অতি সম্প্রতি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ করোনা ভাইরাসের কিছু উদ্বেগজনক বৈশিষ্ট্যসহ একটি নতুন রূপ শনাক্ত করেছে। এটি প্রথম বতসোয়ানায় উদ্ভূত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় এই নতুন স্ট্রেইনটি সংক্রমণ তীব্রভাবে বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে। শুক্রবার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন রূপের করোনাভাইরাসটিকে “উদ্বেগজনক” বলে উল্লেখ করেছে। কারণ ইতিমধ্যে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, এই ভাইরাসের পূর্ববর্তী সংস্করণগুলোর তুলনায় এটি আরও বেশি সংক্রমণযোগ্য এবং আরও বেশি মারাত্মক।
বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন “ওমিক্রন” নামে পরিচিত করোনার ভিন্ন রূপটি নিয়ে। কারণ এতে অস্বাভাবিকসংখ্যক মিউটেশন দেখা যাচ্ছে। ডেল্টার মতো অন্যান্য উচ্চ সংক্রমণযোগ্য রূপগুলোতে যেমন পাওয়া গেছে, তার চেয়েও বেশি। অনেকগুলো আবার স্পাইক প্রোটিনে উপস্থিত হয়, ভাইরাসের যে অংশটি মানুষের কোষের সাথে আবদ্ধ হয় এবং তাকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে সক্ষম করে সেখানটায়।
ভয়ের কারণ এই যে, এই পরিবর্তনগুলো ওমিক্রনকে আরও সহজে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সম পর্যায়ে পৌঁছে যেতে সাহায্য করতে পারে এবং ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে।
স্ক্রিপস রিসার্চ ট্রান্সলেশনাল ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর এরিক টোপোল সম্প্রতি (ওয়াশিংটন পোস্টকে) বলেছেন, "আমরা দেখতে পেয়েছি, ডেল্টার পর থেকে এটিই করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক রূপ।"
করোনার নতুন ধরণটির সংক্রমণের ঘোষণার ফলে বিশ্বজুড়ে আর্থিক বাজার বিপর্যস্থ হয়ে পড়ে এবং সব দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভ্রমণ সীমিত করতে উৎসাহিত হয়। বিবর্তিত এই জীবাণুটি কতোটা বিপজ্জনক হতে পারে তা নির্ধারণ করার জন্য একটি উন্মত্ত বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। এমন একটি ভীতিকর খবর এই সময়ে প্রত্যাশিত যখন ডেল্টা ইতিমধ্যে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে পুনরুত্থিত হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির ভারসাম্য বজায় রাখাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বিজ্ঞানীরা এখনও এই ভাইরাসটির মিউটেশন প্রোফাইলের বাইরে নতুন বিবর্তিত রূপটি সম্পর্কে খুব কমই জানেন। এখন পর্যন্ত কয়েকটি দেশে মাত্র কয়েক ডজন এতে আক্রান্ত নিশ্চিত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিভাগের পূর্ববর্তী নির্দেশনাগুলো এখনো পরিবর্তিত হয়নি। যেমনঃ সময়মতো টিকা ও বুস্টার ডোজ নেওয়া, লক্ষণগুলো শরীরে দেখা দিলে পরীক্ষা করানো এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে মাস্ক পরে থাকা।
যেহেতু জো বাইডেন প্রশাসন “ওমিক্রন” এর হুমকি সম্পর্কে ধারণা করার চেষ্টা করছে, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ওই অঞ্চলের অন্যান্য সাতটি দেশ থেকে ভ্রমণ সীমাবদ্ধ রাখবে। নভেম্বর ২৬, ২০২১ তারিখে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হিসেবে ৮টি আফ্রিকান দেশ থেকে ভ্রমণ সীমাবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে (ওয়াশিংটন পোস্ট)।
বাইডেন প্রশাসনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা এটি ঘোষণা করেছেন, এই নতুন ভ্রমণ নীতিটি দক্ষিণ আফ্রিকায় ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়া নতুন ভ্যারিয়েন্টের করোনাভাইরাস যাতে অন্যান্য দেশগুলোতে ছড়াতে না পারে তা প্রতিরোধের চেষ্টায় প্রয়োগ করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বৃটেন, জাপান এবং ইসরায়েলসহ অন্যান্য অঞ্চল এবং দেশগুলোও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আগত বিমান ভ্রমণকারীদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কঠোর বিধিনিষেধ নির্ধারণ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাগুলো দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, লেসোথো, এসওয়াতিনি, মোজাম্বিক এবং মালাউই থেকে আসা ভ্রমণকারীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। এই নীতি আমেরিকান নাগরিক এবং বৈধ স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য প্রযাজ্য নয়, কর্মকর্তা এটাও বলেছেন।
এই নতুন ভ্রমণ নীতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সম্প্রতি হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ আফ্রিকার চিকিৎসকদের মধ্যে একটি বৈঠকের পর। বৈঠকে দক্ষিণ আফ্রিকান ডাক্তাররা নতুন বিবর্তিত ভাইরাসটির বিস্তার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানান। বৈঠকের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রধান চিকিৎসা বিষয়ক উপদেষ্টা অ্যান্থনি এস ফসি সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, "ঠিক কী ঘটছে তা আমরা সরাসরি এক বিজ্ঞানী থেকে আরেক বিজ্ঞানী খুঁজে বের করতে চাই।”
ব্ল্যাক ফ্রাইডে’র জন্য ক্রেতারা দোকানে ভিড় জমানোর সাথে সাথে, নতুন বিবর্তিত ভাইরাস “ডাও” এর খবরে ৯০০ পয়েন্টেরও বেশি পেয়েছে এবং এই দিনটিকে ২০২১ সালের সবচেয়ে খারাপ দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এয়ারলাইন এবং ক্রুজ কোম্পানির স্টক কমে গেছে। তেলের দামও কমেছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা, জুম এবং পেলোটনসহ মহামারীর প্রথম বছরে ভাল কাজ করেছে এমন সংস্থাগুলোতে বিনিয়োগে ফিরে আসে।
এখন দেশটির ভাইরাসের কেন্দ্রস্থল মিশিগানে সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। কোভিড -১৯ রোগীদের বেশিরভাগই টিকাবিহীন। উলভারিন রাজ্য জুড়ে হাসপাতালে রোগীতে ঠাসা যা স্বাস্থ্য-পরিচর্যা ব্যবস্থাকে সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাজ্যের কেসলোড রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিগগিরই একই কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। একজন স্বাস্থ্য নির্বাহী পরিস্থিতিটিকে প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন" হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কমপক্ষে আরও চব্বিশটি রাজ্যে গত দুই সপ্তাহে
আক্রান্তের সংখ্যা অন্তত ৫ শতাংশ বেড়েছে। পঞ্চম মহামারী তরঙ্গ আসছে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যে ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিলেন, তা সত্যিই ঘটতে চলেছে।
করোনা সংক্রান্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো, ক্রমবর্ধমান আক্রান্তের সংখ্যা, ক্রমবর্ধমান মৃত্যু এবং পুনরায় স্বাস্থ্য বিধিনিষেধ নিয়ে ইউরোপ মহামারীর দ্বিতীয় শীতে প্রবেশ করছে। হতাশা সুস্পষ্ট।
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন এই বলে যে, ইউরোপের (বর্তমান) পরিস্থিতি "আমেরিকার জন্য ভবিষ্যতের করোনা পরিস্থিতি" হতে পারে।
--
লেখক:
যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগ, রিজিয়ন-৬ এর ইনফেকশাস ডিসিজ প্রিভনশন (কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনেশন) প্রোগ্রাম কনসালট্যান্ট। এ.পি.এইচ, মিল্কেন ইন্সটিটিউট স্কুল অব পাবলিক হেল্থ,জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি। ওয়াশিংটন ডি সি।