চলতি মাসেই ভারত সরকার শাসিত রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের একজন তরুণ সাংবাদিক সাজাদ গুলকে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি জারি করেছে কাশ্মীর প্রেস ক্লাব। ৫ই জানুয়ারি তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। স্থানীয় আদালত প্রাথমিকভাবে জামিন দিলেও শিগগিরই তাকে আবারও বিভিন্ন অভিযোগে আটক করা হয়। প্যারিসভিত্তিক সাংবাদিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস - এর মতে , সাজাদ গুলকে হয়তো ছয় বছরের কারাবাসের সাজা শোনানো হতে পারে । কিন্তু তার অপরাধ কি?
তিনি ভিডিও ক্লিপের সাথে একটি টুইট করেছিলেন, যাতে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মীকে হত্যার প্রতিবাদ দেখানো হয়েছে৷ ইতিমধ্যেই গুলকে সমর্থন করার সাহসী পদক্ষেপের জন্য কাশ্মীর প্রেস ক্লাবকে ভারী মূল্য চোকাতে হয়েছে। প্রথমে পুলিশরা তাদের ভবনে হানা দেয়, তারপর প্রেস ক্লাবটি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দেয়।
১৭ই জানুয়ারি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ভবনটি দখলে নিয়ে নেয়। নিউইয়র্ক ভিত্তিক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট, কাশ্মীরে সাংবাদিকদের প্রতি বছরের পর বছর ধরে এই কঠোর আচরণের অসংখ্য ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। তারা জানিয়েছে, রাজ্যের প্রেস ক্লাবের উপর দমন-পীড়ন নজিরবিহীন।
ভারত সরকার কেন নির্মমভাবে কাশ্মীরি মিডিয়াকে নীরব করার চেষ্টা করছে? সহজ উত্তর হল যে, দিল্লি এই অঞ্চলের উপর বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার জন্য একটি নতুন প্রচেষ্টা শুরু করেছে, যার মধ্যে রয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরাও।
জম্মু ও কাশ্মীর একটি বিতর্কিত এলাকা। এই রাজ্যটি তিনটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দ্বারা বেষ্টিত - ভারত, পাকিস্তান এবং চীন। এই তিনটি শক্তি রাজ্যের তিনটি ভিন্ন অংশ নিয়ন্ত্রণ করে এবং ভারত -পাকিস্তান এর ভূখণ্ডে অন্তত তিনটি যুদ্ধ করেছে। কাশ্মীরকে দক্ষিণ এশিয়ায় এক ধরনের ফিলিস্তিন বিরোধ হিসেবে দেখা যেতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাজ্যটিকে দিল্লি সরাসরি নিজেদের শাসনের অধীনে রেখেছে এবং ভারতীয় সংসদে এই রাজ্য থেকে শুধুমাত্র সীমিত প্রতিনিধি আছেন।
২০১৯ এর অগাস্ট মাসে, ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার করে। কাশ্মীরের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের কয়েকজনকে পরে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং তাঁরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চান দিল্লি রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা ফিরিয়ে দিক, যা এতদিন ছিল । এটি কাশ্মীরিদের একটি জনপ্রিয় দাবি। কিন্তু মোদির মনে ভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি এই অঞ্চলের নির্বাচনী মানচিত্র নতুন করে আঁকতে চান। যাতে রাজ্য বিধানসভায় হিন্দু অধ্যুষিত জম্মু অঞ্চলে আসন সংখ্যা বাড়তে পারে।
জম্মু ও কাশ্মীর হল ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল, কিন্তু এখন মোদি সরকার সেখানে তার ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জন্য একটি নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি করার চেষ্টা করছে। মোদি যে কাশ্মীরে হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী বসানোর পরিকল্পনা করছেন তা আর গোপন নয়। যে সমস্ত মুসলিম নেতারা তখন সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তারা এখন বিশ্বাসঘাতকতা অনুভব করছেন। শুধু তাই নয় , তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আবার আটকও করা হয়েছিল। তবে এই বিজেপি-বিরোধী রাজনীতিবিদরাই মোদির পরিকল্পনার পথে একমাত্র বাধা নয়। স্বাধীন কাশ্মীরি মিডিয়ার কণ্ঠ অন্য কিছু বলছে। প্রতিবাদী কণ্ঠকে থামিয়ে দেবার নজির দেশে প্রথম নয়, তবে জম্মু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে তা আরো মারাত্মক। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাংবাদিকদের তলব করা এবং তাদের বাড়িতে অভিযান চালানো নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুল, যার গ্রেপ্তার সর্বশেষ সংকটের সূত্রপাত করেছে তার বাড়িতেও ২০২১ সালের অক্টোবরে একইভাবে হামলা করেছিল পুলিশ ৷ তিনি এক কূটনীতিকের সাথে সাক্ষাৎকারের সময় বলেছিলেন , '' সেদিনের পর থেকে আমি আজও রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারি না। আমি মনে করি পুলিশ আবার আমার বাড়িতে অভিযান চালাতে পারে''৷ তিনি ঠিকই ভেবেছিলেন। তার ভবিষ্যদ্বাণী এই বছর সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল, যখন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র তার কঠোর নিরাপত্তা আইনের সাহায্যে গুলকে কারাগারের পেছনে নিক্ষেপ করেছিল।
গুলই কাশ্মীরে বন্দী একমাত্র সাংবাদিক নন। তার একজন সহকর্মী আসিফ সুলতান, যিনি ২০১৯ সালে আমেরিকান পুরস্কার জিতেছিলেন, তিনিও একজন নিহত বিচ্ছিন্নতাবাদীর প্রোফাইল লেখার পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সন্ত্রাসীদের কাজে সহযোগিতা করার জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হয়। এরপর থেকে শ্রীনগর এবং জম্মুর অনেক সাংবাদিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে সুলতানের ঘটনার পর থেকে তাদের কাছেও পুলিশকর্তাদের কাছ থেকে একাধিক হুমকি, ফোন এসেছে। কাশ্মীরের মহিলা সাংবাদিকরাও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের রোষের সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রতিভাবান ফটোসাংবাদিক মুসরাত জাহরা অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছেন। ২০২০ সালের এপ্রিলে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়, তাকে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের সম্মুখীন হতে হয়েছে । কেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু ছবি পোস্ট করার জন্য। সম্প্রতি আরেক তরুণ কাশ্মীরি মহিলা সাংবাদিক পুলিশ ও সেনাবাহিনীর দ্বারা তার জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে লিখেছেন, অনলাইনে প্রচারণা করার জন্য তাঁর ওপরেও শাস্তির খাঁড়া নেমে আসে ।
এই হুমকি শুধু মুসলিম সাংবাদিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অনুরাধা ভাসিন একজন হিন্দু সাংবাদিক যিনি তার স্বাধীন অবস্থানের কারণে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। তিনি প্রাচীনতম ইংরেজি দৈনিক কাশ্মীর টাইমসের সম্পাদক। তার সংবাদপত্র স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দ্বারা হয়রানির সম্মুখীন হয়। ২০২০ সালে কর্মকর্তারা সংবাদপত্রের ১৩ টি বিজ্ঞাপন ব্লক করে দেয় এবং ১৭ জনকে অপরাধী হিসেবে উদ্ধৃত করে ।কাশ্মীর প্রেস ক্লাবের ওপর সরকারের সর্বশেষ পদক্ষেপটি সমস্ত কাশ্মীরি সাংবাদিকদের স্বাধীনতার ওপর আঘাত। এইধরণের জিনিস চলতে থাকলে তা আরও উত্তেজনা এবং আরও ঘৃণা তৈরি করবে। মোদি কাশ্মীর প্রেসক্লাব বন্ধ করে দিতে পারেন, কিন্তু কাশ্মীরিদের মনে লকডাউন করতে পারেন না।
সূত্র : washingtonpost.com