× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

অপরিচিত ফেন্সিংকে পরিচিত করেছেন ফাতেমা মুজিব

মন ভালো করা খবর

সামন হোসেন
১৩ জানুয়ারি ২০২০, সোমবার

মাত্র দুই মাস বয়সে মাকে হারানো মেয়টি এখন লাল-সবুজের গর্ব। গত এসএ গেমসে বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা যে ১৯টি স্বর্ণপদক জিতেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন লড়াই করতে হয়েছে ফেন্সিংয়ে। কারণ, এই পদকটি জিততেই কেবল বাংলাদেশের সামনে বাধা ছিল ভারত-পাকিস্তান। অন্য ১৮ স্বর্ণে যা ছিল না। ফেন্সিং দেশে অপ্রচলিত খেলা হলেও এই ইভেন্টের স্বর্ণটি তাই একটু বেশিই খাঁটি।
এই স্বর্ণটি জেতা যুবতীর নাম ফাতেমা মুজিব। তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা মো. খোরশেদ আলী ও মা হাছিনা বেগম। খোরশেদ আলী ও মা হাছিনা বেগম দম্পতির পঞ্চম সন্তান ফাতেমা। সবার বড় বোনের নাম খাদিজা মুজিব।
তার তিন ভাইয়ের নাম হাছান মুজিব, হোসেন মুজিব ও সাদ্দাম মুজিব। সবার নামের শেষে মুজিব কেন তার সঠিক উত্তর জানা নেই ফাতেমার। তিনি বলেছিলেন, ‘ঠিক বলতে পারব না। তবে আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বঙ্গবন্ধুর দারুণ ভক্ত। বাবাই হয়তো বলতে পারবেন।’


এসএ গেমসে এবারই প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ফেন্সিং। আর প্রথমবারই জিতে নিলেন স্বর্ণপদক। ফাইনালে ১৫ পয়েন্টে স্বর্ণপদক জিতেন ফাতেমা।
২০০১ সালে ফাতেমার দু’মাস বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে মারা যান তার মা। এরপর বড় বোন খাদিজা মুজিব অনেকটা মায়ের মতো করেই লালন-পালন করেছেন ফাতেমাকে। ১৯ বছর পার করেছেন মা’কে ছাড়া। ভাই-বোনেরা কখনই মায়ের অভাব বুঝতে দেননি।
মাসখানেক আগেও পরিচিত পরিম-লে খেলাটির কোনো অবস্থান ছিল না। ‘ফেন্সিংয়ের কথা শুনলে সবাই নাক সিটকাত। এখন ব্যাপারটা বদলে গেছে। সাফের পর মিডিয়ায় এ খেলা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, মানুষও চিনতে শুরু করেছে। আমিও গর্বের সঙ্গে বলতে পারছি’ গর্বের হাসি হবিগঞ্জের এ তরুণীর মুখে।


নেপালে সদ্য সমাপ্ত এসএ গেমস ফেন্সিংয়ের ইভেন্টের ফাইনালে ১৫-১১ পয়েন্টে এক নেপালিকে হারিয়ে সোনা জেতেন ফাতেমা মুজিব। মজার ব্যাপার হলো ২০১৩ সাল থেকে এ খেলায় হাত পাকালেও এটাই তাঁর প্রথম আন্তর্জাতিক ইভেন্ট। বিমানে চড়াও প্রথম! এত প্রথমের মধ্যে অনভিজ্ঞ এ ফেন্সারের স্বপ্নেও ধরা দেয়নি এমন এক সোনালি মুহূর্ত, ‘কোনো আন্তর্জাতিক মিট তো নয়ই, এমন গেমসের কোনো অভিজ্ঞতাই আমার ছিল না। সেখানে সোনা জয়ের স্বপ্ন দেখি কী করে! আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলেছি, হয়ে গেছে।’

সুবাদে অখ্যাত ফেন্সিং খানিকটা খ্যাতি পেয়েছে আর ফাতেমা মুজিবের জীবনেও রঙের ছোঁয়া লেগেছে বৈকি। তাঁর এ জীবন বড় কষ্টের। স্বপ্ন আর সংগতির মধ্যে ছিল বিস্তর ফারক। কর্মহীন মুক্তিযোদ্ধা বাবা খোরশেদ আলীরও সামর্থ্য নেই। আর্থিক অনটনের জাঁতাকলে ফিকে হয়ে যায় মেয়ের কৈশোরের স্বপ্নগুলো। এমনকি লেখাপড়ায়ও পড়ে অনাকাঙ্খিক্ষত বিরতি। তখন অসহায়ের সহায় হয়ে হাজির হয় ফেন্সিং। নৌবাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক চাকরি হয় ২০১৬ সালে। কয়েক বছর বিরতির পর আবার পড়াশোনা শুরু হয় তাঁর। এ বছর দিয়েছেন এসএসসি পরীক্ষা, এরপর জিতেছেন এসএ গেমসের সোনা। ‘দারুণ একটি বছর কাটল আমার। অর্থনৈতিক সমস্যা আগের মতো প্রকট নয়। প্রতি মাসে নৌবাহিনী থেকে পাই ২০ হাজার টাকা করে। চাকরিটা এখন স্থায়ী হয়ে গেলেই হয়। আমার সব কিছুর মূলে ফেন্সিং’ জীবনের ভাগ্য বদলে দেওয়া খেলাটির প্রতি তাঁর অশেষ কৃতজ্ঞতা।


অথচ একসময় তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্রিকেটার হওয়ার। বড় ভাই ফেন্সার সাদ্দাম মুজিবের অনুপ্রেরণায় নাম লেখান ফেন্সিংয়ে। প্রথম দিকে ভাল না লাগলেও পরে মানিয়ে নেন ভালভাবে। অপ্রচলিত খেলাটির চর্চাও বেশি হয় না দেশে, বছরে হয় মাত্র দুটি টুর্নামেন্ট। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও যাওয়া হয় না তেমন। দেশে খেলে নিজের চেষ্টা আর নিষ্ঠার জোরে গত তিন বছরে ফাতেমা মুজিব হয়ে গেছেন দেশের অন্যতম সেরা ফেন্সার। তাই এখন নাকি মেয়েদের সঙ্গে প্র্যাকটিস করেন না তিনি, ‘আমাদের কোন মেয়ে কিভাবে খেলে, সেটা আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে খেললে উন্নতি হবে না। আমি লড়াই করি ছেলেদের সঙ্গে, কারণ তারা লম্বা এবং চ্যালেঞ্জও থাকে বেশি।’


সাবরে ইভেন্টে ফেন্সারের কোমরের ওপর যেকোনো জায়গায় তলোয়ার লাগলেই পয়েন্ট। তলোয়ারের সঙ্গে থাকে কম্পিউটারের যোগ। কোমর পর্যন্ত ছাই রঙের জ্যাকেটে লাগলেই লাইট জ্বলে পয়েন্টের ঘোষণা দেয় সেই কম্পিউটার। দুই প্রতিপক্ষের জন্য দুই রকম রং, লাল ও সবুজ।
লাল-সবুজের আলোতেই বাঁধা পড়ে গেল তাঁর জীবনটা। কোনো আক্ষেপ নেই বরং সদূরে তাকিয়ে দেখেন, ‘এখন অনেক ফেন্সার আসবে। তারা হয়তো আরো ভালো করবে। আগামীতে আরো সোনা আসবে ফেন্সিংয়ে। সুযোগ-সুবিধাও বাড়বে আস্তে আস্তে। আসলে ছোট খেলায় শুরুটা হয়ে গেলে...।’ ছোট খেলার বড় হওয়ার শুরুটা তিনি করে দিয়েছেন। তিন-চার দশক বাদে ফেন্সিংয়ের আরো বিস্তৃতি ঘটলেও ফাতেমা মুজিবকে কেউ ভুলবে না। তিনিই যে খেলাটির শুরুর তারা!
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর