তারা নিজেদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করতে। এ কারণে তারা ছাত্র সংসদ নির্বাচন চায়নি। এর আগে যারাই ক্ষমতায় ছিল এবং এখন যারা ক্ষমতায় আছে তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম আপনারা দেখেছেন, আমরাও দেখেছি। এখন থেকে যদি সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংগঠন বা ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় তাহলে হয়তো আগামীতে অনেক তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো নেতারা বেরিয়ে আসবে।
রাষ্টবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পর এদেশে ছাত্র রাজনীতি নেই। এর একটাই কারণ ছাত্র রাজনীতিতে সরকার এবং রাজনৈতিক দলের প্রভাব। এক সময় ছাত্র রাজনীতি ছিল ক্যাম্পাসভিত্তিক। কিন্তু এখন ছাত্র রাজনীতি গুরুত্ব পাচ্ছে রাজপথ কেন্দ্রিক। এর জন্য আমি রাজনৈতিক দলগুলোকেই বেশি দায়ী করবো।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ছাত্র রাজনীতি মূলত সৃষ্টি হয় ক্যাম্পাসের ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। কিন্তু বহু বছর ধরে দেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। কয়েকটা জায়গায় হলেও সেটি হাতে গোনার মতো না। এখন ক্যাম্পাস রাজনীতির কোনো লক্ষ্য নেই। ছাত্র সংগঠনের নামে সরকার দলীয় ছাত্রনেতারা ক্যাম্পাসে এক ধরনের মাস্তানতন্ত্র কায়েম করেছে। এটা কোনো ছাত্র রাজনীতি না। আমাদের সময় ছাত্র রাজনীতি দেখেছি ক্যাম্পাসের মধ্যে। ছাত্রদের অধিকার, সব সমস্যা নিয়ে সবাই সোচ্ছার ছিল। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব ছাত্র সংগঠন আছে এগুলো প্রত্যেকটি কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন। তাই এদের মাধ্যমে ক্যাম্পাস রাজনীতির প্রতিফলন হয় না। যে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতারাই ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে সবকিছুই একচেটিয়া বিষয় হয়ে যায়। ছাত্র রাজনীতিতেতো এর আগেও সীমাবদ্ধতা ছিল। আমি যখন ঢাকা কলেজে পড়ি তখন কোনো দলীয় রাজনীতি সেখানে চলতো না। বিভিন্ন কলেজগুলোতে সে সময়ে ছাত্র রাজনীতি হতো না। তারপরও অনেকেই গোপনে সচেতনভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতো। সেই জিনিস এখন তো দেখি না। ছাত্রনেতা মূলত না থাকার একটাই কারণ নব্বইয়ের পর থেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং ছাত্রদের মোবিলাইজেশনের অনুপস্থিতি।