চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে ডিএপি প্লান্টে ৪টি বিশাল ট্যাংকারে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় মজুদ রয়েছে বিপুল পরিমাণ অ্যামোনিয়াম। যেগুলো যে কোনো সময় ঘটতে পারে বৈরুতের মতো ভয়াবহ বিস্ফোরণ। ঘটাতে পারে ব্যাপক প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতি।
২০১৬ সালের আগস্ট মাসে এই প্লান্টেও অ্যামোনিয়ামের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ৫৫ জন গুরুতর আহত হয়। অনেক মানুষ ওই সময় শ্বাস নিতে না পেরে কর্ণফুলী নদীতে ঝাপ দিয়ে প্রাণে বাঁচে। মারা যায় নদী-পুকুরের অসংখ্য মাছ ও আশপাশের গাছপালা। পানি ছিটিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সার কারখানার প্রকৌশলীরা অনেক কষ্টে অ্যামোনিয়াম গ্যাস নিংসরণ নিয়ন্ত্রণে আনে।
কিন্তু কোন রকম সংস্কার ছাড়াই অ্যামোনিয়াম মজুদকৃত ট্যাংকারগুলো এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে সম্পুর্ণ ঝুঁকি নিয়ে।
ডিএপি প্লান্টে কর্মরত প্রকৌশলী কামরুল হাসান জানান, প্লান্টে ৫ হাজার টন এবং ৫০০ টন ধারণ ক্ষমতার অ্যামোনিয়ামভর্তি দুটি ট্যাংকার রয়েছে ডিপিএ-২ ইউনিটে। ৫০০ টন ধারণ ক্ষমতার অ্যামোনিয়ামভর্তি দুটি ট্যাংকার রয়েছে ডিপিএ-১ ইউনিটে। যা একেকটি ভয়ঙ্কর বোমা।
তিনি বলেন, ২০১৬ সালের ২৩ আগস্ট বিস্ফোরণ হওয়া ট্যাংকারটি ছিল ডিপিএ-১ ইউনিটের। এতে ৫০০ টন অ্যামোনিয়াম মজুদ তখনো ছিল, এখনো আছে। সবমিলিয়ে ৪টি ট্যাংকারে মোট ৬,৫০০ টন অ্যামোনিয়াম মজুদ রয়েছে।
সম্প্রতি লেবাননের বৈরুত বিস্ফোরণের ঘটনার জের টেনে তিনি বলেন, বৈরুত বিস্ফোরণে অ্যামোনিয়ামের মজুদ ছিল ২৭৫০ টন। সে হিসেবে চট্টগ্রামে মজুদ অ্যামোনিয়াম দ্বিগুণেরও বেশি। আর এসব ট্যাংকার বিস্ফোরিত হলে চট্টগ্রামে লেবাননের চেয়েও মারাত্নক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তবে বৈরুত বিস্ফারণের পর প্লান্টের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেছে বলে জানান তিনি।
সূত্রমতে, বিসিআইসির অধীনে পরিচালিত ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের ডিপিএ-২ ইউনিটে ৫০০০ টন এবং ৫০০ টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ট্যাংকার দুটি নির্মাণ করে জাপান। আর ডিপিএ-১ ইউনিটে ৫০০ টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ট্যাংকারটি নির্মাণ করে চীন। যেটিতে ২০১৬ সালের ২৩ আগস্ট দিনগত রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় গ্যাসের ঝাঁঝালো গন্ধে কারখানার ১০-১১ জন শ্রমিক ও আনসার সদস্য অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে গ্যাস কর্ণফুলীর উত্তর পাড়ে চট্টগ্রাম নৌ ও বিমান বন্দর এবং চট্টগ্রাম শহরের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে নগরবাসী। একইভাবে পাশ্ববর্তি কর্ণফুলী থানা, আনোয়ারা ও পটিয়া উপজেলার মানুষ গ্যাসের ঝাঁঝালো গন্ধে অসুস্থ হয়ে পড়ে। রাতেই আনসার সদস্যসহ গ্যাসে আক্রান্ত প্রায় ৫৫ জন নারী-পুরুষ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন।
খবর পেয়ে ট্যাংকারের গ্যাস নিয়ন্ত্রণে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিট। কৃত্রিম বৃষ্টি ছিটিয়ে গ্যাস ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে ট্যাংকারের ফুটো বন্ধ করে কারখানার প্রকৌশলীরা। আর সেই অবস্থায় এখনো দাঁড়িয়ে আছে ট্যাংকারটি। যা সম্পূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন কারখানার সিনিয়র রসায়নবিদ মো. ফয়সাল।
তিনি বলেন, বিস্ফোরিত ট্যাংকারটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের কোন সুযোগ নেই। কারণ ট্যাংকারটি নির্মাণে ত্রুটি রয়েছে। এটি সংস্কার করতে গেলেই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এ ধরণের ট্যাংকার সাধারণ দ্বি-প্রস্থবিশিষ্ট হয়ে থাকে। কিন্তু এটি এক প্রস্থবিশিষ্ট।
এই প্রকৌশলী বলেন, ২০০১ সালে চীনের প্রকৌশলীরা ট্যাংকারটি কিভাবে নির্মাণ করে সে ব্যাপারে আমরা অন্ধকারে ছিলাম। ২০০৬ সালে যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কারখানাটি উদ্বোধন করেন তখনও সেটি চালু করা যায়নি। বাধ্য হয়ে তাঁকে প্রজেক্টরের মাধ্যমে আগে ধারণ করা কারখানার একটি ভিডিও দেখানো হয়। পরে জাপান যখন দ্বি-প্রস্থবিশিষ্ট ট্যাংকার স্থাপন করে তখনই দেশের প্রকৌশলীরা বুঝতে পারেন চীনের তৈরী ট্যাংকারটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এরপর অনেক চেষ্টা করেও এই ট্যাংকারটি সংরক্ষণ ও সংস্কার করার সাহস করেনি প্রকৌশলীরা।
তিনি জানান, ট্যাংকারটির ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার কথা নির্মাণকারী সংস্থা চায়না কমপ্ল্যান্টকে জানালে তারা কিছু তথ্য জানতে চান। তথ্যগুলো পাঠালেও তারা সাড়া দেননি। ফলে সবাই আতঙ্ক নিয়েই সময় কাটাচ্ছেন।
তিনি বলেন, প্লান্টের পাশেই রয়েছে কোরিয়ান ইপিজেড, মেরিন একাডেমিসহ বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কর্ণফুলী টানেলের নানা স্থাপনা ও শিল্প কারখানা। নদীর উত্তর পাড়ে রয়েছে চট্টগ্রাম নৌ ও বিমান বন্দরসহ বিভিন্ন বাণিজ্য কেন্দ্র। যা অ্যামোনিয়াম বিস্ফোরণের মতো ঘটনায় মাটির সাথে মিশে যেতে পারে।
তিনি আরো বলেন, ১৯৯১ সালের ২১ জুন ঘোড়াশালে অ্যামোনিয়াম গ্যাসের ট্যাংক বিস্ফোরণে তাৎক্ষণিকভাবে ৮জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ওই কারখানার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মনজুরুল আলম। এ ঘটনায় বিদেশিসহ অন্তত ৩২ জন আহত হয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিসক মাহবুবুর রহমান বলেন, অ্যামোনিয়াম গ্যাস মারাত্বক বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। এটি মানবদেহের রক্তে আক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ফলে দ্রুত কাহিল হয়ে পড়ে জনস্বাস্থ্য। পরিবেশের উপরও বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে। মারা যেতে পারে মাছ, পাখি ও গাছপালা।
প্রসঙ্গত, কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে ২২.২৮ হেক্টর জমির উপর নির্মিত হয় কাফকোর পূর্ণ সমন্বিত কমপ্লেক্স। এর কর্মকর্তা-কর্মচারীর অধিকাংশই স্থাপনাটির ২ কিলোমিটার দূরে ৬.৪৮ হেক্টর জমির উপর নির্মিত আবাসিক কলোনিতে বসবাস করে। এরমধ্যে ১৯৯৪ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে অ্যামোনিয়া সার ও ২৭ ডিসেম্বর থেকে দানাদার ইউরিয়া উৎপাদন শুরু হয়।
অ্যামোনিয়া উৎপাদনের জন্য কারখানাটিতে দৈনিক ১,৫০০ টন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন টপোজ প্রযুক্তির অ্যামোনিয়া প্ল্যান্ট ব্যবহৃত হয়। প্ল্যান্টটির নিজস্ব ২০,০০০ টন মজুদ সুবিধা রয়েছে। নিজস্ব জেটি থেকে এটি রপ্তানির জন্য প্রতিঘণ্টায় ৫০০ টন শুকনো অ্যামোনিয়াম সরবরাহ করতে সক্ষম।