× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

সিসি ক্যামেরার ফুটেজে রপ্তানির পোশাক চোর সিন্ডিকেট শনাক্ত

শেষের পাতা

শুভ্র দেব
২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, সোমবার

রপ্তানির পোশাক চোর সিন্ডিকেটের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। হাইওয়ের বিভিন্ন স্থানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে চোর চক্রকে শনাক্ত করে ডিবি। পরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করেছে ডিবির তেজগাঁও ডিভিশন। উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ রপ্তানি পোশাক। ডিবি জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে এই সিন্ডিকেট চক্রটি বিভিন্ন কৌশলে রপ্তানির পোশাক চুরি করে আসছিল। ঢাকা থেকে কাভার্ডভ্যানে পোশাক ভর্তি করে চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথে চক্রটি চুরি করতো। এতে করে বিদেশি ক্রেতারা হিসাবের চেয়ে কম পোশাক পেতো। ক্ষুব্ধ ক্রেতারা এ নিয়ে বছরের পর বছর ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিল।
সম্প্রতি এ ধরনের একাধিক ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে ক্রেতাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুকারক ও রপ্তানিকারক সমিতিকে (বিজিএমইএ) চিঠি দিয়েছে অনেক ক্রেতা।

গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, মালামাল পরিবহনে যুক্ত শ্রমিকরা এই চক্রের মূল হোতা। তারা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকার গার্মেন্ট থেকে কাভার্ডভ্যানে মালামাল চট্টগ্রামের বন্দরে নেয়ার পথে চুরি করে। সম্প্রতি রাজধানীর দুুটি প্রতিষ্ঠান থেকে আনুমানিক ৫০ হাজার পিস পোশাক চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়। শিপমেন্টটি জার্মানিতে পৌঁছানোর পর ক্রয়াদেশে দেয়া পোশাকের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল ছিল না। এরপরই ক্রেতারা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ও রপ্তানিকারক সমিতিকে বিষয়টি জানায়। পাশাপাশি তারা কয়েকটি ক্রয় আদেশও বাতিল করে। পরে অভিযুক্ত ওই দুই গার্মেন্টের মালিকদের ডেকে পাঠানো হয়। তারা বিজিএমইএকে চুক্তি অনুযায়ী সঠিক মালামাল দেয়া হয়েছে বলে তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরেন। ইন ভয়েজ ও চালানের কপিতে সঠিক মাল দেয়ার তথ্য ওঠে আসে। পরিবহনে যুক্ত কাভার্ডভানের লোকজনও মাল বুঝে নিয়েছে বলে চালানের কপিতে সই করার তথ্য-প্রমাণও পাওয়া যায়। এমনকি বন্দর কর্তৃপক্ষও মালামাল বুঝে পেয়েছে বলে ওঠে আসে। বিষয়টি নিয়ে গোলক ধাঁধায় পড়েন বিজিএমইএর কর্তাব্যক্তিরা। এরপর বিষয়টি জানানো হয় গোয়েন্দাদের।

গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনাল টিম সূত্র জানিয়েছে, বিজিএমইএ এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকা চট্টগ্রাম রুটের বিভিন্ন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। পরে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা যায় হাইওয়ের রোডের পাশে সিএনজি গ্যাস স্টেশন সংলগ্ন অনেকগুলো গোডাউন রয়েছে। ঢাকা থেকে মালামাল পরিবহনের সময় এসব সিএনজি স্টেশনগুলোতে কাভার্ডভ্যান চালক যাত্রা বিরতি দেয়। তখন কাভার্ডভ্যানের গেট খুলে ভেতরে থাকা কার্টন থেকে সুকৌশলে পোশাক সরায়। এমনভাবে সরানো হয় যাতে কেউ সেটি ধরতে না পারে। পরে কাভার্ডভ্যান নেয়া হয় বন্দরে। বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে কার্টন বুঝিয়ে দিয়ে তারা চলে আসে। বন্দর থেকে ওই মাল ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর পর সেখানে অর্ডারকৃত মালের থেকে কম পাওয়া যায়। কাভার্ডভ্যান থেকে পোশাক সরানোর পর সেগুলো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পাইকারি মার্কেটে বিক্রি করা হয়। পাইকারি মার্কেট থেকে কিনে নেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

পোশাক প্রস্তুতকারক সংশ্লিষ্টরা জানান, একেকটি কাভার্ডভ্যানে ৪০০-৪৫০টি করে কার্টন থাকে। কিন্তু এই চক্রটি যাত্রাপথে বিশেষ পদ্ধতিতে কার্টনগুলো খুলে প্রতিটি কার্টন থেকে ৭-৮ পিস করে পণ্য রেখে দেয়। পরে কার্টনগুলো তারা এমনভাবে আবার আটকিয়ে দেয় যাতে কোনোভাবেই বোঝা না যায় যে কার্টন খোলা হয়েছিল। সেজন্য বায়ারদের লোকজন বুঝতে পারে না। তারা দেখে যে কার্টন ঠিক আছে। কার্টনের নাম্বারও ঠিক আছে। তারা কার্টন দেখেই আমাদের বিল বুঝিয়ে দেয়। পণ্যগুলো রপ্তানির আগ পর্যন্ত কেউ এটা বুঝতে পারে না। কিন্তু বায়াররা যখন পণ্যগুলো স্টোরে নেয় তখন আমাদের কাছে অভিযোগ আসে। তারা বলে যে কার্টনে পোশাক কম আসছে।

আগস্ট মাসে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানা এলাকা থেকে ৬ চোরকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৪)। আটকরা হলোÑ বরিশালের সিরাজুল ইসলাম, ভোলার মো. জহির, জয়পুরহাটের মো. জনি, রাজবাড়ীর মো. জমির খান, শরীয়তপুরের মো. নুর জামান, নারায়ণগঞ্জের মো. তাবারক হোসেন। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা মূল্যের চোরাই ৪১ বস্তা ও ৫০৬ কার্টন ভর্তি রপ্তানি পোশাক সামগ্রী, নগদ ৮২ হাজার টাকা, মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত ২টি কাভার্ডভ্যান, ১টি প্রাইভেটকার এবং ১০টি মোবাইল জব্দ করে র‌্যাব। র‌্যাবের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, ঢাকা ও গাজীপুর থেকে গার্মেন্ট মালামাল বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে নেয়ার পথে কিছুু কাভার্ডভ্যান থেকে প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ দামি পোশাক উধাও হয়ে যাচ্ছে। এমন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-৪ ছায়া তদন্ত করে বিষয়টির সত্যতা পায়।
গত ১৪ই এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ বন্দরে কোটি টাকা মূল্যের গার্মেন্ট তৈরি রপ্তানিকৃত চোরাই পণ্যের ৩৪১টি কার্টন উদ্ধার করে পুলিশ। নগরীর ২০নং ওয়ার্ড বন্দরের দড়িসোনাকান্দা এলাকার সিরাজুল ইসলামের বাড়ি থেকে ওই চোরাই মালামাল উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় হাসিব-রাজিব নামে দুই ভাইকে। বন্দর থানার এসআই মোফাচ্ছের জানান, কার্টনে ভর্তি গার্মেন্ট পণ্য অন্যত্র নিয়ে যেতে কাভার্ডভ্যানে লোড করার খবর পেয়ে এলাকাবাসীর সহায়তায় পুলিশ ৩৪১ কার্টন ভর্তি রপ্তানিকৃত চোরাই পোশাক উদ্ধার করে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, পণ্য পরিবহনে যুক্ত চালক ও সহকারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে একটি চক্র রপ্তানির সময় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে দীর্ঘদিন ধরেই পোশাক চুরি করে আসছিল। যাত্রাপথে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির নিজস্ব গোডাউনে নিয়ে কার্টন খুলে সেখান থেকে ৩ ভাগের ১ ভাগ পণ্য সরিয়ে ফেলা হয়। এ ধরনের কাজে চালককে দেয়া হয় ২০ হাজার আর সহযোগীকে ১০ হাজার টাকা।

এ ঘটনার পর গত পহেলা আগস্ট নোমান গ্রুপের চুরি যাওয়া ৯০টি কাপড়ের রোল ও কাভার্ডভ্যান উদ্ধারসহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন ডিবির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা-উত্তর) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, গার্মেন্টের পণ্য চুরি যাওয়ার ঘটনায় সম্প্রতি একটি কমিটি হয়। সেখানে ডিবি পুলিশও রয়েছে। এরপর এসব ঘটনা তদন্তের ধারাবাহিকতায় এই চোর চক্রকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। নোমান গ্রুপের কাপড় চুরি যাওয়ার ঘটনার দু’দিনের মধ্যেই গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে উত্তরার আব্দুল্লাহপুর ধৌর ব্রিজ এলাকা থেকে কাভার্ডভ্যানসহ চালক আসাদুজ্জামান মোল্লা আসাদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেয়া তথ্যে গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকা থেকে আল আমিনের গোডাউন থেকে চুরি যাওয়া তোষক ও কাপড়ের ব্যাগ তৈরির কাজে ব্যবহৃত ৮ হাজার ৪৬০ মিটার কাপড় উদ্ধার ও চক্রের অপর দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

হারুন অর রশীদ বলেন, আসাদ কাভার্ডভ্যান চালক হিসেবে বিভিন্ন গার্মেন্টে চাকরি নেন। গার্মেন্টের মালামাল পরিবহনের সময় সুবিধামতো সময় কাভার্ডভ্যানসহ চুরি করে নিখোঁজ হয়ে যান। পরে আবার অন্য গার্মেন্টে চাকরি নিয়ে নতুন করে চুরির পরিকল্পনা করেন। আসাদ চুরি করে কাভার্ডভ্যানসহ কাপড়গুলো আল আমিনের গোডাউনে রাখতো। এরপর আবেদের মাধ্যমে চোরাই বাজারে সেসব কাপড় বিক্রি করা হতো। কাপড়গুলো গ্রেপ্তার আবেদের মাধ্যমে গাজীপুরের এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রির পরিকল্পনা ছিল।

রপ্তানির পোশাক চুরির বিষয়টি কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর প্রধানদের অভিযোগ আকারে জানায় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠনÑ বিজিএমইএ। সচিবালয়ে গার্মেন্ট মালিকরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে মতবিনিময়কালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যেভাবেই হোক, রপ্তানি পণ্যের চুরি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতেই হবে। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স বলে জানান তিনি। ওই বৈঠকে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বন্দরে পোশাক পণ্য চুরির ঘটনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দীর্ঘদিন ধরে পোশাক খাতের রপ্তানি ও আমদানির মালামাল চুরির ঘটনা ঘটছে। মহাসড়কে একটি সংঘবদ্ধ চক্র চালকদের সঙ্গে মিলে রাস্তায় কাভার্ডভ্যান দাঁড় করিয়ে মালামাল চুরি করছে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় কার্টনের ওজন ঠিক রাখার জন্য তারা কার্টনে ঝুট, মাটি ইত্যাদিও ভরে দিচ্ছে। এগুলো এভাবে আমেরিকা ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের কাছে গেলে তারা অভিযোগ জানাচ্ছেন। এতে একদিকে সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে, অন্যদিকে বিদেশে দেশের সুনামও নষ্ট হচ্ছে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর