বাংলারজমিন

গাছপ্রেমিক বুলবুলির জীবন সংগ্রাম

এবিএম আতিকুর রহমান, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) থেকে

২০২১-০৯-২২

টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের সোনা আটা গ্রামের বুলবুলি। অভাব-অনটনের সংসারে মেয়েকে লেখাপড়া করাতে পারেননি পিতা দিনমজুর জোয়াদ আলী। তাই অল্প বয়সেই যৌতুকের শর্তে বিয়ে দেন বুলবুলিকে। তার সংসারে আসে দুই সন্তান। কিন্তু সময়মতো যৌতুকের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় চার বছরের মাথায় ঘর ভাঙে তার। ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে পড়েন অথৈ জলে। ঠাঁই হয় পিতা-মাতার খুপরি ঘরে। অবুঝ সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করেননি তিনি। সখ্য গড়ে তোলেন গাছের সঙ্গে। গাছই হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান। গাছের মায়ায় কেটে গেছে তার জীবনের ২২ বছর। তবে এ জীবন তার সুখকর নয়, সংগ্রামের, কষ্টের।
জানা যায়, ২০০০ সালে ফরেস্ট্রি সেক্টর প্রকল্পের টাকায় গোপালপুর-নলিন ১৮ কিলোমিটার সড়ক যৌথভাবে বনায়ন করে এলজিইডি ও এসডিআইপিকে। আকাশমণি, শিশু, ইউক্যালিপটাস ও অর্জুন চারার বনায়ন দেখভালের জন্য যে ১৮ জন বিত্তহীন নারীকে বাছাই করা হয়, বুলবুলি তাদেরই একজন। চুক্তি ছিল- টানা তিন বছর প্রত্যেকে মাসে তিন মণ গম ও নগদ ৫০০ টাকা ভাতা পাবেন। গাছ বড় হলে কাটার পর ৫ শতাংশ হিস্যা পাবেন।
সড়কের সোনাআটা পশ্চিম অংশের দায়িত্ব পাওয়া জুলেখা জানান, ছয় মাস গম ও ভাতা দেয়ার পর ২০০২ সালে ভেগে যায় বেসরকারি সংস্থা এসডিআইপিকে। উপজেলা এলজিইডি তখন আশ্বস্ত করে, পাওনার ব্যবস্থা হবে। সেই আশায় টানা ১২ বছর গাছ পাহারা দেন বিত্তহীন নারীরা। গাছ ডালপালা ছড়িয়ে বেড়ে উঠলে ভয়ভীতি দেখিয়ে কাটা শুরু করে দুর্বৃত্তরা। জনপ্রতিনিধি ও এলজিইডিকে অবহিত করে প্রতিকার না পেয়ে বুলবুলি ছাড়া সব নারীই গাছ পাহারা বন্ধ করে দেন। সোনাআটার নজরুল ইসলাম জানান, দুর্বৃত্তদের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে বুলবুলি রাতের বেলা দা নিয়ে পাহারা শুরু করেন। গাছের প্রতি মায়া দেখে গ্রামের অনেকেই তাকে সহযোগিতা করেন। ফলে নবগ্রাম মোড় থেকে পূর্ব সোনাআটা সড়কে কিছু গাছ টিকে যায়।
বুলবুলি জানান, বিয়ের সময় দিনমজুর বাবা সড়ক বনায়নের সুফল দেখিয়ে তাকে বিয়ে দেন। কথা ছিল, গাছ পাহারার গম ও ভাতার পুরোটাই যৌতুক হিসেবে পাবেন স্বামী। কিন্তু সংশ্লিষ্ট এনজিও বকেয়া না দিয়ে লাপাত্তা হলে তার কপাল পোড়ে। ভাঙে সংসার। সন্তানদের কাউকে পড়াশোনা করাতে পারেননি। বুলবুলি পাড়ায় ঝিয়ের কাজের ফাঁকে সড়কের গাছ এখনো দিনরাত দেখভাল করেন। নিজের সন্তানের ন্যায় গাছগুলো যত্ন করে আজও আগলে রেখেছেন বুলবুলি। বুলবুলি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন- গাছগুলোর কারণে আমার স্বামী-সংসার হারিয়েছি। আমার সকল সাদ আহ্লাদ, হাসি, স্বপ্ন জড়িয়ে আছে গাছের সঙ্গে। যৌবন বয়সে স্বামী হারালেও নিজের ২টি সন্তান ও গাছগুলোর কারণে আমি আর দ্বিতীয় বিয়েতে বসিনি। অথচ গাছগুলোর দিকে শকুনের চোখ পড়েছে। আমি বেঁচে থাকতে সেটা হতে দেবো না।
সরজমিন দেখা গেছে, এসব গাছের বেশির ভাগই অর্জুন। সড়কের উত্তরে বিশাল মাঠ। খরতাপ বা রোদ-বৃষ্টিতে কৃষকেরা এই অর্জুনের ছায়ায় বিশ্রাম নেন। সড়কের দক্ষিণের বড় বিলে হাজারো পাখির আনাগোনা। আশপাশে বড় গাছপালা না থাকায় পাখপাখালি অর্জুন গাছে বাসা বাঁধে। বাচ্চা ফোটায়। ভেষজ বৃক্ষ অর্জুনের ছাল-বাকল, কচিপাতা ও গুঁটি বনৌষধির দামি কাঁচামাল। মাদার ট্রি হিসেবে অর্জুন গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করেন অনেকে। এসব গাছ শুধু অক্সিজেনই দেয় না, ঝড়ঝাঁপটা থেকেও সুরক্ষা দেয়। বকেয়া পাওনা মেলেনি বলে আফসোস নেই বুলবুলির। গাছের ছায়া ও মায়াকে তিনি হৃদয়ে ধারণ করেছেন। গাছ যে তার কাছে সন্তানের মতোই আপন।
প্রধান শিক্ষিকা আঞ্জুয়ারা ময়না জানান, সরকার টাকা খরচ করে সড়ক বনায়ন করে শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্যই নয়, বিত্তহীন নারীদের এখানে অংশীদার করা হয় দারিদ্র্যবিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য। নিজের সন্তানের মতোই আগলে রেখে অতিকষ্টে যারা ছোট্ট চারাকে বিশাল গাছে পরিণত করেন, সেই বুলবুলিরা বনায়নের সুফল পান না। এটা ঠিক নয়।
সাবেক ইউপি সদস্য আজাহার আলী জানান, দায়িত্বপ্রাপ্ত এনজিও ভাতার টাকা ও গম মেরে দিয়েছে। এলজিইডি গাছ রক্ষা এমনকি বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। সবখানে গরিবরাই ঠকে। এ প্রসঙ্গে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বলেন, খোঁজ নিয়ে দেখবেন। স্থানীয় ফরেস্ট রেঞ্জার মঞ্জুরুল ইসলাম জানান, স্ট্রিট প্ল্যান্টেশনের হিস্যা বণ্টন এবং সার্বিক মনিটরিংয়ের দায়িত্ব এলজিইডির। উপজেলা নির্বাহী অফিসার পারভেজ মল্লিক বলেন, এটা অনেক পুরনো বিষয়। তবে এখন কোথাও সড়কের গাছ চুরি হলে উপজেলা প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নেবে। তবে বুলবুলির ব্যাপারে কারও কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status