শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরের জয়দেবপুর, ভোগড়া, লক্ষীপুরা, বোর্ডবাজার, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর ও আশপাশের এলাকায় তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় পোশাক ও টেক্সটাইল কারখানায় উৎপাদন কমেছে। শিল্প মালিক ও কর্মকর্তাদের দাবি, প্রতি বর্গফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকার কথা থাকলেও অনেক কারখানায় সেটি নেমে আসে মাত্র দুই তিনে। এই অবস্থায় সময় মতো কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন করতে না পারায় আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েছেন তারা। এছাড়া বায়ারদের চাহিদামতো শিপমেন্ট সরবরাহ করতে না পারলে বাতিল হয়ে যাবে ক্রয়াদেশ। ফলে বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য দেশের দিকে ঝুঁকে পড়বেন ক্রেতারা। এদিকে গাজীপুর মহানগরের বিভিন্ন এলাকার লাখ লাখ মানুষের বাসা বাড়িতেও রয়েছে গ্যাসের কম চাপ। কখনো কখনো রান্নার চুল্লিতে একেবারেই থাকে না গ্যাসের সরবরাহ।
এতে করে আবাসিক এলাকার লোকজন রান্না-বান্নায় ও পড়ছেন চরম ভোগান্তিতে। হঠাৎ করে গ্যাস সঙ্কট সৃষ্টির কোন কারণও খুঁজে পাচ্ছেন না শিল্পকারখানার মালিকরা।
নগরের লক্ষ্মীপুরা এলাকায় অবস্থিত স্প্যারো অ্যাপারেলস লিমিটেড নামের পোশাক কারখানার জিএম (এডমিন) মোঃ ফজলুল হক জানান, অন্তত ৬ মাস ধরে তাদের কারখানায় তীব্র গ্যাস-সংকট রয়েছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় ওই কারখানায় থাকা দুটি বয়লার চালাতে খুবই মুশকিল হচ্ছে। যেখানে তাদের কারখানার প্রতিদিন ১০ হাজার পিস প্যান্ট উৎপাদন করার টার্গেট থাকে সেখানে গ্যাস সংকটের কারণে মাত্র ৩ থেকে ৪ পিস উৎপাদন করা যায়। কিন্তু সময়মতো বায়ারদের সরবরাহ করতে শ্রমিকদের ওভারটাইম করাতে হয়। এতে করে কোন কোন দিন ওভারটাইম করিয়ে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে বাড়তি খরচ হয়ে যায় তিন থেকে চার লাখ টাকা। আবার গ্যাস সংকটের কারণে ডিজেল দিয়ে ওই বয়লার দুটি চালাতে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। এভাবেই প্রতিনিয়ত ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। তিনি আরো জানান, বারবার তারা গ্যাসের চাপ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু তাদের হাতে নেই, প্রাকৃতিক সমস্যা, এসব অজুহাত দেখানো হয়। সুরাহা আর পাওয়া যায় না। একই এলাকার মোহাম্মদী গ্রুপ এর জেনারেল ম্যানেজার কেশব চন্দ্র মজুমদার জানান, গ্যাসের চাপ কম থাকায় গত কয়েক মাস ধরে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কমপক্ষে ১৫ ভাগ ক্ষতির মুখে রয়েছেন তারা।
কোনাবাড়ি এলাকায় অবস্থিত সাত্তার টেক্সটাইলের উপ-ব্যবস্থাপক মোঃ সারোয়ারুল ইসলাম জানান, কারখানায় গ্যাসের চাপ কোনভাবেই ৫ পিএসআই এর উপর উঠে না। বেশিরভাগ সময় ২-৩ এর মাধ্যে থাকে। এতে কারখানায় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিটিএমইএ সহ-সভাপতি এবং গাজীপুরের ইশরাক টেক্সটাইল মিলস্ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ ফজলুুল হক জানান, গ্যাস সরবরাহের সংকটে অনেক কারখানা বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। সমস্যা সমাধানের জন্য তিতাস গ্যাসের এমডি বরাবর চিঠিও দেয়া হয়েছে। তবে সমস্যার কোন সমাধান হয়নি।
চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার বটম গ্যালারি নামের পোশাক কারখানার জেনারেল ম্যানেজার শুক্কুর খান জানান, তদের কারখানায় গ্যাসের চাহিদা কম রয়েছে। তারা লাইনের গ্যাসের উপর নির্ভর নয়, সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করেন। সারাদিনই সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস আনা-নেওয়ায় থেকে উৎপাদন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখেন।
এদিকে গ্যাস সংকটের মুখে গ্যাস লাইনে কাজ করায় বৃহস্পতিবার রাজেন্দ্রপুর, ভবানীপুর, বানিয়ারচালা এলাকায় কারখানা বন্ধ রাখা হয়। এলাকার অনেক কারখানার গ্যাস লাইনে গত কয়েক মাস ধরেই দিনের অনেক সময়ই থাকে লাল সংকেত। চাহিদা মতো সরবরাহ থাকে না। তাই একদিকে যেমন উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, অন্যদিকে লোকসানের মুখে পড়তে হয় কারখানা মালিকদের। এই অবস্থায় শ্রমিকদের মাঝে দেখা যায় চিন্তার ভাঁজ। কেননা লোকসান টানতে টানতে একসময় কোন কোন মালিককে হয়তো তাদের ব্যবসার ইতি টানতে হবে। সে চিন্তায় কর্মহীন হয়ে পড়ার শঙ্কায় রয়েছেন অনেক শ্রমিক। শ্রমিকদের মধ্যে যারা উৎপাদন চুক্তি অর্থাৎ প্রোডাকশন রেইটে কাজ করেন তারা স্বাভাবিকের চেয়ে পারিশ্রমিক কম পাচ্ছেন। গাজীপুরের আনাচে-কানাচে হাজার হাজার অবৈধ সংযোগকে গ্যাসলাইনে চাপ কম থাকার জন্য দোষারোপ করছেন অনেকে।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র সদস্য মো. সালাউদ্দিন চৌধুরী পোশাক কারখানাগুলো উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে এসব অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং প্রয়োজনীয় গ্যাস আমদানি করে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এখন প্রচুর এলএমজি গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে। চেষ্টা করতে হবে আমদানি করা এলএমজি গ্যাস প্রধান শিল্পখাতে ব্যবহার করতে, যাতে উৎপান সচল থাকে।
কোনাবাড়ীর বাইমাইল এলাকার নিটটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের জেনারেল ম্যানেজার মো. রেজা জানান, গ্যাসের চাপ কমে গেলে, কিছু মেশিন বন্ধ রাখতে হয়। আর বিদ্যুৎ দিয়ে মেশিন চালানো হলে উৎপাদন ব্যাহত হয়।
নগরের কোনাবাড়ীর জরুন এলাকার কেয়া স্পিনিংয়ের জিএম মিজানুর রহমান জানান, মাঝে মাঝেই গ্যাসের চাপ কমে যায়। তখন জেনারেটর ব্যবহার করে মেশিন চালানো উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী গাজীপুর জোনের ডিজিএম মোঃ শাহাজাদা ফরাজী এ বিষয়ে বলেন, গাজীপুরে চাহিদার তুলনায় কম সরবরাহ থাকার কারনেই গ্যাসের চাপ কম। গ্রাহকের অসুবিধার জন্য তিতাস গ্যাস আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সংকট সমাধানের চেষ্টা চলছে।