× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

রাঙ্গামাটিতে হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা

বাংলারজমিন

আলমগীর মানিক, রাঙ্গামাটি থেকে
১৮ এপ্রিল ২০১৯, বৃহস্পতিবার

মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পরও পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিতে হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা নামক নিষিদ্ধ ট্যাবলেট। মিয়ানমারে উৎপাদিত ইয়াবা যার অর্থ পাগলা ট্যাবলেট। মেথঅ্যাম্ফিটামিন ও ক্যাফেইন-এর মিশ্রণে তৈরি নেশাজাতীয় জীবন ধ্বংসকারী এই ট্যাবলেট পার্বত্য রাঙ্গামাটি শহরে এখন হাত বাড়ালেই মিলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ‘আমরা ডালে ডালে চললেও মাদক ব্যবসায়ীরা চলছে পাতায় পাতায়।’ তারা নিত্যনতুন ও অভিনব কৌশল অবলম্বন করছে। ফলে সব অভিযানে মাদক শনাক্ত বা জব্দ করা কঠিন। তাই বলা যায়, ইয়াবার দুষ্প্রাপ্যতা বাড়লেও কমেনি সরবরাহ। জেলার অন্যতম কাপ্তাই হ্রদের মধ্যদিয়ে সীমান্তের ওপার থেকে বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে নিয়ে আসা হচ্ছে ইয়াবা ট্যাবলেট। এমনিতর অবস্থায় ইয়াবার ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ ও পুলিশ সুপার আলমগীর কবীর।
মঙ্গলবার রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত জেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের এই দুই কর্মকর্তাই রাঙ্গামাটিতে মাদকের ব্যবহার বেড়েছে মন্তব্য করে এই ধরনের পরিস্থিতিতে নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগে একমত পোষণ করেছেন। সভায় মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর রাঙ্গামাটি কার্যালয়ে নতুনভাবে যোগদান করা সহকারী পরিচালক আবদুল হানিফের পরিচয় তুলে ধরার সময় তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার উভয়েই দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, রাঙ্গামাটিতে এতদিন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নামক একটি কার্যালয় থাকলেও এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম তেমন একটা দৃশ্যমান ছিল না। এমতাবস্থায় রাঙ্গামাটিতে মাদকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার আহ্বান জানিয়ে ডিসি এসপি উভয়েই জানালেন, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যকে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হবে যাতে করে তাদের সঙ্গে নিয়ে রাঙ্গামাটির মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ অভিযান পরিচালনা করতে পারে। এই ক্ষেত্রে কারো কোনো প্রকার তদবিরে কান না দিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে রাঙ্গামাটির মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নবনিযুক্ত সহকারী পরিচালক আবদুল হানিফের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ডিসি-এসপি।
এদিকে, সরজমিনে পুরো শহর ঘুরে এবং জেলার বিভিন্ন সংস্থা ও পুলিশের বিশেষ সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে চালিয়ে যাওয়া এই মাদক সিন্ডিকেটকে নানাভাবে ব্যাকআপ দিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা, এই ব্যাকআপের জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে নেতাদের বাড়তি পাওনা। মাদকের খুচরা বাজার মধ্যম বয়সী কিছু ‘বড় ভাই’ এতদিন নিয়ন্ত্রণ করলেও বর্তমানে তারা ব্যবহার করছে অল্প বয়সী কিশোরদের। আড়াল থেকে তাদের হাতে যারা মাদক পৌঁছে দিচ্ছে তারাই মূলত বড় দু’টি রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠনের খোলস পরে নিজেদের নেতৃত্বের আড়ালে নেতাদের বিভ্রান্ত করছে।
মধ্যমসারির এই নেতাদের রাজনৈতিক কোনো উচ্চাভিলাষ বা আদর্শ নেই তাদের একটাই চাহিদা দলের ছত্রছায়ায় থেকে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া। ইতিমধ্যে সরকার দলের ছাত্রসংগঠনসহ কয়েকটি সংগঠনের কয়েকজন নেতা দামি দামি গাড়ি, সিএনজি অটোরিকশা-মোটরসাইকেলসহ মালিক হয়েছেন বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের। যেগুলো পরিচালিত হচ্ছে ভিন্নভাবে। এই সকল নেতার বেশি সংখ্যকই শহরের রিজার্ভ বাজারের এবং বাকি কয়েকজন তবলছড়ি, বনরূপা ও ভেদভেদী এলাকার বাসিন্দা।


প্রাপ্ত তালিকানুসারে শহরে অন্তত ৮৫ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী খুচরা পর্যায়ে প্রত্যক্ষভাবে ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনা করছে। বেসরকারি একটি সংস্থার তথ্যানুসারে রাঙ্গামাটিতে ইয়াবা সেবনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অন্তত ২ হাজার নিয়মিত গ্রাহক।
পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ইয়াবা বিক্রির ক্ষেত্রে রাঙ্গামাটি শহরের অন্যতম প্রধান হাট হলো রিজার্ভ বাজার এলাকা। আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ী, ডেকোরেশন ব্যবসায়ী, সিএনজি মালিক-চালক, আপেলের দোকানদার, তেলের দোকানদার, ট্রাক ড্রাইভার থেকে কসাই পরিবারের সদস্যও রিজার্ভ বাজার এলাকায় ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। রিজার্ভ বাজার, পৌর ট্রাক টার্মিনাল, উন্নয়ন বোর্ড, পার্ক এলাকা, আবদুল আলী এলাকা, হোটেল সৈকতের পেছনে, চেঙ্গি মুখ, নিচের রাস্তা ও পুলিশ লাইন স্কুল এলাকায় ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে অন্যতম হলো: বেলাল, রোমান, ডেঞ্জু, ইউছুফ, দিদারুল আলম, বাদশা, হুমায়ুন, সোহাগ, সজিব, রাজু, রুবেল ওরফে কবির, পারভেজ, আক্তার, হাবিব, কাদের, মোকতার, কাশেম, রতন, আনোয়ার, নাছির, সাবু, রুবেল, আরজু, ফোরকান, জুয়েল, বাবু ড্রাইভার, সোহেল, রাজু মারমা।
অপরদিকে, শহরের তবলছড়িতে ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে জড়িত রয়েছে ছোট নুরুন্নবী, নুরুল আমিন, মোতালেব ভান্তে, দিপু, সারোয়ার, আনিছ, দোকানদার সম্ভু, উৎপল, রনি, সাদ্দাম, মানিক, মিন্টু, শহিদুল ইসলাম ধনি, রেজা, সুমন, নুনু, সাগর, জনি চাকমা, রুবেল ড্রাইভার, পান্না, নাঈম, ফার্মেসি বাবু, সিএনজি দিদার, পারভেজ, খোকন চাকমা, দুলু, কাউছার, লিটন, বাবা সেলিম, আলমগীর ও আলাউদ্দিন। উপরোক্ত ব্যক্তিরা তবলছড়ির পর্যটন এলাকা, কেরানী পাহাড়, সিলেটি পাড়া, বিডিআর রোড, ব্রাহ্মণ টিলা, নারিকেল বাগান, মালিপাড়া, মাশরুম এলাকা ও আসামবস্তি এলাকায় সার্বক্ষণিক বিচরণ করে ইয়াবা বিক্রি করছে অবাধে।
এদিকে শহরের বাস টার্মিনাল, কাঁঠালতলী, আলম ডকইয়ার্ড থেকে শুরু করে বনরূপা, কোর্ট বিল্ডিং, পাবলিক হেলথ ও সদর হাসপাতাল এলাকা, কলেজ গেট ও ভেদভেদী পর্যন্ত ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে জড়িতরা হলো: আজিজ, সুমন, ছোটন, সজল, মনসুর (সস্ত্রীক), হাশেম (সস্ত্রীক), নুর নাহার, মেজবাহ, বাপ্পী, বাবু, জসিম, রুবেল, সোহেল, রুহুল আমিন, সুজন, আলিফ, শিমুল, আরিফ, জনৈক কালামের ছেলে, সুমন দাশ, ডোম সুজন, শাহীন আলম, বেলাল ও সিও অফিসের জনৈক ফার্নিচার ব্যবসায়ী।
একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতিনিয়ত ইয়াবা বিক্রির অভিনব কৌশল ব্যবহার করছে বিক্রয়কারীরা। তাদেরই একজন ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে হাতে নগদ টাকা গ্রহণ করে মুঠোফোনের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়, নারিকেল বাগান এলাকায় নির্দিষ্ট নাম্বারের গাছের গোড়ায় ইয়াবা রাখা আছে সেগুলো নিয়ে নিন। অপরদিকে পুলিশের কয়েকজন অফিসারের তৎপরতার মুখে ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে জড়িতরা এখন শহরের রাজপথ ছেড়ে নদীকেই বেছে নিয়েছে ইয়াবা বিক্রির নিরাপদ রুট হিসেবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নদীতে আনাগোনা কম থাকাসহ অভিযানের সময় নদীর পানিতে ফেলে দিয়ে সহজেই আলামত বিহীন সাজা যায়, এ ছাড়াও পানিতে ঝাঁপ দিয়ে নিজেকে রক্ষা করা যায়। এ কারণেই কাপ্তাই হ্রদকেই বর্তমানে ইয়াবা বিক্রির অন্যতম হাট বানিয়েছে ইয়াবা বিক্রয়কারীরা। সম্প্রতি বেশ কয়েকজন ইয়াবা ব্যবসায়ী আকস্মিকভাবেই বোটের মালিক বনে গিয়েছে আধুনিক সুযোগ সুবিধা নির্ভর বোট বানিয়ে নদীতে চালাচ্ছে। এ সকল বোটের মাধ্যমে একমাত্র ইয়াবা বিক্রির কাজটিই করে থাকে ব্যবসায়ীরা। প্রতিটি ট্যাবলেট ২শ থেকে ৫শ টাকা পর্যন্ত মূল্য নিয়ে ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেয়া হয়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর