শুঁটকি বললেই অনেকেরই জিভে আসে জল। আর সেটি যদি হয় চট্টগ্রামের শুঁটকি তাহলে তো কথায় নেই। ঐতিহ্যবাহী এই চাটগাঁইয়া শুঁটকির সুনাম ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন দেশেও। এখানের কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম শুঁটকিপল্লী। এই নদীর উত্তর-দক্ষিণ তীরঘেঁষা ইছানগর, বাকলিয়া, জুলধা, ডাঙ্গারচর ও কর্ণফুলী ঘাট এলাকায় শুঁটকি মাছের ব্যবসা করে শতবছর ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে এখানকার এই শুঁটকির স্বকীয়তা-ঐতিহ্য এখন আগের মতো নেই।
জানা গেছে, এক সময় শুধু চট্টগ্রামেই শুঁটকি তৈরি হতো। নব্বই দশকের দিকে সুন্দরবনসহ দেশের উপকূলীয় কয়েকটি জায়গায়ও বাণিজ্যিকভাবে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়। তবে এর পরিমাণ ছিল খুব কম।
আর এখন উপকূলবর্তী বিভিন্ন দেশেও মানসম্পন্ন শুঁটকি তৈরি হচ্ছে। আর চট্টগ্রামের কিছু ব্যবসায়ীর কারসাজির কারণে এই চাটগাঁইয়া শুঁটকির কদর কমে গেছে অনেকটা। চাটগাঁইয়া শুঁটকির আগের এই স্থান দখল করে নিচ্ছে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া- মহেশখালীর শুঁটকি। পাশাপাশি বিদেশ থেকে এখন বড় অঙ্কের শুঁটকি আমদানি করা হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে বড় শুঁটকির আড়ত চট্টগ্রামের আছাদগঞ্জ। এখানে ৪০টি শুঁটকির আড়ৎ ও ২৮০ টি পাইকারি দোকান রয়েছে। এছাড়াও আছে শতাধিক খুচরা ও ভাসমান দোকান। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার এখানে বসে শুঁটকির হাট। এখান থেকে এক সময় দেশের শুঁটকির চাহিদার ৮০ শতাংশ মেটানো হতো। আর এটি এখন ৩৫-৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রতি হাটবারে এখানে আগে অন্তত ৫০ ট্রাক শুঁটকি বেচাকেনা হয়। আর এখন ২৫-৩০ ট্রাকের বেশি শুঁটকি কেনাবেচা হয় না। জানা গেছে, চট্টগ্রামে যেসব শুঁটকি উৎপাদন হয়, তার মধ্যে রয়েছে ছুরি, লইট্যা, ইচা, মইল্যা, কেচকি, লাক্কা, রূপচাঁদা, পোপা, মিশালী, ফাইশ্যা, মাইট্যা, চোফি, মনুনিয়া, লবণ ইলিশ উল্লেখযোগ্য। তবে এসবের প্রায় সবটাই এখন কুতুবদিয়া-মহেশখালীতে তৈরি হচ্ছে। আর শুঁটকি শুকানোর পদ্ধতিগত ভিন্নতার কারণেও এখন কক্সবাজারে তৈরি হওয়া এইসব শুঁটকি নজর কাড়ছে ক্রেতাদের। জানা গেছে, চট্টগ্রামের শুঁটকি জনপ্রিয় হলেও নানা কারণে এখানকার শুঁটকি ঐতিহ্য হারাচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী শুঁটকিতে ডিডিটি পাউডারসহ নানা কৃত্রিম রাসায়নিক মিশাচ্ছেন। বিভিন্ন প্রকার পোকামাকড় থেকে রক্ষা পেতে শুঁটকিতে ডিডিটি পাউডার ব্যবহার করা হলেও এতে শুঁটকির গুণগত মান ও স্বাদ উভয়টা নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া একসময় খোলা মাঠে শুকিয়ে এখানে শুঁটকি করা হতো। এতে করে শ্রমিকের মজুরি বেশি লাগার পাশাপাশি শুকাতে বেশি সময় লাগলেও স্বাদ অনেক ভালো হতো। আর এখন মেশিনের সাহায্যেই এখানে অধিকাংশ শুঁটকি শুকানো হয়। এতে ব্যবসায়ীদের প্রায় দ্বিগুণ লাভ হলেও শুঁটকির আগের স্বাদ আর পাওয়া যায় না। যে কারণে এখানের শুঁটকির প্রতি আস্থা কমছে মানুষের। এদিকে চট্টগ্রামের শুঁটকির দাম অন্যান্য জায়গা থেকে একটু বেশি হওয়ার কারণেও অন্যান্য জায়গার শুঁটকির বিক্রিও বাড়ছে। যেমন- চাটগাঁইয়া বড় আকারের ছুরি শুঁটকি কেজিতে ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যেটা কুতুবদিয়া মহেশখালীর ক্ষেত্রে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকায় পাওয়া যায়। ছাগা চিংড়ি চট্টগ্রামের টা বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ১৭০০ টাকা। বাইরের ক্ষেত্রে এটি ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। আর ভারত- পাকিস্তান থেকে আসা একই শুঁটকির দাম আরও কম পড়ে। যে কারণে এইসব শুঁটকির প্রতি ঝুঁকে পড়ছে মানুষ।
দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে শুঁটকি বিক্রি করেন নগরের মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দা জমির উদ্দিন। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ‘চাটগাঁইয়া শুঁটকির সঙ্গে অন্যান্য শুঁটকির দামের ব্যবধান অনেক বেশি। আবার চাহিদা বেশি থাকলেও ইদানীং এই শুঁটকি নেয়ার পর অনেক কাস্টমার খারাপ রিভিউ দিচ্ছেন। যে কারণে আমরা এখন কুতুবদিয়া মহেশখালী ও সুন্দরবনের শুঁটকি রাখছি বেশি। এগুলোর দামও তুলনামূলক অনেক কম। আর মানও এতো খারাপ না। আছাদগঞ্জ আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এক সময় আছাদগঞ্জের চাটগাঁইয়া শুঁটকি দিয়ে দেশের ৭০ ভাগ শুঁটকির চাহিদা মিটতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেক খারাপ। ব্যবসা এখন দুই- তৃতীয়াংশ কমে গেছে। অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিততে যে ধকল গেছে সেটি সামাল দিতে না পারায় অনেকই হারিয়ে গেছেন। সরকার থেকেও তেমন কোনো সাড়া পাইনি। আর দেশের বিভিন্ন জায়গায়ও শুঁটকি তৈরি হচ্ছে। বিদেশ থেকেও আসছে। যে কারণে প্রতিযোগিতা চাটগাঁইয়া শুঁটকি প্রতিযোগিতায় টিকতে কষ্ট হচ্ছে। তবে মানের দিকে চাটগাঁইয়া শুঁটকির সঙ্গে অন্যগুলোর তুলনা হয় না। আর এখানকার প্রশাসন যথাযথ সহযোগিতা করলে আমরা আবারও ঘুরে দাঁড়াবো।