× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

জনতার পুলিশ আর পুলিশের জনতা!

মত-মতান্তর

যুক্তরাজ্য থেকে ডাঃ আলী জাহান 
২৭ অক্টোবর ২০২১, বুধবার

 
১. বাংলাদেশে ২৫.১০.২১ তারিখে সব পত্রিকাতেই (অনলাইন এডিশন)  ছবিটি এসেছে। ঝকঝকে,তকতকে, চমৎকার ছবি। ছবিতে পুলিশের ইউনিফর্ম পরে এক কর্মকর্তা বসে আছেন। ছবির ডানদিকে আরেক ইউনিফর্ম পরা অফিসার বসে আছেন। সামনে অনেকগুলো ক্যামেরা। ক্যামেরার ডানে-বাঁয়ে কিছু সাংবাদিক। সবার চেহারার ভেতর একটি রোশনাই ভাব আছে। ছবির পেছনে একটি ব্যানার টাঙানো আছে।
সেই ব্যানারে লেখা আছে 'মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার।'

২. একই দিন বিকেলে কয়েকটি পত্রিকার অনলাইন এডিশনে আরেকটি খবর প্রচারিত হয়েছে। সে খবরে  বাংলাদেশের এক জেলা শহরে ৪ 'রাজনৈতিক নেতাকে গোপন মিটিং' থেকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতার করে সেই চারজন বনি আদমকে একসঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে, হ্যান্ডকাফ পরিয়ে পুলিশ প্রশাসন ছবি তুলে মিডিয়াকে সরবরাহ করেছেন। সেই চারজন রাজনৈতিক নেতার সাথে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ছবি তুলতে দেখা যায়নি। ধারণা করতে পারি যে, যে চারজন বাংলাদেশের নাগরিককে গ্রেফতার করে মিডিয়ার সামনে আনা হয়েছে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি কম তাই হয়তো পুলিশ কর্মকর্তারা এই চুনোপুঁটিদের সাথে ছবি তুলতে রাজি হননি! আবার অন্য ব্যাখ্যাও থাকতে পারে।


৩. প্রথম ঘটনায়  'জনতার পুলিশ' অফিসাররা যে সাংবাদিক সম্মেলন করছেন সেখানে ব্যানারের সামনে, পুলিশ এবং সাংবাদিকদের পেছনে কিছু উদ্বিগ্ন মুখ আছে। তরুণ থেকে মধ্যবয়সী, ক্লিন শেভ থেকে দাড়িওয়ালা, ছেলের বয়স থেকে শুরু করে বাবার বয়সী কিছু মানুষকে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করানো হয়েছে। সম্প্রতি নোয়াখালীতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামার মামলায় এই আসামীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা দোষী হতে পারেন। নাও হতে পারেন। আইনের ভাষায় দোষ প্রমাণিত হবার আগে সবাই নির্দোষ! পুলিশ এ কথা নিশ্চই বিশ্বাস করেন!!


৪. সন্দেহজনক বা তালিকাভুক্ত যে কোনো আসামীকে পুলিশ ওয়ারেন্ট দেখিয়ে গ্রেফতার করতেই পারে। আদালতের নির্দেশনা আছে যে, ওয়ারেন্ট ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। জনতার পুলিশ নিশ্চয়ই তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন!


৫. যাদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট হতে পারে, নাও হতে পারে। চার্জশিট হলে আদালতে শুনানি হবে। শুনানির পর এই আসামীরা মুক্তি পেতে পারেন অথবা জেল-জরিমানায় দণ্ডিত হতে পারেন। কিন্তু চার্জশিট হওয়ার আগে, আদালতে দণ্ডিত হবার আগে  আসামিদের সাথে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করা কি বাংলাদেশের আইন সমর্থন করে? কে এই ফতোয়া দিলেন? এই ফতোয়ার মুফতি কে?


৬.  আসামী গ্রেফতার করা তো পুলিশের খুব স্বাভাবিক একটি দায়িত্ব। যেমনটা অন্য পেশার লোকজন পালন করছেন। কিছু উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে পারে।


৭. যারা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি ডিগ্রী এমবিবিএস পাস করেছেন তাদের ন্যূনতম কিছু যোগ্যতা থাকতে হয়, না হলে ডাক্তারি রেজিস্ট্রেশন থাকবে না। যেমন ধরুন রোগীর ব্লাড প্রেসার বা টেম্পারেচার নেয়া, সাধারণ সর্দি কাশি হলে প্যারাসিটামল দেয়া, ঘুমের অসুবিধা হলে ঘুমের ঔষধ দেয়া, প্রয়োজন হলে কিছু টেস্ট করা। এমবিবিএস পাস করা ডাক্তাররা যখন রোগীদের সার্ভিস দেন তখন কি তারা সংবাদ সম্মেলন করে দেশের জনগণকে জানান? এসব স্বাভাবিক কাজ করতে না পারলে ডাক্তারদের লাইসেন্স থাকবে না।


৮. প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা যখন ছাত্র-ছাত্রীদের অ আ ক খ ক্লাসে শিক্ষা দেন তখন কি তারা সংবাদ সম্মেলন করে সেলফি তুলে অভিভাবকদের বা দেশের মানুষকে জানান? এটি কি জানানোর মতো কোনো বিষয়?


৯. ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে নিউমার্কেট যাবেন। রিকশা চড়ে বসলেন। ড্রাইভার সাহেব আপনাকে ২০ মিনিট পর নিউমার্কেটে নামিয়ে দিলেন। উনি যদি আপনাকে নিয়ে তার রিকশার ছবি তুলে সেলফি করেন বা সংবাদ সম্মেলন করেন তখন কেমন লাগবে আপনার?


১০. ডাক্তার সাহেবের  অথবা শিক্ষকের ব্যাপারটি অথবা রিকশা ড্রাইভারের ঘটনা একটু এনালাইসিস করা যাক। উনারা দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন করছেন।সে রুটিন কাজ নেই সংবাদ সম্মেলন করলে, সেলফি দিলে লোকজন হাসাহাসি করবে। ক্ষেত্রবিশেষে চাকরি চলে যাবে। সবাই বলবে আপনারা যা করেছেন তা তো আপনাদের স্বাভাবিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য। এই নিয়ে ঢোল পেটানোর কী আছে? 


১১. অবশ্য মাঝেমধ্যে অন্য পেশার লোকজনের খবর পত্রিকায় আসতেই পারে। একজন ডাক্তার যখন খুবই জটিল চিকিৎসা বা ডায়াগনোসিস করবেন সে খবর পত্রিকায় আসবে। কোন কোন রিকশাচালক তার রিকশায় ফেলে যাওয়া লক্ষ টাকার গয়না মালিকের হাতে ফিরিয়ে দিলে সে খবর আসতেই পারে। এই খবর গুলো হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক কাজকর্মের ব্যতিক্রম।


১২. বাংলাদেশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতেই পারেন। উন্নত বিশ্বে তাই হয়।জনগণের মনে ভয়ভীতি থাকলে সেই ভয়-ভীতি কমানোর জন্য সংবাদ সম্মেলন করে আপডেট দিতেই পারেন, তাদের সহায়তা চাইতে পারেন। তবে সেই সংবাদ সম্মেলনে আটককৃত সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে/ আসামীকে হাজির করা হবে কেন? শুধুমাত্র অভিযোগের/সন্দেহের বশবর্তী হয়ে যাদেরকে গ্রেফতার করছেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে শেষমেষ চার্জশিট দেয়া সম্ভব হবে না। চার্জশিট দিলেও আদালতে শুনানি শেষে অনেকেই বেকসুর খালাস পাবেন। যাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে পারলেন না অথবা আদালত তাদেরকে নির্দোষ বলে খালাস করে দিলেন তাদেরকে সংবাদ সম্মেলনে হাজির করে তাদের ব্যক্তি এবং পারিবারিক জীবনে যে মহা ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালিত করলেন তার দায়ভার নেবে কে?


১৩.বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা দেয়া আছে যে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মিডিয়ার সামনে আনা যাবে না। উনাদের সেই নির্দেশনা যে পদে-পদে মানা হচ্ছে না তা নিশ্চয়ই আদালতের চোখে পড়ার কথা। চোখে পড়ছে তো?


১৪. নোয়াখালীর সেই সংবাদ সম্মেলনে ফিরে যাই। যাদেরকে শুধুমাত্র সন্দেহ বা অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের শেষ পরিণতি কী হবে? যদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো চার্জশিট দেয়া সম্ভব না হয় এবং আদালতে তাদের দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব না হয় তাহলে তাদের জীবনকে ওলট-পালট করে দেয়ার ক্ষতিপূরণ দেবে কে?  


১৫. সিনেমার নায়ক- নায়িকারা যেমন বাংলাদেশের নাগরিক, শিল্পপতি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাকর্মী, অফিসার থেকে শুরু করে অফিসের সামান্য বেতনের কেরানি, বিএমডব্লিউ কারের  মালিক থেকে শুরু করে সিএনজি রিকশা মালিক, সুপার স্টোরের মালিক থেকে মুদি দোকানের মালিক- সবাইতো আইনের চোখে সমান। শোবিজের কাউকে নিয়ে পুলিশের সংবাদ সম্মেলন করা যদি বেআইনি কাজ হয় তাহলে বাকিদের ক্ষেত্রে একই আইন প্রযোজ্য হবে না কেন? 


১৬. বাংলা সিনেমার নায়িকা পরীমনি, বোট হাউস ক্লাবের নাসির উদ্দিন মাহমুদ, ইসলামী বক্তা কাজী ইব্রাহিম ও মুফতি আমির হামজা, বিরোধীদলের নেতা কর্মী, সম্প্রতি আটক বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষক রুমা সরকার- সবাইতো আইনের চোখে সমান। চার্জশিট দেয়ার আগে, আদালতে অপরাধ প্রমাণের আগে মিডিয়ার সামনে হাজির করে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন যে তছনছ করে দিচ্ছেন তা কি বুঝতে পারছেন না?


১৭. এখানে (যুক্তরাজ্য) অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়ার আগে পুলিশ কোনো অবস্থাতেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম-পরিচয় প্রকাশ করবে না। গ্রেফতারকৃত আসামীকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করা তো কল্পনারও অতীত। শুধুমাত্র গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে চার্জ গঠিত হবার পর পুলিশ তার অফিসিয়াল একটি বা দুটি ছবি প্রকাশ করবে। এর বাইরে কিছু করবে না। করার কথা আইনে নেই। 


১৮. শুধু স্লোগান দিলেই তো আর পুলিশ জনতার হবে না। জনতার পুলিশ কাকে বলে তা বুঝতে হলে একটু পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকান। জনতাকে মানুষ ভাবুন| অপরাধ প্রমাণের আগে  মানুষকে এভাবে নাজেহাল ও অসম্মান করে জনতার পুলিশ হবেন কীভাবে? এভাবে চললে তো 'জনতার পুলিশ'  হয়ে যাবে 'পুলিশের জনতা'।


ডা: আলী জাহান

কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট এবং সাবেক পুলিশ সার্জন (যুক্তরাজ্য পুলিশ) 

[email protected]

অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর