রাহুল গান্ধী বলেছেন, আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে গেলেও ভারতীয় ভূখণ্ড নিয়ে কোনদিন মিথ্যা বলব না।ভারতীয় হিসেবে আমার কাছে দেশ ও জনগণ সবার আগে। আমি কিছু মনে করব না যদি আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়।
ভারতের কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এক টুইটার বার্তায় আরো বলেছেন, চীন ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে বসে আছে। সরকার সেটা গোপন করছে। যারা এ নিয়ে প্রশ্ন করছে তাদেরকে দেশদ্রোহী তকমা লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর সব ঠিক দেখাতে দেশপ্রেমের ইন্ধন তোলা হচ্ছে।
তিনি বলেছেন, ভারতের জমি চীন দখল করে রেখেছে। এ সত্য গোপন করা ও দখলদারদের থাকতে দেয়া রাষ্ট্রবিরোধিতা। সত্য সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত করাই দেশপ্রেম।
ভারতীয় হিসাবে আমার কাছে দেশ ও জনগণ সবার আগে। এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে, চীন আমাদের দেশে ঢুকে রয়েছে। এটা আমায় বিচলিত করে। রক্ত টগবগ করে ফুটে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্দেশ্যে তিনি বলেন ‘একজন রাজনীতিক হিসেবে আপনি যদি আমাকে চুপ থাকতে বলে মানুষকে বোঝান চীনারা ভারতে ঢুকে বসে নেই, আমি তা মেনে নিতে পারব না। আমার রাজনৈতিক জীবন শেষ হলেও ক্ষতি নেই কিন্তু মিথ্যা বলতে পারব না। চীনারা ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করে নেই বলে যারা গলা ফাটাচ্ছেন তারা জাতীয়তাবাদী নন, দেশপ্রেমিক নন।
রাহুল গান্ধীর কি দুঃসাহসিক উচ্চারণ! রাজনৈতিক জীবন শেষ হলেও ক্ষতি নেই। কী অসাধারণ মূল্যবোধ, কী গভীর জীবনবোধ, শেষ হলেও ক্ষতি নেই। সত্য বলে বিনাশ হলেও ক্ষতি নেই। এটাই হওয়া উচিত মানুষের জীবন দর্শন। কারণ একমাত্র সত্যই জীবনকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করে। মিথ্যার সাথে বসবাস করলে সে জীবন হয় খুবই অমর্যাদাকর। সুতরাং অমর্যাদাকর জীবন শেষ হলেও ক্ষতি নেই। এই ধরনের একটা উপলব্ধি রাজনীতিবিদদের নিকট থেকে কাংখিত হলেও সচরাচর পাওয়া যায় না।
রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে জেনেও, জাতীয় নেতৃত্বের কারো কাছ থেকে এমন একটা উচ্চতম মূল্যবোধ আমরা কি আশা করতে পারি? আমরা কি আশা করতে পারি সরকার জনগণের কাছে সত্য কথা প্রকাশ করে সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের পরিচয় দেবে এবং আমরা কি আশা করতে পারি বিরোধী দলের ভুল রাজনীতির কোন একটা স্বীকারোক্তি !
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে ‘সত্য’ ক্রমাগত বিদায় নিচ্ছে। আমরা সবাই সত্যকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছি। যাহা বলিব সত্য বলিব - এই আপ্তবাক্য আমরা আদালতের কাঠগড়ায় আবদ্ধ করে ফেলেছি। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জগতে সত্যের প্রয়োজনীয়তা আমাদের কাছে প্রতি মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। এতো রক্তপাতের দেশে আমরা ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত প্রবাহের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার অনুভূতি লাভ করতে পারেনি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে পারিনি। আমরা সত্যের কাছ থেকে প্রেরণা লাভ করতে পারিনি।
আমাদের রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে এখন মিথ্যার উৎসবকাল। শাসকরা বলে ক্ষমতা দখল অব্যাহত রাখার জন্য আর বিরোধীরা বলে ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি অনুসন্ধানের জন্য। আর যাঁরা সত্য বলতে চান তাঁরা অনেকটা অগোচরেই থেকে যান। কারণ সমাজে সত্যের জায়গা বড় বেশি সংকুচিত হয়ে আছে। আমাদের রাজনীতিতে মিথ্যাজাল চতুর্দিকে ঘিরে আছে। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরে মিথ্যা, অনৈতিকতা ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটছে।
বিশ্বে অতি দ্রুত ধনী হওয়ার তালিকায় বাংলাদেশ প্রথম। অতি দ্রুত ধনী হওয়া মানে দুর্নীতির আশ্রয়ে ধনী হওয়া, রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে ধনী হওয়া। কিন্তু এই যে এতদিন যাবৎ তালিকা প্রকাশ হয়েছে আমরা কি কেউ চিহ্নিত করতে চেয়েছি কারা অতি দ্রুত ধনী হলো কিভাবে ধনী হলো?
যে সমাজে সত্যের মর্যাদা নেই, সত্য উচ্চারিত হয় না, সত্য বললে টুঁটি চেপে ধরা হয়, সে সমাজ সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের কর্তব্য আর রাষ্ট্রের সর্বোত্তম কাজটি হচ্ছে জনগণের স্বার্থ সুরক্ষা দেয়া। আর আমরা এ দুটোকেই রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করেছি ।
নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা, অসাম্য নির্ভর ও ন্যায় বিচারহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার চূড়ান্ত অবলুপ্তিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের শর্ত। কিন্তু আমরা বিগত ৫০ বছর ধরে উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সার্থে লালন করছি। সুতরাং বিদ্যমান রাষ্ট্রশক্তি সমাজে আধিপত্য বিস্তারকারী দুর্নীতিবাজ, লুন্ঠনকারীদের প্রতিনিধিত্ব করে, সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক শ্রমিক ছাত্র-যুবক, সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। জন্মের পরপর সূচনা লগ্নেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত রাষ্ট্রের চরিত্র গণমুখী করতে পারিনি।
ফলে রাজনৈতিক কারণে পরাধীনতাকালের মতোই সাধারণ মানুষই প্রাণ হারায়, সাধারণ মানুষই কারাগারে যায়, ছাত্র-শ্রমিক জনতাই নির্যাতনের শিকার হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই সকল ধরনের অধিকার হারায়। অথচ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল প্রজাতন্ত্রের অঙ্গীকার ।
সত্য, ন্যায় ও আইনের বিপরীতে রাষ্ট্রকে যে জায়গায় আমরা নিয়ে এসেছি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত করে ফেলেছি, সমাজ থেকে যেভাবে ন্যায়বোধ বিতাড়িত করে দিয়েছি তাতে রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য ভাবেই প্রয়োজন হয়ে পড়বে।
আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন যে, তারাই ভবিষ্যৎ ধ্বংসের বীজ বপন করে যাচ্ছেন। করোনা কালের ভয়াবহ সংকটেও আমরা যে দুর্নীতি ও প্রতারণার অপকৌশল নিয়েছি তাতে আমাদের সংস্কৃতির গতিপথ কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে তাও আমাদের নেতৃত্ব মূল্যায়ন করছেন না। আমাদের অপশাসন এবং অনৈতিকতা যে ঘরে ঘরে শাহেদ করিম এর জন্ম দিচ্ছে, তা আমরা কেউ বিবেচনায় নিচ্ছি না। শাহেদ করিমরা হলো উপসর্গ আর মূল সমস্যা হলো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা। রাষ্ট্রের পচন মাথা থেকেই হয়। রাষ্ট্র যদি সত্যের উপর নির্মিত হয় সমাজ সত্যভিত্তিক হতে বাধ্য।
দীর্ঘ ১০ বছর জেল জীবনের শেষে এসে আন্তোনিও গ্রামসিকে অনুরোধ জানানো হয় ক্ষমা প্রার্থনা করে জেল থেকে মুক্তি চাইতে। যে পাদ্রী এই বার্তা নিয়ে তাঁর কাছে এসেছিলেন তাকে হাসতে হাসতে গ্রামসি বলেছিলেন ‘আপনি একজন পাদ্রী, আত্মার প্রহরী তাই না? জীবন দুটো, একটা দেহের আর একটা আত্মার। আপনি কোনটা রক্ষা করতে চান? ক্ষমা প্রার্থনা আমার দেহটাকে বাঁচাবে কিন্তু আত্মাকে মেরে ফেলবে। (সাদিকুর রহমান অনূদিত)
আমরা সবাই মিথ্যার আশ্রয়ে দেহটাকে বাঁচাতে চাইছি কিন্তু সত্যের আশ্রয়ে কেউ আত্মাটাকে সুরক্ষা দিতে চাচ্ছি না।
আমরা আর কবে উপলব্ধি করব ‘সত্যই’ কেবল ধ্বংস আর সর্বনাশ থেকে জাতিকে সুরক্ষা দিতে পারে।
৩১ জুলাই
উত্তরা, ঢাকা।