দুই বছরের মাথায় আবারো করোনার নয়া আঘাতে বিশ্ববাজারে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের ধাক্কায় এরইমধ্যে বাতিল হয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সম্মেলন। নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ইউরোপের দেশগুলো। এ অবস্থায় দেশের পোশাক খাতে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এরইমধ্যে পোশাকের অর্ডার কমে গেছে। বিদেশি ক্রেতারা নতুন করে অর্ডার নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে। এছাড়াও নতুন ক্রয় আদেশগুলো নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন তারা। বলছেন, ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়লে পোশাক খাতে আবারও বিপদ নেমে আসবে।
গার্মেন্টস মালিকরা বলছেন, এখন পর্যন্ত বিশ্ববাজারে পোশাকের পর্যাপ্ত ক্রয় আদেশ রয়েছে। সেগুলো দ্রুত রপ্তানির জন্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। তবে এই পরিস্থিতিতে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে নতুন করে ক্রয় আদেশ না নেয়ার প্রবণতার ফলে শঙ্কিত তারা। এতে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে করোনার নতুন আঘাতে আবারও শঙ্কায় পড়েছে ইউরোপসহ সব দেশ। যার প্রাথমিক প্রভাবে সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ১২তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন স্থাগিত হয়েছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম মানবজমিনকে বলেন, যদিও এখন পর্যন্ত তেমন প্রভাব আমরা লক্ষ্য করিনি। অনেক দেশে নতুন করে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। অনেক আউটলেট তাদের বন্ধ। তারা কাজ বন্ধ রেখেছে। তবে এখনও একেবারে ড্যামেজ হয়ে যায়নি। তবে আমাদের অর্ডারগুলো স্লো হয়ে গেছে। আগে অনেক অর্ডার আসতো এখন অনেক কমে গেছে। তিনি বলেন, ওমিক্রন পরিস্থিতি কোনো দিকে যায় সেটা তারা পর্যবেক্ষণ করছে। তবে নতুন ক্রয় আদেশ নিয়ে আমরা কিছুটা শঙ্কিত। চিন্তার বিষয় হল- যদি নতুন ক্রয় আদেশগুলো বাতিল হয়ে যায়, তাহলে আমাদের জন্য বিপদ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) এর নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যে অর্ডারগুলো প্লেস হয়েছে সেগুলো দ্রুত ডেলিভারি করার চেষ্টা করছি আমরা। এগুলো সময়মতো ডেলিভারি করতে পারলে বাঁচি। ওমিক্রনের কারণে যেকোনো সময় এসব অর্ডার স্থগিত হলে নতুন আরেকটা সংকট দেখা দেবে। তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত বায়ারদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখছি। তারাও পরিস্থিতি অবজার্ভ করছে। লকডাউনের কারণে অর্ডার ডেলিভারির ফ্লো বন্ধ হয়ে গেলে সমস্যা তৈরি হবে।
সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ওমিক্রণের কারণে বিভিন্ন দেশে যে সতর্কতামূলক বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা বিশ্ব বাণিজ্যকে ব্যাহত করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদেরকে আরও সাবধান হতে হবে। আগের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগাতে হবে। কারণ, মেজর বায়াররা বিভিন্নভাবে প্যানিক সৃষ্টি করেন বা অর্ডার ডেফিসিয়েন্সি তৈরি করেন। এমনকি অর্ডারে অনেক সময় ডিসকাউন্টও চেয়ে বসেন বা ক্যানসেল করেন। তো এসব সমস্যা যেন না হয় সেজন্য আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে হবে। এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, করোনার আগের ধাক্কায় ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক দেশেই ধাক্কা খেয়েছে। অনেক দেশ সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে ওমিক্রনের কারণে অর্থনীতি আবারও একটা ধাক্কা খেতে যাচ্ছে।
বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, করোনার প্রথম ঢেউয়ে বিশ্বব্যাপী ক্রেতারা ৩১৫ কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের পোশাকের অর্ডার বাতিল ও স্থগিত করেছিল। যা দেশের অন্তত ১ হাজার ১৩৬টি কারখানার ওপর প্রভাব ফেলেছে। যদিও পরবর্তী সময়ে আবার অর্ডার ফিরেছে। সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা থাকলেও প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন করে যদি ইউরোপীয় দেশগুলো বিধিনিষেধ আরোপ করে, তাহলে এর প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিখাতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা পরবর্তী অল্পদিনেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে পোশাক খাত। যা দেশের করোনাকালীন ভেঙে পড়া অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই তৈরি পোশাক রপ্তানি আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ২৪ শতাংশ বেড়েছে। তবে করোনার নতুন ধরনের চোখ রাঙানির ফলে আবারও এই খাতে বিপদের আশঙ্কা করছেন তারা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর মাসের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর মাসে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে পোশাক রপ্তানি ৩২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ে ৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। অর্থাৎ ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে ২০২০ সালের নভেম্বরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।