(১) ১০০ কৃষি প্রযুক্তি এটলাস’
(২) হান্ড্রেড ইয়ার্স অব এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট অব বাংলাদেশ
কোনো দেশের কোনো খাতের উন্নয়ন পর্যায় জানতে হলে প্রথমেই দেখতে হবে সেই নির্দিষ্ট খাতের অনুকূলে কি পরিমাণ ব্যবহারয়োগ্য টেকসই প্রযুক্তি রয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কৃষির দেশ হিসাবে প্রাপ্য কৃষি প্রযুক্তির উপরই নির্ভর করবে উন্নয়নের ধারা ও মাত্রা। কৃষিতে অনুন্নত দেশ হিসাবে এ দেশ প্রযুক্তিতেও ছিল। তবে সাম্প্রতিক এ ব্যপারে সরকারি কয়েকটি উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে যা আশাব্যঞ্জক। উদ্যোগটি হলো -বাংলাদশের প্রায় একশত বছরের কৃষি উন্নয়নের ইতিহাস এবং এই পথক্রমায় প্রথমবারের মতো হাজার প্রযুক্তির নির্যাস থেকে বাছাই করা (১) ১০০ কৃষি প্রযুক্তি এটলাস’ (বাংলা ও ইংরেজী) এবং (২) হান্ড্রেড ইযার্স অব এগ্রিকালচারার ডেভেলপমেন্ট অব বাংলাদেশ (ইংরেজি) পুস্তক ২টি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংকলন ও প্রকাশনা দেশের কৃষিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংযোজন। দেশের অন্যান্য প্রকাশনার সথে এই পুস্তক ২টির মাধ্যমে সরকারিভাবে জানা গেল ১৯২১ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার ৭৭.৩% কৃষির উপর নির্ভর ছিল। তখন সর্বভারতীয় ভিত্তিতে কৃষি নির্ভরতা ছিল ৬৯.৪%।
এই পুস্তকের মতে, বেংগল কৃষি রেভিনিউ কমিশনের (১৯৩৮) ঐতিহাসিক তথ্য হলো তখন দেশের মোট জমির মাত্র ৩৪% বর্গাধার কৃষি শ্রমিকের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তখন দেশে ২ ফসলি জমি ছিল মাত্র ১৬%, ৩ ফসলি বলতে অনুল্লেখ্য, যা অত্যন্ত অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থার নির্দেশক। এরপর প্রায় ৩০ বছর নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দেশ যে অবস্থায় পৌঁছেছিল তাতে ১৯৬৮-৬৯ সালে সে সময়ের ৭ কোটি মানুষের জন্যই ১৫ লক্ষ টন খাদ্য আমদানি করতে হয়েছিল। এরকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে দেশের স্বাধীনতা আসলে পরে কৃষি উন্নয়নের বাস্তবানুগ পরিকল্পনা প্রণীত হয়। এই পুস্তকের মতে আমরা জানতে পারি বর্তমান সময়ের হিসাবে ২ থেকে ৪ ফসলি জমি প্রায় ৫০%, সর্বভারতীয় গড় পরিমাণের চেয়ে বেশি। দেশের কৃষি উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় কৃষির ও জমির উপর নির্ভরশীলতা জেলাভেদে ৫০% পর্যন্ত কমিয়ে জীবন যাপন মান বাড়ানো সম্ভব হয়েছে । খাদ্যপণ্য আমদানি ন্যূনতম। দেশে উদ্ভাবিত কৃষি ও সম্পর্কিত প্রযুক্তির সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। এর মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের বাছাই করা শতাধিক লাভজনক প্রযুক্তি কৃষকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বর্তমান দশকেই। প্রকাশিত পুস্তকটি ব্যয়বহুল বলে এর প্রাপ্যতা সীমাবদ্ধ থাকবে। তাই সাধারণ্যে ব্যবহারের জন্য উচ্চমান প্রযুক্তিসমুহের নাম ও পরিচিতি উল্লেখ করা হলো।
পুস্তকে বর্ণিত শত প্রযুক্তির এটলাস’ মতে প্রযুক্তি সমূহ হল: ১. ব্রিধান ২৮, ২. ব্রিধান ২৯, ৩. ব্রিধান ৩৪, ৪. ব্রিধান ৪৮, ৫. ব্রিধান ৪৯, ৬. ব্রিধান ৫০, ৭. ব্রিধান ৫৮, ৮. ব্রিধান ৬৭, ৯. ব্রিধান ৮৭, ১০. ব্রিধান ৮৯, ১১. বারি আম ৪, ১২. বারি আম ১১, ১৩. বারি মাল্টা ১, ১৪. বারি পেয়ারা ২, ১৫. বারি ড্রাগন ফল ১, ১৬. গ্রীষ্মকালীন টমেটো উৎপাদন প্রযুক্তি (বারি হাইব্রিড টমেটো ৮), ১৭. বারি বিটি বেগুন ৪, ১৮. বারি লাউ ৪, ১৯. বারি আলু ৭২, ২০. বারি মূখীকচু ১ (বিলাসী), ২১. বারি সরিষা ১৪, ২২. বারি মসুর ৮, ২৩. বারি মুগ ৬, ২৪. বারি মাস ৪, ২৫. হাইব্রিড ভুট্টা+মটরশুটি আন্তঃফসল, ২৬. আলু+হাইব্রিড ভুট্টা রিলে ফসল, ২৭. ভাসমান বেড ও মাচা প্রযুক্তিতে লতাসবজির চাষ, ২৮. পাহাড়ী অঞ্চলে টেকসই কৃষির জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ২৯. আকর্ষণ ও মেরে ফেলা পদ্ধতিতে ফল পোকা দমন, ৩০. নারিকেলের মাকড় দমন, ৩১. বারি পানিকচু ১ (লতিরাজ), ৩২. বারি রসুন ৩, ৩৩. ড্রিপসেচ ও মালচ প্রযুক্তিতে লোনা ফসল চাষ, ৩৪. বারি বীজ বপন যন্ত্র, ৩৫. পেয়ারার নেচারেল জেলি প্রস্তুত প্রণালী, ৩৬. স্টাপিং পদ্ধতিতে তাজা ফল সংরক্ষণ, ৩৭. বিনামুগ ৮, ৩৮. ডবনাধান ১০, ৩৯. বিনালেবু ১, ৪০. বিনা জীবাণু সার এসবি ৪, ৪১. বিনাধান ১৯, ৪২. বিনা ধান ৭, ৪৩. বিনা চিনাবাদাম ১০, ৪৪. বিনা ধান ১১, ৪৫. বিজেআরআই তোষা পাট ৮ (রবি ১), ৪৬. বিজেআরআই দেশী পাট ৮, ৪৭. বিজেআরআই দেশী শাক পাট ১, ৪৮. বিজেআরআই কেনাফ ৩, ৪৯. মেহগনি বীজের নির্যাস দিয়ে পাটের হলুদ মাকড় দমন, ৫০. জুট কম্পোজিট, ৫১. পাট আঁশ থেকে মাইক্রো ক্রিষ্টেলাইন সেলুলুজ (এমসিসি) প্রস্তুতকরণ, ৫২. কটন স্পিনিং সিস্টেমে জুট-কটন ওয়েষ্ট সিল্ক বেøন্ডেড সূতার উন্নয়ন,৫৩. বারি গম ৩৩, ৫৪. ডবিøউ এমআরআই গম ১, ৫৫. বারি হাইব্রিড ভুট্টা ১৬, ৫৬.
উত্তরাঞ্চলের ফসলধারা: আগাম আলু-গম- মুগডাল –আমন ধান, ৫৭. গমের ব্লাস্ট রোগের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ, ৫৮. বিএসআরআই আখ ৪২, ৫৯, তালের চারা উৎপাদন প্রযুক্তি, ৬০. স্বাস্থ্যসম্মত গুড় উৎপাদন, ৬১. বিএসআরআই আখ মাড়াইকল, ৬২. গারি আখে আলু চাষ, ৬৩. সিবি হাইব্রিড ১, ৬৪. পাহাড় ঢালে ধান-তুলা আন্তচাষ, ৬৫. তুলা গাছের আগা কর্তন প্রযুক্তি, ৬৬. তুলায় পিজিআর প্রয়োগ, ৬৭. তুলার বোল ওয়ার্ম দমনে ফেরোমন ব্যবহার, ৬৮, চিংড়ি ঘেরপাড়ে তরমুজ চাষ, ৬৯. কলস সেচ প্রযুক্তি, ৭০. পাহাড়ী ভ’মিক্ষয় নিয়ন্ত্রণে ঝাড়বেড়া প্রযুক্তি, ৭১. পাহাড়ী ঢালে ধাপচাষ, ৭২. পাহাড়ী ঢালে জুমচাষ, ৭৩. তুতজাত বিএম ১০, ৭৪. জোড়াসারি হাইবুশ তুতচাষ পদ্ধতি, ৭৫. উন্নত বহুচক্রী সংকর পলুজাত, ৭৬. চাকী পলুপালন, ৭৭. আধুনিক রিলিং মেসিন, ৭৮. বাংলাদেশ টি ২, ৭৯. বাংলাদেশ টি সীড ১, ৮০. চায়ের প্রæনিং চক্র প্রবর্তন, ৮১. টি আইপিএম উন্নয়ন, ৮২. চায়ে সবুজ শস্যের ব্যবহার, ৮৩. বাঁশের টিসু কালচার, ৮৪. ম্যানগ্রোভ নার্সারী কৌশল, ৮৫. ধুপের নার্সারী ও বাগান কৌশল, ৮৬. বাঁশের কম্পোজিট পণ্য উৎপাদন কৌশল, ৮৭. বাঁশ কাঠের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, ৮৮. পাবদা মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ, ৮৯. শিংমাছের নিবিড় চাষ, ৯০. রুই মাছের জাত উন্নয়ন, ৯১. বিএফআরআই সুাপর তেলাপিয়ার চাষ, ৯২. মাছচাষে সল্প মূল্য খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, ৯৩. টেংড়া চাষ ৯৪, কৈ মাছের প্রজনন ও চাষ, ৯৫. শীলা কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন ও ফ্যাটেনিং, ৯৬. উন্নত দেশী মুরগি উৎপাদন, ৯৭. এমসিটিসি-বিএলআরআই মুরগির জাত উদ্ভাবন. ৯৮. গরু হ্রষ্টপুষ্টকরণ প্যাকেজ প্রযুক্তি, ৯৯. সেমি ইন্টেনসিভ পদ্ধতিতে ব্লাক বেংগল ছাগল পালন, এবং ১০০. ডোল পদ্ধতিতে কাঁচা ঘাস সংরক্ষণ পদ্ধতি। এর সাথে রয়েছে এসব প্রযুক্তি সম্পর্কিত ২৫টি সাফল্য গল্প যা পাঠককে প্রযুক্তি ব্যবহারে অনুপ্রাণিত করবে। পুস্তকের ভাষা বাংলা ও ইংরেজি পাশাপাশি রয়েছে, যা বিদেশীদের জন্য সুবিধাজনক। সরকার অনুমোদিত ও প্রকাশিত প্রযুক্তিসমূহ পাঠ করলে বুঝা যাবে যে দেশের কৃষি সেক্টর কত ব্যাপক এবং এর পরিধি কত বড়। এসমস্ত প্রযুক্তির ব্যবহার বিশ্ব কৃষিতে বাংলাদেশ পরিচিত হয়ে উঠছে। প্রযুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এতে রয়েছে ধান গবেষণা প্রযুক্তি ১০%, কৃষি গবেষণা বারি-৩৫%, বিনা-৯%, আখ-৫%, পাট -৭%, তুলা-৬%, চা ৫%, মৎস্য ৯%, লাইভষ্টক-৫%, তুত-৪%, ও বন ৫%। এসব প্রযুক্তির মধ্যে হিসাব করলে আরও দেখা যাবে, এতে জাতভিত্তিক প্রযুক্তি রয়েছে প্রায় ৬৫%, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি ৩২% এবং ফসল সংরক্ষণ মাত্র ৩%। এখানে উল্লেখযোগ্য যে এই কৃষি উন্নয়ন ইতিহাস ও প্রযুক্তি পুস্তকে দেশের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তাতে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের করণীয়গুলোও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। এমন অনেকগুলো করণীয়ের মধ্যে প্রধান কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলো- ১. পুস্তকে বালাই সুরক্ষা প্রযুক্তি মাত্র ৩% স্থান পেয়েছে, যা দেশের নিরাপদ কৃষি উৎপাদনের জন্য অসম্পূর্ণতা প্রকাশ করে। এর উন্নয়ন প্রয়োজন। ২. বর্ণিত প্রযুক্তিগুলো কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কোন বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন করেছেন, প্রযুক্তিটির ব্যাকআপ জার্নাল প্রকাশনা হয়েছে কি না তা উল্লেখ থাকলে ব্যবহারকারীর সন্তুষ্টি বেড়ে যেত। আমার মনে পড়ে আমি যখন সর্বপ্রথম বারি কৃষি প্রযুক্তি হাতবই প্রকাশ করি তখন প্রযুক্তির বৈজ্ঞানিক মালিকানা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। ৩. সাধারণভাবে কোন একটি প্রযুক্তি ব্যবহারকরারীর হাতে দেওয়ার আগে অন-ফার্ম পরীক্ষা করে প্যাকেজ করতে হয়। এখানে বর্ণিত প্রযুক্তির বেলায় তা করা হয়েছিল কি না এ উল্লেখ নাই ইত্যাদি । যাইহোক সাহস করে শুরু করার সুযোগ দিয়েছে সরকার, এটাই বড় কথা। ভবিষ্যতে আরও উন্নয়ন হবে, ব্যবহাকারীর হাতে যাবে ছাপা ও ডিজিটাল প্রকারে এটাই আশা রাখি। সমস্ত প্রশংসা আল্লার জন্য।